Sponsor



Slider

বিশ্ব

জাতীয়

মেহেরপুর জেলা


গাংনী উপজেলা

মুজিবনগর উপজেলা

ফিচার

খেলা

মেহেরপুর সদর উপজেলা

ছবি

ফেসবুকে মুজিবনগর খবর

» » » » » মেহেরপুরের সাহিত্য:রমেশচন্দ্র দত্ত




মেহেরপুরের সাহিত্য:রমেশচন্দ্র দত্ত (১৩ আগস্ট ১৮৪৮ - ৩০ নভেম্বর ১৯০৯)ইতিহাসবিদ ও সাহিত্যিক

রমেশচন্দ্র দত্ত মেহেরপুরে হাকিমি করতে এসে রচনা করেন ‘মাধবীকঙ্কণ’ (১৮৬৮-৬৯) উপন্যাস। দীনেন্দ্রকুমার রায় তার সেকালের স্মৃতি গ্রন্থে লিখেছেন, রমেশচন্দ্র দত্ত মাধবীকঙ্কণের ' রচনা শেষ করিয়াছিলেন , সে বোধ হয় ১৮৬৮-৬৯ খৃষ্টাব্দের কথা । ‘মাধবীকঙ্কণ’ -রমেশচন্দ্র দত্ত ॥এক॥ ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে বীরনগর গ্রামে গ্রীষ্মঋতুর একদিন সায়ংকালে গঙ্গাসৈকতে দুইটি বালক ও একটি বালিকা ক্রীড়া করিতেছে। সন্ধ্যার ছায়া ক্রমে গাঢ়তর হইয়া গঙ্গানদী আচ্ছাদন করিতেছে। জলের উপর কয়েকখানি পোত ভাসিতেছে, দিনের পরিশ্রমের পর নাবিকেরা ব্যস্ত রহিয়াছে, পোত হইতে দীপালোক নদীর চঞ্চল বক্ষে বড় সুন্দর নৃত্য করিতেছে। বীরনগরের নদীকূলস্থ আম্রকানন অন্ধকার হইয়া ক্রমে নিস্তব্ধ ভাব ধারণ করিতেছে। কেবল বৃক্ষের মধ্য হইতে স্থানে স্থানে এক-একটি দীপশিখা দেখা যাইতেছে, আর সময়ে সময়ে পর্ণকুটীরাবলী হইতে রন্ধনাদি সংসারকার্য সম্বন্ধীয় কৃষক-পত্নীদিগের করব শুনা যাইতেছে, কৃষকগণ লাঙ্গল লইয়া ও গরুর পাল হাম্বারব করিতে করিতে স্ব স্ব স্থানে প্রত্যাবর্তন করিতেছে। ঘাট হইতে স্ত্রীলোকেরা একে একে সকলেই কলস লইয়া চলিয়া গিয়াছে নিস্তব্ধ অন্ধকারে বিশাল শান্ত-প্রবাহিনী ভাগীরথী সমুদ্রের দিকে বহিয়া যাইতেছে। অপর পাশ্বে প্রশস্ত বালুকাট ও অসীম কান্তার অন্ধকারে ঈষৎ দৃষ্ট হইতেছে। গ্রীষ্ম-পীড়িত ক্লান্ত জগৎ সুস্নিগ্ধ সায়ংকালে নিস্তব্ধ ও শান্ত। তিনটি বালক-বালিকায় ক্রীড়া করিতেছে, বালিকার বয়ঃক্রম নয় বৎসর হইবে। ললাট, বদনমণ্ডল ও গণ্ডস্থল বড় উজ্জ্বল, তাহার উপর নিবিড় কৃষ্ণ কেশগুচ্ছ পড়িয়া বড় সুন্দর দেখাইতেছে। হেমলতার নয়নের তারা দু’টি অতিশয় কৃষ্ণ, অতিশয় উজ্জ্বল, সুন্দরী চঞ্চলা বালিকা পরীকন্যার মত সেই নৈশ গঙ্গাতীরে খেলা করিতেছে। কনিষ্ঠ বালকটির রংক্রম একাদশ বৎসর হইবে, দেখিলেই যেন হেমলতার ভ্রাতা বলিয়া বোধ হয়। মুখমণ্ডল সেইরূপ উজ্জ্বল, প্রকৃতি সেইরূপ চঞ্চল। কেবল উজ্জ্বল নয়ন দুইটিতে পুরুষোচিত তেজোরাশি লক্ষিত হইত ও উন্নত প্রশস্ত ললাটের শিরা এই বয়সেই কখন কখন ক্রোধে স্ফীত হইত। নরেন্দ্রকে দেখিলে তেজস্বী ক্রোধপরবশ বালক বলিয়া বোধ হয়। শীশচন্দ্র ত্রয়োদশবর্ষীয় বালক, কিন্তু মনুষ্যের গম্ভীর ভাব ও অবিচলিত স্থিরবুদ্ধির চিহ্ন বালকের মুখমণ্ডলে বিরাজ করিত। শীশচন্দ্র বুদ্ধিমান, শান্ত, গম্ভীর-প্রকৃতির বালক। দুইটি বালক বালুকায় গৃহ নির্মাণ করিতেছিল, কাহার ভাল হয়, হেমলতা দেখিবে। নরেন্দ্র গৃহনির্মাণে অধিকতর চর কিন্তু চঞ্চল, হেম যখন নিকটে দাঁড়ায়, নরেন্দ্রের ঘর ভাল হয়, আবার হেম শ্রীশের ঘর দেখিতে গেলেই নরেন্দ্র রাগ করে, বালুকাগৃহ পড়িয়া যায়। মহাবিপদ, দুই-তিনবার উৎকৃষ্ট ঘর পড়িয়া গেল। হেম এবার আর শ্রীশের নিকট যাবে না, সত্য যাবে না, যথার্থ যাবে না; নরেন্দ্র, আর একবার ঘর কর। নরেন্দ্র মহা-আহ্লাদে চক্ষুর জল মুছিয়া ঘর আরম্ভ করিল। ঘর প্রায় সমাধা হইল হেম ভাবিল, নরেন্দ্রের ত জয় হইবে, কিন্তু শ্রীশ একাকী আছে, একবার উহার নিকট না যাইলে কি মনে করিবে? কেশগুচ্ছগুলি নাচাইতে নাচাইতে উজ্জ্বল জলহিল্লোলেব ন্যায় একবার শ্রশের নিকটে গেল। শ্রীশ ক্ষিপ্রহস্ত নহে, বালুকা-গৃহনির্মাণে চতুর নহে, কিন্তু ধৈর্য ও বুদ্ধিবলে একপ্রকার গৃহ করিয়াছে, বড় ভাল হয় নাই। নরেন্দ্র একবার গৃহ করে, একবার হেমের দিকে চাহে। রাগ হইল, হাত কঁপিয়া গেল, উত্তম গৃহ পড়িয়া যাইল। নরেন্দ্র ক্রুদ্ধ হইয়া বালুকা লইয়া হেম ও শ্রীশের গায়ে ছড়াইয়া দিল। শ্রীশের জিত, ঘর হইল না। নরেন্দ্রনাথ, সাবধান। আজ বালুকাগৃহ নির্মাণ করিতে পারিলে না, দেখো, যেন সংসার-গৃহ এরূপে ছারখার হয় না। দেখো, যেন জীবন-খেলায় শ্রীশচন্দ্র তোমাকে হারাইয়া বিষয় ও হেমলতাকে জিতিয়া লয় না। নরেস্থের ক্রোধধ্বনি শুনিয়া ঘাট হইতে একটি সপ্তদশবর্ষীয় বিধবা স্ত্রীলোক উঠিয়া আসিলেন। তিনি শ্রীশের জ্যেষ্ঠা ভগিনী; নাম শৈবলিনী। শৈবলিনী আসিয়া আপন ভ্রাতাকে তিরস্কার করিল। শ্রীশ ধীরে ধীরে বলিল, ‘না দিদি, আমি কিছুই করি নাই, নরেন্দ্র ঘর করিতে পারে না, সেইজন্য কাঁদিতেছে, হেমকে জিজ্ঞাসা কর।” “তা না পারুক, আমি নরেন্দ্রের ঘর করিয়া দিব।” এইরূপ সানা করিয়া শৈবলিনী চলিয়া গেলেন। শ্রীশ দিদির সঙ্গে চলিয়া গেল। হেম ও নরেন্দ্রের কলহ শীত্র শেষ হইল। হেম নরেন্দ্রের ক্রন্দন দেখিয়া সজলনয়নে বলিল, “ভাই, তুমি কাঁদ কেন? আমি একটিবার ঘর দেখিতে গিয়াছিলাম, তোমারই ঘর ভাল হইয়াছিল, তুমি ভাঙিলে কেন? তোমার কাছে অনেকক্ষণ ছিলাম, শ্রীশের কাছে একবার গিয়াছিলাম বৈ ত নয়? তুমি ভাই, রাগ করিও না। তুমি ভাই, কাঁদ কেন?” নরেন্দ্র কি আর রাগ করিতে পারে? নরেন্দ্র কি কখন হেমের উপর রাগ করিয়া থাকিতে পারে? তাহার পর বালক-বালিকার কি কথা? আকাশে কেমন তা ফুটিয়াছে। ওগুলা কি ফুল, না মানিক? নরেন্দ্র যদি একটি কুড়াইয়া পায়, তাহা হইলে কি করে? তাহা হইলে গাঁথাইয়া হেমের গলায় পরায়। ঐ দেখ, চাঁদ উঠিবার আগে কেমন রাঙা হইয়াছে। ও আলো কোথা হইতে আসিতেছে। বোধ হয়, নদী পার হইয়া খানিক যাইলে ঐ আলো ধরা যায়। না, তাহা হইলে ওপারের লোক ধরিত। বোধ হয়, নৌকা করিয়া অনেক দূর যাইতে যাইতে চাঁদ যে দেশে উঠে, তথায় যাওয়া যায়; সে দেশে কি রকম লোক, দেখিতে ইচ্ছা করে। নরেন্দ্র বড় হইলে একবার যাবে, হেম, তুমি সঙ্গে যেও। বালক-বালিকা কথা কহিতে থাকুক, আমরা এই অবসরে তাহাদের পরিচয় দিব। এই সংসারে বয়োবৃদ্ধ বালক-বালিকারা গঙ্গার বালুকার ন্যায় ছার বিষয় লইয়া কিরূপ কলহ করে, চন্দ্রালোকের ন্যায় বৃথা আশার অনুগমন করিয়া কোথায় যাইয়া পড়ে, তাহারই পরিচয় দিব। পরিচয়ে আবশ্যক কি? পাঠক, চারিদিকে চাহিয়া দেখ, জগতের বৃহৎ নাট্যশালায় কেমন লোক-সমারোহ, সকলেই কেমন নিজ নিজ উদ্দেশ্যে ধাবমান হইতেছে। কে বলিবে কি জন্য? ॥ দুই ॥ নরেন্দ্রনাথের পিতা বীরেন্দ্রনাথ দত্ত ধনাঢ্য ও প্রতাপশালী জমিদার ছিলেন। তিনি নিজ গ্রামে প্রকাণ্ড অট্টালিকা নির্মাণ করাইয়া আপন নামানুসারে গ্রামের নাম বীরনগর রাখিয়াছিলেন। তাঁহার যথার্থ সহৃদয়তার অন্য সকলে তাঁহাকে মান্য করিত, তাঁহার প্রবল প্রতাপের জন্য সকলে তাঁহাকে ভয় করিত, পাঠান-জায়গীরদারগণ ও স্বয়ং সুবাদার তাঁহাকে সম্মান করিতেন। বাল্যকালে বীরেন্দ্র নবকুমার মিত্র নামক একটি দরিদ্র-পুত্রের সহিত একত্রে পাঠশালায় পাঠ করিতেন। নবকুমার অতিশয় সুশীল ও নম্র ও সর্বদাই তেজস্বী, বীরেন্দ্রের বশংবদ হইয়া থাকিত, সুতরাং তাহার প্রতি বীরেন্দ্রের স্নেহ জন্মিয়াছিল। যৌবনকালে যখন বীরেন্দ্র জমিদারি স্থাপন করিলেন, নবকুমারকে ডাকাইয়া আপনার অমাত্য ও দেওয়ান-পদে নিযুক্ত করিলেন। নবকুমার অতিশয় বুদ্ধিমান ও সুচতুর, সুশৃঙ্খলরূপে কার্য-নির্বাহ করিতে লাগিলেন। নবকুমার স্বার্থপর হইলেও নিতান্ত মন্দ লোক ছিলেন না, বীরেন্দ্রের নিকট ভিক্ষা করিয়া দুইখানি গ্রাম আপনার নামে করিলেন, কিন্তু ভয়ে হউক, কৃতজ্ঞতাবশতঃ হউক, বীরেন্দ্রের জমিদারির কোনও হানি করেন নাই। বীরেন্দ্রের মৃত্যুর সময়ে নরেন্দ্র অতি শিশু, জমিদারি ও পুত্রের ভার প্রিয় সুহৃদের হস্তে ন্যস্ত করিয়া বীরেন্দ্র মানবলীলা সংবরণ করিলেন। ভালবাসা যতদূর নামে ততদূর উঠে না, অপত্যস্নেহের ন্যায় পিতৃস্নেহ বা মাতৃস্নেহ বলবান্ হয় না, দয়া অপেক্ষা কৃতজ্ঞতা দুর্বল ও ক্ষণভঙ্গুর। নবকুমারের কৃতজ্ঞতা শীঘ্র ভাঙিয়া গেল। নবকুমার নিতান্ত মন্দ লোক ছিলেন না, কিন্তু নবকুমার দরিদ্র, ঘটনাস্রোতে সমস্ত জমিদারি প্রাপ্তির আশা তাঁহার হৃদয়ে জাগরিত হইল। সে লোভ দরিদ্রের পক্ষে দুর্দমনীয়। বীরেন্দ্রের পুত্র অতি শিশু, বীরেন্দ্রের পূর্বেই মৃত্যুগ্রাসে পতিত হইয়াছিলেন, শিশুর বিষয় রক্ষা করে, এরূপ জ্ঞাতি-কুটুম্ব কেহ ছিল না, দুই-একজন যাঁহারা ছিলেন, তাহারাও নবকুমারের সহিত যোগ দিলেন। সংসারে যাঁহারা বীরেন্দ্রের অভিভাবক ছিলেন, তাঁহারা কিছুই জানিলেন না অথচ জানিয়া কি করিবেন? তথাপি নবকুমার সমস্ত জমিদারি একাকী লইবেন, প্রথমে এরূপ উদ্দেশ্য ছিল না, বীরেন্দ্রের জীবদ্দশাতেই দুই-পাঁচখানি গ্রাম আপন নামে করিয়াছিলেন, এখন আরও দুইপাঁচখানি গ্রাম আপন নামে করিতে লাগিলেন। ক্রমে লোভ বাড়িতে লাগিল। ভাবিলেন, আমার একমাত্র কন্যা হেমের সহিত নরেন্দ্রের বিবাহ দিব, অবশেষে বীরেন্দ্রের জমিদারি তাঁহার পুত্রেরই হইবে, এখন নাবালকের নামে জমিদারি থাকিলে গোলমাল হইতে পারে, সম্প্রতি আপন নামে থাকাতে বোধ হয় কোন আপত্তি হইতে পারে না। এই প্রকার চিন্তা করিয়া তদনুসারে কার্য করিতে লাগিলেন। তৎকালে সুবাদারের সভাতে প্রধান প্রধান জমিদার ও জায়গীরদারদিগের এক একজন উকীল থাকিত। তাহারা নিজ নিজ মনিবেব পক্ষ হইতে মধ্যে মধ্যে নজর দিয়া সুবাদারের মন তুষ্ট রাখিত ও মনিবের পক্ষ হইতে আবেদন আদি সমস্ত কার্য নির্বাহ করিত। সদরে এইরূপে একটি একটি উকীল না থাকিলে জমিদারির বিশেষ অনিষ্ট হইবার সম্ভাবনা ছিল। বীরনগর জমিদারির উকীল এক্ষণে নবকুমারের বেতনভোগী। তিনি বঙ্গদেশের কানঙ্গু মহাশয়ের নিকট আবেদন করিলেন যে, বীরেন্দ্রের মৃত্যু হইতে জমিদারির খাজনা নিয়মিতরূপে আসিতেছে না, তবে নবকুমার নামে একজন কার্যদক্ষ লোক সেই জমিদারির ভার লইয়া আপন ঘর হইতে যথাসময়ে খাজনা দিতেছে। নবকুমার বীরেন্দ্রের বিশেষ আত্মীয় ও বীরেন্দ্রের পরিবারকে প্রতিপালন করিতেছে। আবেদনসহ পঞ্চ সহস্র মুদ্রা কানঙ্গু মহাশয়ের নিকট উপঢৌকন গেল। আবেদনের বিরুদ্ধে কেহ দণ্ডায়মান ছিল না, তৎক্ষণাৎ বীরেন্দ্রের নাম খারিজ হইয়া নবকুমারের নাম লিখিত হইল। অদ্য নবকুমার মিত্র বীরনগরের জমিদার। জমিদারের হৃদয়ে নূতন নূতন ভাবের আবির্ভাব হইতে লাগিল। যে নরেন্দ্রের পিতাকে পূর্বে পূজা করিতেন, যে নরেন্দ্রকে এতদিন অতিযত্নে পালন করিয়াছেন, অদ্য সেই নরেন্দ্র তাঁহার চক্ষুর শূল হইল। নবকুমারের সাক্ষাতে না হউক, অসাক্ষাতে সকলেই বলিত নরেন্দ্রের বাপের জমিদারি, নবকুমারের জমিদারি' কেহ বলিত না। গ্রামের প্রজারাও নরেন্দ্রকে দেখিয়া জমিদারপুত্র বলিত। প্রকৃত জমিদার নবকুমার কি এ সমস্ত সহ্য করিতে পারেন? তিনি চিন্তা করিলেন, আমি কি অপবাদ বহন করিবার জন্যই এই জমিদার্নি করিলাম? পুনরায় নরেন্দ্রের সহিত হেমের বিবাহ হইলে কে না বলিবে, পিতার জমিদারি পুত্র পাইল, আমার নাম কোথায় থাকিবে? এতটা করিয়া কি পরিণামে এই ঘটিবে? আমি কি জমিদার হইয়াও বালকের দেওয়ান বলিয়া পরিগণিত হইব? কার্যেও কি তাহাই করিব, সযত্নে জমিদারি রক্ষা করিয়া পরে নরেন্দ্রকে ফিরাইয়া দিব? বিচক্ষণ প্রগাঢ়মতি নবকুমার এইরূপ চিন্তা করিয়া স্থির করিলেন যে, আপন নাম চিরস্মরণীয় করা আবশ্যক। তিনি পোষ্যপুত্র লইবেন অথবা কোন দরিদ্রের সহিত আপন কন্যা হেমলতার বিবাহ দিবেন। পণ্ডিতবর নবকুমার এইরূপ সুন্দর সিদ্ধান্ত করিয়া কার্যসাধনে যত্নবান হইলেন। নিকটস্থ একটি গ্রামে গোকুলচন্দ্র দাস নামক একজন ভদ্রলোক একটি পুত্র ও একটি বিধবা কন্যা ও অল্প সম্পত্তি বাখিয়া কাল গ্রাসে পতিত হন। পুত্রটির নাম শ্রীশচন্দ্র দাস, কন্যার নাম শৈবলিনী। নবকুমার শ্রীশচন্দ্রকে বীরনগরে আনাইয়া লালনপালন করিতে লাগিলেন। শৈবলিনী শশুরালয়ে থাকিত, কখন কখন ভ্রাতাকে দেখিবার জন্য বীরনগরে আসিয়া দুই-একদিন বাস করিত। ভ্রাতা ভিন্ন বিধবার আর কেহই এ জগতে ছিল না। বুদ্ধিমান নবকুমার দায়শূন্য ছিলেন না, বীরেন্দ্র জ্ঞাতি-কুটুম্বকে বাটী হইতে তাড়াইয়া দেন নাই; পরিচারিকারূপে তাঁহারা সকলেই আহারাদি কার্য করিত ও দিবানিশি প্রকাশ্যে নবকুমারের গৃহিণীর সাধুবাদ ও খোসামোদ করিত, গোপনে বিধাতাকে নিন্দা করিত। নবকুমার নরেন্দ্রকে এখনও লালনপালন করিলে, আপন অমাত্যবর্গের নিকট সর্বদাই ঈষৎ হাস্য করিয়া বলিতেন, “কি করি! বীরেন্দ্র জমিদারি বুঝিতেন না, সমস্ত বিষয়টি খোয়াইয়াছিলেন। পরের হাতে গেলে বীবেন্দ্রের পরিবার ও পুত্রের কষ্ট হয়, সেইজন্য আমিই ক্রয় করিলাম, নচেৎ জমিদারিতে বিশেষ লাভ নাই। এখন অনাথ নরেন্দ্রকে আমি লালনপালন করিতেছি। বীরেন্দ্রের অনেকগুলি পরিবার, আমি খাইতে পরিতে দিতেছি। কি করি, মানুষে কষ্ট পায়, এ তো আর চক্ষে দেখা যায় না! আর ভাবিয়া দেখ, ভগবান টাকা দিয়াছেন কি জন্য? পাঁচজনকে দিয়ে সুখ, রাখিতে সুখ না, পরকে দিব, তাহাতে যদি আমার কিছু না-ও থাকে সে-ও ভাল।” অমাত্যে বলিত, “অবশ্য, অবশ্য, আপনি মহাশয় শোক, আপনার দেয়ার শরীর, সেইজন্যই এমন আচরণ করিতেছেন, অন্যে কি এমন কয়ে? এই তো এত জমিদার আছে, আপনি যতটা বীরেন্দ্রের পরিবারের জন্য করেন, এমন আর কে কাহার জন্য করে? আহা, আপনি না থাকিলে নরেন্দ্রকেই বা কে খাইতে দিত, অন্য লোকেরই বা কে ভরণপোষণ করিত? তাহারা যে দুইবেলা পেট ভরিয়া খাইতে পায়, সে কেবল আপনার অনুগ্রহে। আপনার মত পুণ্যবান লোক কি আর আছে?” হর্ষ-গদগদ-স্বরে ঈষৎ-বিস্ফারিত লোচনে নবকুমার উত্তর করিতেন, “না বাপু, আমি পুণ্য জানি না, চিরকালই আমার এই স্বভাব। আজ বীরেন্দ্রের পরিবার বলিয়া কিছু নূতন নহে, ইহাতে দোষ হয়, আমি দোষী, পুণ্য হয়, তাহাই” ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা পূর্বেই বলিয়াছি, নবকুমার নিতান্ত মন্দ লোক ছিলেন না। চাহিয়া দেখ, সকলেই নবকুমারকে বিচক্ষণ বুদ্ধিমান লোক বলিয়া সমাদর করিতেছে। শুন, সকলেই তাঁহাকে দয়াশীল, ব্রাহ্মণভক্ত লোক বলিয়া খ্যাতি করিতেছে। অদ্যাপি নবকুমারের ন্যায় লোক লইয়া আমাদের সমাজ গর্বিত রহিয়াছে, তাঁহাদের সর্বস্থানে সমাদর, সর্বস্থানে প্রশংসা, সর্বস্থানে প্রভুত্ব। মানী জ্ঞানী বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন নবকুমার মরিলে সমাজ শিরোমণি হারাইবে, সমাজে হুলস্থূল পড়িয়া যাইবে। যিনি সর্বস্থানে আদৃত, সকলের মান্য, তোমার আমার কি অধিকার আছে তাহার নিন্দা করি? ॥ তিন ॥ আমরা পূর্বেই বলিয়াছি, শৈবলিনী সন্ধ্যার সময় ঘাট হইতে ফিরিয়া আসিলেন। ধর্মপরায়ণ শান্তচিন্তা বিধবা সন্ধ্যায় পূজা সমাপ্ত করিয়া বালক-বালিকাগুলিকে লইয়া গল্প করিতে বসিলেন। শৈবলিনী মাসে কি দুই মাসে বীরনগরে আসিতেন। শৈবলিনী বড় গল্প করিতে পারিতেন। শৈবলিনীর সন্তানাদি নাই, সকল শিশুকেই আপনার বলিয়া মনে করিতেন। এই সমস্ত কারণে শৈবলিনী বালক-বালিকাদিগের বড় প্রিয়পাত্রী। শৈব আসিয়াছেন, গল্প করিতে বসিয়াছেন, শুনিয়া এই প্রকাণ্ড অট্টালিকার সমস্ত বালকবালিকা একত্র হইল, কেহই শৈবলিনীর অনাদরের পাত্র ছিল না। কাহাকেও ক্রোড়ে, কাহাকেও পার্শ্বে, কাহাকেও সম্মুখে বসাইয়া শৈবলিনী মহাভারতের অমৃতমাখা গল্প করিতে লাগিলেন। আমরা এই অবসরে শৈবলিনীর বিষয়ে দুই-একটি কথা বলিব। শৈবলিনীয় পিতা সামান্য সঙ্গতিপন্ন ও অতিশয় ভদ্রলোক ছিলেন। শ্রীশচন্দ্র ও শৈবলিনী পিতার গুণগ্রাম ও মাতার ধীরস্বভাব ও নম্রতা পাইয়াছিলেন, অতি অল্প বয়সে শৈবলিনী বিধবা হইয়াছিলেন, স্বামীর কথা মনে ছিল না, সংসারে সুখ-দুঃখ প্রায় জানিতেন না, এ জন্মে চির-কুমারী বা চির-বিধবা হইয়া কেবল মাতার সেবা ও ছোট ভাইটির যত্ন ভিন্ন আর কোন ধর্ম জানিতেন না। শৈবলিনীর পিতার মৃত্যুর পর তাঁহাদের অবস্থা ক্রমশ মন্দ হইতে লাগিল, এমন কি, অন্নের কষ্ট কাহাকে বলে, অভাগিনী শৈবলিনী ও তাঁহার মাতা জানিতে পারিলেন; কিন্তু সেই শান্ত নস্ত্র বিধবা একবারও ধৈর্যহীন হন নাই, অতি প্রত্যুষে উঠিয়া আান ও পূজাদি সমাপন কবিয়া কায়িক পরিশ্রমের দ্বারা বৃদ্ধা মা ও শিশুর জন্য বন্ধনাদি করিতেন। প্রত্যুষে প্রফুল্ল পুষ্পের ন্যায় শৈবলিনী নিজ কার্য আরম্ভ করিতেন, শান্ত-নিস্তব্ধ সন্ধ্যাকালে শান্তচিত্ত বিধবা কার্য সমাপন করিয়া মাতার সেবায় ও শিশুভ্রাতার লালনপালনে রত হইতেন। সেই কৃষ্ণকেশমণ্ডিত, শ্যামবর্ণ, বাকশূন্য মুখখানি ও আয়ত শাস্তরশ্মি নয়ন দুইটি দেখিলে যথার্থ সদয় স্নেহে আপ্লুত হয়। যথার্থই বোধ হয় যেন সায়ংকালের শাস্তি ও নিস্তব্ধতা শৈবালে আবৃত মুদিতপ্রায় শৈবলিনী মুখখানি নত করিয়া রহিয়াছে। এ জগতে শৈবলিনী কিছুরই আকাঙ্খিনী নহে। বিধবা শৈবলিনী সহচর চাহে না, যে আম্রবৃক্ষ ও বংশবৃক্ষ শৈবলিনীর নম্র কুটীর চারিদিকে সস্নেহে মণ্ডিত করিয়া মধ্যাহ্ন ছায়া বর্ষণ ও সায়ংকালে মৃদুস্বরে গান করিত, তাহারই শৈবলিনীর সহচর। তাহারাও যেমন প্রকৃতি সন্তান, শৈবলিনীও সেইরূপ প্রকৃতির সন্তান; জগদীশ্বর তাহাদের ভরণপোষণ করিতেন, অনাথিনী শৈবলিনীকেও ভরণপোষণ করিতেন। শৈবলিনী শৈশবে বিধবা, কিন্তু প্রেমের আকাজিনী নহে, কেন না সমগ্র জগৎ শৈবের প্রেমের জিনিস। বৃক্ষে বসিয়া যে কপোত-কপোতী গান করিত, তাহারাও শৈবের প্রেমের পাত্র, তাহাদের সঙ্গে শৈব একত্র গান গাইত, তাহাদেব প্রত্যহ তণ্ডল দিয়া পালন করিত। শৈব যখন বৃদ্ধা মাতাকে সেবা দ্বারা সন্তুষ্ট করিতে পারিত, তখনই শৈবলিনীর হৃদয় প্রেমরসে অগ্নিত হইত,মাতাকে সুখী দেখিলে শৈবের নয়ন আনন্দাশ্রুতে পরিপূর্ণ হইত। যখন শিশু শ্রীশচন্দ্রকে ক্রোডে লইয়া মুখচুম্বন করিত, যখন শিশু আহলাদিত হইয়া দিদি বলিয়া শৈবকে চুম্বন করিত, তখন যথার্থই শৈবের হৃদয় নাচিয়া উঠিত, অশ্রুতে বসন ভিজিয়া যাইত। আর যখন সায়ংকালে শান্ত নিস্তব্ধ নদীর প্রশান্ত বক্ষে চার বিভুধিত স্বর্গের প্রতিবিম্ব দেখিয়া ভগবানের কথা মনে পড়িত, যিনি চন্দ্র, তারা ও নদী সৃষ্টি করিয়াছেন, যিনি পক্ষীকে শাবক দিয়াছেন ও শৈবকে শ্রীশ দিয়াছেন, সেই ভগবানের কথা মনে পড়িত। তখনই শৈবলিনী হৃদয় অনন্ত প্রেমে সিক্ত হইত। শৈবলিনীর স্বামী বা পুৱ নাই, শৈবলিনীর প্রেমের একমাত্র ভাগী কেহ ছিল না, সুতরাং বর্ষাকালের নদীস্রোতের ন্যায় প্রেমিক আর কে আছে? জগৎ যেরূপ বিস্তারিত, সমুদ্র যেরূপ গভী, আকাশ যেরূপ অনন্ত, শৈবলিনীর প্রেম সেইরূপ বিস্তারিত গভীর অনন্ত। এইরূপে কিছুকাল অতীত হইলে শৈবলিনীর মাতার কাল লইল, ধীর-ভাব, রূপবান, ভদ্রবংশজাত শ্রীশচন্দ্রকে নবকুমার আপন কন্যার সহিত বিবাহ দিবার ইচ্ছায় বীরনগরে লইয়া গেলেন। যাদের জন্য শৈবলিনী পশুরগৃহ ত্যাগ করিয়াছিলেন, তাহারা না থাকায় শৈবলিনী পুনরায় শ্বশুরালয়ে গেলেন ও তথায় বাস করিতে লাগিলেন। ॥ চার॥ পূর্বোপ্লিখিত ঘটনাবলীর পর চারি বৎসরকাল অতিবাহিত হইল। চারি বৎসরে কিরূপ পরিবর্তন হয়, পাঠক মহাশয় তাহা অনুভব করিতে পারেন। শ্রীশচন্দ্র এক্ষণে সপ্তদশ বৎসর বয়ঃক্রমের যুবক, ধীর শান্ত, বিচক্ষণ, ধর্মপরায়ণ। তাহার প্রশস্ত উদার মুখমণ্ডল ও উন্নত অবয়ব দেথিলেন গম্ভীর প্রকৃতি ও স্থিরবুদ্ধি জানিতে পারা যায়। নরেন্দ্র পঞ্চদশ বর্ষের উগ্র যুবা, শ্রীশ অপেক্ষাও উজ্জ্বল গৌরবর্ণ, উন্নতকায় ও তেজস্বী কিন্তু অতিশয় উগ্র, ক্রোধপরবশ ও অসহিষ্ণু। নবকুমারের ঘৃণা সে সহ্য করিতে পারিত না, শ্রীশচন্দ্রের যথার্থ গুণের কথাও সে সহ্য করিতে পারি না, সর্বদা তাহার মুখমণ্ডল রক্তিম বর্ণ ধারণ করিত। এখনও পর্যন্ত যে নরেন্দ্র এ সমস্ত সম্ভ করিয়াছিল, সে কেবল হেমলতার জন্য। মরুভূমিতে একমাত্র প্রস্রবণের ন্যায় হেমলতার অমৃতমাখা মুখখানি নরেন্দ্রের উত্তপ্ত হৃদয় শান্ত ও শীতল করিত, হেমলতার জন্য নরেন্দ্র নবকুমারের তিরস্কারও সহ্য করিত, আপন বিজাতীয় ক্রোধ সংবরণ করিত। হেমলতা ক্রয়োদশবর্ষের বালিকা। আকাশে প্রথম উষাচিহ্নের ন্যায় প্রথম যৌবনচিহ্ন হেমলতার শরীরে প্রকাশ পাইতেছে। নিবিড় কৃষ্ণ কেশরাশি লম্বমান হইয়া বক্ষস্থল ও গণ্ডস্থল আবরণ করিতেছে, উজ্জ্বল গৌরবর্ণ যৌবনাবন্তে অধিকতর উজ্জ্বল আভায় প্রকাশ পাইতেছে, সুন্দর আয়ত নয়ন দুইটি বাল্যকাল-সুলভ চাঞ্চল্য পরিত্যাগ করিয়া এক্ষণে ধীর ও শান্ত ভাব ধারণ করিয়াছে; সমস্ত অবয়বও ক্রমে পূর্ণতা প্রাপ্ত হইতেছে। সেই সুগঠিত, কুসুম-বিনিন্দিত শরীরে কি নব নব ভাব প্রকাশ করিয়াছে, তাহা বর্ণনায় আমরা অক্ষম; তবে হেমলতার আচরণে যাহা লক্ষিত হয়, তাহাই বলিতে পারি। হেম এখনও নরেন্দ্রের সহিত কথাবার্তা কহিতে বড় ভালবাসে, কিন্তু বালিকা অধোবদনে ধীরে ধীরে কথা কহে, ধীরে ধীরে নরেন্দ্রের মুখের দিকে নয়ন উঠাইয়া আবার মস্তক অবনত করে। আহা, সে আয়ত প্রশান্ত নয়ন দুইটি নরেন্দ্রের মুখের উপর চাহিতে বড় ভালবাসে। সেই বালিকার ক্ষুদ্র হৃদয় নরেন্ত্রের কথা ভাবিতে বড় ভালবাসে। যখন সায়ংকালে নরেন্দ্র নৌকায় আরোহণ করিয়া গঙ্গার প্রশান্ত বক্ষে ইতস্তত বিচরণ করে, বালিকা গবাক্ষপার্শ্বে বসিয়া স্থির নয়নে তাহাই দেখে, যখন নৌকা অনেক দূর ভাসিয়া যায়, সন্ধ্যার অপরিস্ফুট আলোক যতদূর দেখা যায়, বালিকা সেই গঙ্গার অনন্ত বোত নিরীক্ষণ করে। সন্ধ্যার পর বাটা আসিয়া যখন নরেন্দ্র ‘হেম’ বলিয়া কথা কহিতে আইসে, তখন সেই আনন্দদায়িনী কথায় হেমের হৃদয় ঈষৎ নৃত্য করিয়া উঠে। যখন দুই-একদিনের জন্যও নরেন্দ্র ভিন্ন গ্রামে গমন করে, তখন প্রাতে, মধ্যাহ্নে, সায়ংকালে হেম অন্যমনা হইয়া থাকে। তথাপি হেমের মনের কথা কেউ জানে না। কপোতী যেরূপ আপন শাবকটিকে অতি যত্নে কুলায় লুকাইয়া রাখে, বালিকা এই নূতন ভাবনাটিকে অতি সঙ্গোপনে হৃদয়ের অভ্যন্তরে লুকাইয়া রাখিত। বালিকা নিজেও সে ভাবটি ঠিক বুঝিতে পারিত না, না বুঝিয়াও সে প্রিয় ভাবটি সযত্নে জগতের নিকট হইতে সঙ্গোপন করিত। বৃদ্ধ নবকুমার হেমকে এখনও বালিকা মনে করিতেন, সেই বালিকার উদার সরল মুখখানি দেখিলে কেনই বা মনে না করিবেন? বিবাহ দিলে একমাত্র কন্যা পরের হইবে, এই ভয়ে যতদিন পারিলেন, বিবাহ না দিয়া রাখিলেন। শ্রীশচন্দ্রও হেমের হৃদয়ের পরিচয় পাইল না, কিরূপেই বা পাইবে? হেম তাহার সহিত সর্বদাই সরল-হৃদয়ে নিঃসংকোচে কথা কহিত। শ্রীশচন্দ্রের নিকট প্রত্যহ কিছু কিছু পড়িতে শিখিত, পাঠ বলিয়া যাইত, পড়া হইলে পড়া দিত, যত্নের সহিত শ্রীশচন্দ্রের উপদেশবাক্য গ্রহণ করিত। নরেন্দ্র পড়াইতে আসিলে বালিকা মনঃস্থির করিতে পারিত না, নরেন্দ্র পড়া লইতে আসিলে বালিকা ভাল করিয়া বলিতে পারিত না, সমস্ত ভুল যাইত। সংসার-কার্যের তাবৎ ঘটনাই যেন শ্রীশচন্দ্রের নিকট বলিত, শ্রীশের উপদেশ ভিন্ন কোন কার্য করিত না। নরেন্দ্র উপদেশদাতা নহেন, নরেন্দ্র আসিলে অন্য কথা হইত অথবা অনেক সময় কথা হইত না; সুতরাং শ্রীশ মনে করিত যে, বালিকার হৃদয়ে যেটুকু প্রণয় বা স্নেহ আছে তাহা শ্রীশকেই অবলম্বন করিয়াছে। ॥ পাঁচ॥ এইরূপে কিছুকাল অতিবাহিত হইল। একদিন সায়ংকালে শ্রীশ ও নরেন্দ্র একখানি নৌকায় আরোহণ করিয়া গঙ্গায় বিচরণ করিতেছিল। নরেন্দ্র আপন বলপ্রকাশ অভিলাষে দাঁড়ীকে উঠাইয়া দিয়া দুই হাতে দুইটি দাঁড় ধারণ করিয়া নৌকা চালাইতেছে, শ্রীশ স্থিরভাবে বসিয়া প্রকৃতির সায়ংকালীন শোভা দর্শন করিতেছিল। শ্রীশ ও নরেন্দ্রের মধ্যে কখনই যথার্থ প্রণয় ছিল না, অল্প অল্প কথা লইয়া তর্ক হইতে লাগিল। নরেন্দ্রের হস্ত হইতে সহসা একটি দাঁড় স্খলিত হওয়াতে নরেন্দ্র পড়িয়া গেল, শ্রীশ উচ্চহাক্ত হাসিয়া বলিল, “যাহার কাজ, তাহাকে দাও বীরত্বে আবশ্যক নাই।” সেই সময়ে তীরস্থ অট্টালিকা হইতে হেমলতা দেখিতেছিল, হেমলতার সম্মুখে অপদস্থ হইয়া নরেন্দ্র মর্মান্তিক কষ্ট পাইয়াছিল, তাহার উপর শ্রীশের রহস্যকথা সহ্য হইল (অংশবিশেষ) রমেশচন্দ্র দত্ত (১৩ আগস্ট ১৮৪৮ - ৩০ নভেম্বর ১৯০৯) একজন বাঙালি ইতিহাসবিদ ও সাহিত্যিক ছিলেন। তিনি বঙ্কিমচন্দ্রের অনুরোধে বাংলা উপন্যাস রচনায় অগ্রসর হন এবং বিশেষ সাফল্য অর্জন করেন।১৮৯৯ সালে রমেশ চন্দ্র দত্ত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন। প্রাথমিক জীবন রমেশচন্দ্র দত্ত একটি বিশিষ্ট বাঙালি কায়স্থ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবারের প্রায় সবাই ছিলেন উচ্চশিক্ষিত। বাবা ঈশানচন্দ্র দত্ত এবং মা থাকোমণি দেবী। তার বাবা ঈশানচন্দ্র তৎকালীন বাংলার ডেপুটি কালেক্টর ছিলেন। অফিস চলাকালে রমেশচন্দ্র দত্ত তার সঙ্গে থাকতেন। রমেশচন্দ্র বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। তিনি কুষ্টিয়ার কুমারখালী মথুরানাথ মাধ্যমিক বিদ্যালয়েও পড়াশুনা করেছেন। এছাড়াও তিনি ডেভিড হেয়ার প্রতিষ্ঠিত হেয়ার স্কুল থেকে পড়াশোনা করেন। নৌকা দূর্ঘটনায় তার বাবার আকস্মিক মৃত্যুর পর ১৮৬১ সালে তার কাকা শশীচন্দ্র দত্ত, যিনি একজন প্রখ্যাত লেখক ছিলেন, তার অভিভাবকত্ত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। রমেশচন্দ্র তার কাকা সম্পর্কে লিখেছেন যে রাতের বেলা তিনি পরিবারের অন্যান্যদের সাথে বসতেন এবং তাদের প্রিয় বিষয় ছিল ইংরেজি কবিদের কবিতা চর্চা করা। রমেশচন্দ্র ১৮৬৪ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পড়াশোনা শুরু করেন। সেখানে তার সহপাঠী ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরে ১৮৬৬ সালে তিনি মেধাতালিকায় দ্বিতীয় স্থান অর্জনের মাধ্যমে এবং স্কলারশীপ অর্জনের মাধ্যমে আর্টস পরীক্ষায় পাস করেন। ১৮৬৮ সালে বিএ ক্লাসের ছাত্র থাকা অবস্থায় পরিবারের অনুমতি না নিয়ে তিনি এবং তার দুই বন্ধু বিহারীলাল গুপ্ত এবং সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান। রমেশ চন্দ্র সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর এর কৃতিত্বকে ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। সে সময় দীর্ঘ সময় ধরে ১৮৫৩ সালের আগে ও পরে, যখন ইংল্যান্ডে আইসিএস পরীক্ষা চালু করা হয়, তার পূর্বে মূলত বিট্রিশ কর্মকর্তারাই গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদগুলোতে নিয়োগপ্রাপ্ত হতেন৷। ১৮৬০ সালের দিকে ভারতীয়রা, বিশেষ করে বাঙালি বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের লোকজন হতে ভারতীয় উপমহাদেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদগুলোতে আসীন হতে শুরু করেন। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন এ রমেশ ব্রিটিশ লেখকদের নিয়ে পড়াশোনা করেন৷ তিনি লন্ডনের মিডল ট্যাম্পল এ আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন। তিনি ১৮৬৯ সালের ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস এর ওপেন এক্সামিনেশন এ তৃতীয় স্থান [৩] লাভের মাধ্যমে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। সিভিল সার্ভিস ১৮৭১ সালে রমেশ চন্দ্র দত্ত আলীপুরের সহকারী ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে আইসিএস(ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস) এ যোগদান করেন। পদটিতে তার নিয়োগ ১৮৫৮ সালের ১লা নভেম্বর রাণী ভিক্টোরিয়ার রঙ ও ধর্মমত নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রতি সমান সুযোগের ঘোষণার প্রতি সমর্থন প্রকাশ করে। ভয়ঙ্কর সাইক্লোনের কারণে ১৮৭৪ সালে নদীয়া জেলার মেহেরপুরে এবং ১৮৭৬ সালে ভোলা জেলার দক্ষিণ শাহবাজপুরে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এলাকাগুলোতে জরুরী ত্রাণ বিতরণ ব্যবস্থা এবং দুর্যোগ পরবর্তী বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া একান্ত অপরিহার্য হয়ে পড়ে। রমেশচন্দ্রের তত্ত্বাবধানে এ কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়। ১৮৮২ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে রমেশ চন্দ্রকে সার্ভিসের নির্বাহী শাখায় নিয়োগ দেয়া হয়। তিনিই প্রথম ভারতীয়, যাকে নির্বাহী পদে নিয়োগ প্রদান করা হয়। ১৮৯৩ সালে তিনি বর্ধমান জেলার জেলা অফিসার এবং ১৮৯৪ সালে বর্ধমান বিভাগের কমিশনার হন। রমেশচন্দ্র ১৮৯৫ সালে উড়িষ্যার বিভাগীয় কমিশনারের দায়িত্ব লাভ করেন৷ ভারতীয়দের মধ্যে তিনিই প্রথম ভারতীয়, যিনি বিভাগীয় কমিশনার পদে আসীন হন। রাজনীতি রমেশচন্দ্র নরমপন্থী জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন৷ কংগ্রেসের শুরুর দিকে তিনি কংগ্রেসের সাথে জড়িত ছিলেন। ১৮৯৯ সালে তিনি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস এর প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সাহিত্যে অবদান ১৮৯৪ সালে রমেশচন্দ্র বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের প্রথম সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন৷ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং নবীনচন্দ্র সেন পরিষদটির সহ-সভাপতি ছিলেন।[৫] বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৮৯৩ সালে পরিষদটি গঠন করা হয়। সূদীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি অনেকগুলো বই লিখেছেন। এছাড়াও তিনি মহাভারত ও রামায়ণ অনুবাদও করেছেন। গুণী এ মনীষী ১৯০৯ সালের ৩০এ নভেম্বর মারা যান। রমেশচন্দ্র দত্তের রচনাতালিকা রমেশচন্দ্রের চারটি ঐতিহাসিক উপন্যাস বঙ্গবিজেতা (১৮৭৪), মাধবীকঙ্কণ (১৮৭৭), জীবন-প্রভাত (১৮৭৮) এবং জীবন-সন্ধ্যা (১৮৭৯) যথাক্রমে আকবর, শাজাহান এবং আওরঙ্গজেব এবং জাহাঙ্গীরের সময়ের ঘটনা অবলম্বনে রচিত হয়েছিল। মুঘল সাম্রাজ্যের শতবর্ষের ইতিহাসের ঘটনা নিয়ে এই উপন্যাসগুলি রচিত হয়েছিল বলে এগুলি একসাথে শতবর্ষ (১৮৭৯) নামে সঙ্কলিত হয়েছিল। সংসার (১৮৮৬) এবং সমাজ (১৮৯৩) রমেশচন্দ্রের দুটি সামাজিক উপন্যাস । সুকুমার সেনের মতে এই দুটি সামাজিক উপন্যাস তার ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলির থেকে উপাদেয় ছিল। উপন্যাস • বঙ্গবিজেতা (১৮৭৪) • মাধবীকঙ্কণ (১৮৭৭) • মহারাষ্ট্র জীবন-প্রভাত (১৮৭৮) • রাজপুত জীবন-সন্ধ্যা (১৮৭৯) • সংসার (১৮৮৬) • সমাজ (১৮৯৪) • শতবর্ষ, (বঙ্গবিজেতা, রাজপুত জীবন-সন্ধ্যা, মাধবীকঙ্কণ ও মহারাষ্ট্র জীবন-প্রভাত একত্রে, ১৮৭৯) • সংসার কথা – (সংসার উপন্যাসের পরিবর্তিত সংস্করণ, ১৯১০) মৃত্যু রমেশচন্দ্র দত্ত ৩০ নভেম্বর ১৯০৯ তারিখে বরোদায় মৃত্যুবরণ করেন।






«
Next
Newer Post
»
Previous
Older Post

No comments:

Leave a Reply