মেহেরপুরের সাহিত্য:সৈকত রুশদী (৫ নভেম্বর ১৯৫৯): লেখক, কবি,রাজনৈতিক বিশ্লেষক, ও সাংবাদিক মুজিবনগর স্মৃতিসৌধে অনিন্দ্য ও মৌ -সৈকত রুশদী বাথটাবে সুবাসিত ফেনায় ঢাকা ঈষদুষ্ণ পানিতে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে শুয়ে ছিল অনিন্দ্য। সহনীয় মাত্রার উষ্ণ পানির ওম নিতে নিতে উপভোগ করছিল তার এই বিলাসিতার স্বাদটুকু। নগ্ন শরীরে প্রতিটি রোমকুপের গোড়ায় পৌছে যায় উষ্ণতা। এক সুখদ অনুভূতি ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে শরীরের প্রতিটি তন্ত্রীতে। বাথটাবের একপ্রান্তে মাথা রেখে চোখ বুজে থাকে সে। নিশ্চপ, নিশ্চল। যেন প্রায় ঘুমিয়ে পড়ার আগের মুহূর্তে শুনতে পায় বাইরে, দূরে কোথাও বাজছে কলিং বেলের সুরেলা ধ্বনি। উঠে পড়ে বাথটাব থেকে। শ্যাম্পু করা চুল, মাথা, সর্বাঙ্গ ভাল করে ধুয়ে নেয় শাওয়ারে। ঝরঝরে বোধ হয় শরীরটা। বাথরোব গায়ে জড়িয়ে নিয়ে সাবধানে মেঝেতে পা রাখে অনিন্দ্য। তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসে। ড্রেসিং রুমে পাজামার মধ্যে পা গলানোর সময় চোখ পড়ে বেডরুমের ফ্লাওয়ার ভাসটার প্রতি। প্রতিদিনের শূন্য ভাসটা আজ ভরে আছে এক গুচ্ছ রজনীগন্ধা, আর কিছু লাল গাডিওলাসে। ফুলের সুবাস মৌ মৌ করছে গোটা ঘর জুড়ে। এক রমণীয় আবহ দেখে মনে হচ্ছে, কেউ এসেছে অনিন্দ্যর কাছে। কাপড় পরে দ্রæত চুল আঁচড়ে নেয় অনিন্দ্য। আফটার শেভ লোশন ও ডিওডোরান্ট মাখতে মাখতে ভাবে শুক্রবার সকালে বিনা নোটিশে কে আসতে পারে এই অবিবাহিত, বিপজ্জনক যুবকের শয়ন কক্ষে? সাহসী নমিতা, নাকি কাজিন সোনালি? হঠাৎ মনে হয়, মৌ নয়তো! লিভিং রুমে ঢুকে রকিং চেয়ারে বসে দোল খেতে থাকা মৌ-কে দেখেও নিজের চোখকে বিশ্বাস হয় না অনিন্দ্যর। ওয়াও! হোয়াট আ সারপ্রাইজ!' কোন উত্তর না দিয়ে মিটি মিটি হাসতে থাকে মৌ। ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে এসে বিশাল জানালার ভারি পর্দাগুলো সরিয়ে দেয় অনিন্দ্য। চৈত্রের প্রভাতী রোদ ঝাপিয়ে পড়ে সারা ঘর জুড়ে। শাদা জমিনে বেগুনী স্ট্রাইপ শাড়িতে মৌ-কে অদ্ভুত স্নিগ্ধ দেখায়। লেজ উঁচিয়ে ছুটে পালানো নয়োম তুলতুলে কাঠবিড়ালী দেখলেই যেমন ধরে আদর করতে ইচ্ছে করে, আজ মৌ-কে দেখে অনিন্দ্যের সেরকম ইচ্ছে জেগে ওঠে। কী ব্যাপার জনাব? সকাল বেলায় আপনার সাথে নাস্তা করবো বলে চলে এলাম, অথচ মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে!' মৌ বলতে থাকে, সাড়ে আটটায় এসেছি। আধ ঘণ্টার ওপর হলো। ভদ্রলোকের গোসল আর শেষ হয় না! অভিভূত অনিন্দ্য পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় মৌ-এর দিকে। ঘোর লাগা দৃষ্টিতে চোখে চোখ রেখে সামনে যেয়ে দাঁড়ায়। চেয়ারের হাতলে দুই হাত রেখে ঠোট নামিয়ে আনে। প্রথমে ঠোট সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলেও, গভীর চুম্বনের মোহনীয় আবেশের মধ্যেই অনিন্দ্য অনুভব করে চোখ বন্ধ করে মৌ দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে আছে তার মাথা, কাঁধ। কতোক্ষণ এভাবে কেটেছে জানে না অনিন্দ্য। পরস্পরের ঠোট বিচ্ছিন্ন হলেও দাঁড়িয়ে পড়া মৌ-কে গভীর আলিঙ্গনে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে অনিন্দ্য। মৌ-এর নরোম শরীরের উষ্ণতা সঞ্চারিত হয় অনিন্দ্যর পা থেকে মাথা পর্যন্ত । এক পা পিছিয়ে এসে মৌ-কে আবার দেখে । ধরে রাখে তার একটা হাত। অনিন্দ্য ধীরে, কিন্তু স্পষ্ট উচ্চারণে বলে, ‘আই লাভ ইউ, মৌ!' অনিন্দ্যের কাঁধে হাত রেখে, উঁচু হয়ে টুক করে ঠোটে একটা চুমু খায় মৌ। নিজে থেকে এই প্রথম! আমিও অনি!' প্রায় শোনা যায় না স্বরে ফিসফিস করে বলে । নাস্তার পর ডাইনিং টেবিলে বসে কফি খেতে খেতে কথা বলছে মৌ। মনোযোগী শ্রোতা হয়ে, প্রাণবন্ত উচ্ছল তরুণীতে রূপান্তরিত মৌ-কে এক দৃষ্টিতে দেখছিল অনিন্দ্য। মৌ-এর অবয়ব থেকে শিক্ষিকাসুলভ গাম্ভীর্য সম্পূর্ণ উধাও। খুশী খুশী ভঙ্গিতে বলে, আমি কিন্তু তোমার বাসায় আগেও দু’বার এসেছি। এবারই প্রথম নয়। কিন্তু তুমি এমন করছো, যেন পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য দেখছো!' নাহ। অষ্টম নয়। একমাত্র আশ্চর্য! এর আগে তুমি এসেছো একবার ফরমাল ডিনারে। আর একবার আমাকে রোগী হিসেবে দেখতে ....।' অনিন্দ্য ব্যাখ্যা করে। ‘আচ্ছা! তোমার জন্য আরও সারপ্রাইজ আছে।' বলে মৌ তার চামড়ার ব্যাগ থেকে একটি হালকা নীল রঙের খাম বের করে। এই যে, বিয়ের কার্ড। তোমাকে। আনুষ্ঠানিক নিমন্ত্রণ! বুকের ভেতরটা খচ্ করে ওঠে অনিন্দ্যের। বিয়ের কার্ড! কার? মৌ-এর নয়তো! আর ভাবতে পারে না সে। মৌ কার্ডটা হাতে দেয়। ওপরে অনিন্দ্যের নাম লেখা । না খুলেই খামটা আস্তে করে রেখে দেয় টেবিলে। তাকায় মৌ-এর দিকে। অস্ফুট কণ্ঠে বলে, 'কার বিয়ে? “ওমা! তোমাকে বলিনি? অজন্তার।' মৌ আরও কিছু বলে যেতে থাকে। অনিন্দ্যর কানে ঢোকে না। বুকের ওপর থেকে মনে হয় একটা বিশাল ভার নেমে যায়। বন্ধ হয়ে আসা শ্বাস-প্রশ্বাস আবার স্বাভাবিক হতে থাকে। শুনতে পায়, ‘মা তো একটুও রাজি নন। আমিই জোর করে রাজি করিয়েছি।' ‘কেন? ছেলে কী করে?' যেন কিছুই হয়নি এমন প্রায় স্বাভাবিক ভঙ্গীতে প্রশ্ন করে অনিন্দ্য। অথচ বিয়েটা মৌ-এর ভেবে চকিত আঘাতে যেভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল, নিজের মনের সাথে প্রাণপণ যুদ্ধ করেও ততোটা স্বাভাবিক হতে পারে না। জানালার দিকে পেছন ফিরে বসা অনিন্দের চেহারা বা কণ্ঠের পরিবর্তন ধরতে পারে উৎফুল্ল মৌ। তার উচ্ছসিত আনন্দে উদ্ভাসিত উজ্জল অবয়বের দিকে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে অনিন্দ্য। ‘নাহ্! ছেলে নিয়ে কোন সমস্যা নয়। সে এই ঢাকা ইউনিভার্সিটিরই টিচার। পাবলিক এ্যাডমিনিস্ট্রশন ডিপার্টমেন্টে। লেকচারার । দুই বছর আগে জয়েন করেছে। এখন একটা স্কলারশীপ নিয়ে অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছে । মেলবোর্ন ভার্সিটি-তে এমএস, লিডিং টু পিএইচডি। আগেই পছন্দ করে রেখেছিল । অজন্তার মাস্টার্স ডিগ্রী পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা করছিল । কিন্তু তার আরও তিনমাস দেরি। অথচ ছেলেটার সেশন শুরু হবে আর চার সপ্তাহের মধ্যেই। সেজন্যই তাড়াহুপড়ো করে বিয়ে আগামী শুক্রবার!' “শিক্ষক-ছাত্রী পরিণয়?' স্বভাবসুলভ রসিকতার মধ্য দিয়ে স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করে অনিন্দ্য। কফি শেষ করে মৌ বলে, তোমার খালি ঐসব চিন্তা! অজন্তা একই ডিপার্টমেন্টের হলেও আবরার, মানে ঐ ছেলেটার সরাসরি ছাত্রী নয়।' ‘তো মায়ের আপত্তি ছিল কেন?' ‘সমস্যাটা তো আমি!' বলেই কথার স্বাভাবিক গতি হারিয়ে ফেলে মৌ। বড় বোনকে রেখে ছোট বোনের বিয়ে আগে হবে, আমার মা এখনও তা ভাবতে পারেন না। ধীরে ধীরে কথা শেষ করে। শেষ দিকে ভারী হয়ে ওঠে তার কণ্ঠস্বর । প্রসঙ্গ বদলানোর জন্যই বোধ করি অনিন্দ্য উঠে পড়ে। বলে, 'চলো বারান্দায় যেয়ে বসি।'
দক্ষিণ দিকের খোলা বারান্দায় ফুলের টবের সারির পাশে প্রশস্ত দোলনায় বসে মৌ। রেলিংয়ে হেলান দিয়ে মুখােমুখি দাড়ায় অনিন্দ্য। ‘জানো, আমি এই দিন দশেক আগে পর্যন্ত কিছুই জানতাম না। অথচ আমি কলা ভবনের নিচ তলার ইতিহাস বিভাগে, আর ওরা চার তলায়। স্বাভাবিক কণ্ঠে মৌ বলে যেতে থাকে। আবরারের মা ও খালা এসে আমার মায়ের কাছে প্রপোজ করেছিল প্রথমে। মা সরাসরি নাকচ করে দিয়েছিলেন। পরে আবরার আমার ডিপার্টমেন্টে এসে দেখা করে সব খুলে বলেছে। বলছিল, আপনি পারমিশন দিলেই মা রাজি হয়ে যাবেন। তুমি কী বললে? ‘আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, দেখি কী করা যায়। বাসায় গিয়ে অজন্তাকে এসব নিয়ে প্রশ্ন করতেই সে কেঁদে কেঁটে একাকার। শেষে মা-কে বলে কয়ে আমিই রাজি করালাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে বিয়ের অনুষ্ঠানের বুকিং দেয়া থেকে শুরু করে ....!' ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আঁতকে ওঠে মৌ, এ্যাই, এগারোটা বাজে প্রায়। আমাকে যেতে হবে এখনই। অ-নে-ক কাজ।' অনিন্দ্য বিস্মিত হয়, তুমি এখনই যাবে? আমার সকল আনন্দ মাটি করে দিয়ে!' “জ্বী! আয়নায় গিয়ে দেখো একবার!' লাজুক হেসে মৌ বলে, 'আর শোন শমীকের জন্য এই কার্ডটা কী তোমার কাছে দিয়ে যাবো, নাকি ওর অফিসে পাঠাবো?' মৌ-এর কথায় অপ্রস্তুত হয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। পাঞ্জাবীর কাঁধের কাছে রঞ্জিত খানিকটা! পাশে এসে দাড়িয়ে হাসতে থাকে মৌ। কার্ড নিয়ে অনিন্দ্য বলে, ‘আহা বেচারা শমীক । অজন্তার বিয়ের খবর শুনলে হার্টফেল করতে পারে! ‘কেন?' মৌ সত্যিই অবাক হয়, অজন্তার প্রতি আগ্রহ ছিল নাকি তার?' ‘চেনা-জানা সুন্দরী কোন তরুণীর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে শুনলে ইয়াং ছেলেরা বুকের মধ্যে একটা ধাক্কা খায়। আগ্রহ প্রকাশ করুক, আর নাইই করুক, মনে হয় বুকের মধ্যে একটুখানি জায়গা শূন্য হয়ে গেল। কেন, মেয়েদের সেরকম হয় না বুঝি?' হাসে অনিন্দ্য। হাঁটতে হাঁটতে ঘরের অন্য প্রান্তে যেয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। অন্যদের কথা জানি না। নিজে সেরকম কিছু বোধ করিনি কখনও।' মৌ অনিন্দ্যর হাত দুটো ধরে বলে, আমার জন্য তো তুমিই। আর কেউ নয়!' আনন্দে লাফ দিয়ে উঠতে ইচ্ছে করে অনিন্দ্যর। কিন্তু সতর্কতার সাথে বলে, সত্যি? অন্তর থেকে, মনের কথা বলছো তো!' বিষাদের ছায়া পড়ে মৌ-এর চেহারায়। সেটাই তো ভেবে রেখেছি। কিন্তু, ভয় হয়। তাই বলিনি এতোদিন। বেডসাইড সোফায় বসে মৌ বলে, আমার যে অনেক দায়িত্ব! তুমি তো জানো, আমি বিয়ে করলে মা-কে দেখবে কে? একলা হয়ে পড়বেন। আর ইউনিভার্সিটি'র কোয়ার্টারটাও তো ছেড়ে দিতে হবে তখন। মা থাকবেনই বা কোথায়? আমার ছোট ভাইটা, আকর বুয়েট থেকে বেরোবে আগামী বছর। চাকুরী পেলে তারপর বাসা। এদিকে আমার লন্ডনে পিএইচডি‘র স্কলারশীপটা কনফার্ম হয়ে আছে। টার্ম শুরু হবে সেপ্টেম্বরে!' কিছুটা আত্মগতভাবেই বলে মৌ। এগিয়ে এসে কাঁধে হাত রাখে অনিন্দ্য। আঙ্গুলগুলো মুঠো করে ধরে মৌ। এসব কোন ব্যাপারই নয়। সব সমস্যার সমাধান করে ফেলবো দু'জনে মিলে। শুধু তুমি রাজি থাকলেই হলো। অনিন্দ্য বলে। উঠে পড়ে মৌ। চুল, প্রসাধন ঠিক করে নেয়। ঠোট রঞ্জিত করার আগে, এগিয়ে এসে অনিন্দ্যর ঠোটে আরেকটা উপহার এঁকে দেয়। অনিন্দ্য ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। ইউসুফকে গাড়ি বের করতে বলে। বিদায় মুহূর্তে মৌ কাছে এসে বলে, তুমি আগামী শুক্রবার অন্য কোন প্রোগ্রাম রাখবে না। অবশ্যই অজন্তার বিয়েতে যাবে।' এসব কথায় কান না দিয়ে চিন্তিত কণ্ঠে অনিন্দ্য বলে, ‘মৌ, মা রাজি হবেন তো? তোমার বিয়ে? আমাকে!' ‘বুদ্ধ।' গাড়িতে ওঠার আগে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে মৌ বলে, মা বলে দিয়েছেন, অজন্তার বিয়েতে তুমি যেন অবশ্যই উপস্থিত থাকো। সত্যি সত্যিই বোকা বনে যায় অনিন্দ্য! ভারতীয় বর্ষীয়ান আলোকচিত্র-সাংবাদিক অনিলবরণ, আর শমীক ঘুরে ঘুরে ছবি তুলছিল মুজিবনগর স্মৃতিসৌধের। মেহেরপুর শহর থেকে দশ কিলোমিটার দক্ষিণপশ্চিমে বৈদ্যনাথতলা আম্র কাননে এই স্মৃতিসৌধ। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের শপথ নেয়ার স্মৃতি বিজড়িত এই স্থানটি পড়ে ছিল অবহেলা, অনাদরে। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী আওয়ামী লীগ সরকার, অথবা পরবর্তী কোন সরকার কোন উদ্যোগ নেয়নি এই ইতিহাস সৃষ্টিকারী স্থানটি সংরক্ষণের। কেবল একটি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল স্বাধীনতার পর । যাকে রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত রেখে অকুতোভয় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়েছিল, সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানও এখানে আসেননি কখনও। নির্বাচিত বিএনপি সরকারকে উৎখাত করে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সামরিক আইন জারির মাধ্যমে ক্ষমতা দখলকারী লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের উদ্যোগে নির্মিত হয়েছে এই স্মৃতিসৌধ। গণতন্ত্র হরণকারী এরশাদ ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে বিতর্কিত নির্বাচন অনুষ্ঠান করে যেমন ছদ্ম-গণতন্ত্র উপহার দিয়েছেন, তেমনি যেন জাতীয় স্মৃতিসৌধ ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যেতে না পারার গ্লানি ঢাকতে নির্মাণ করেছেন এই মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ। পাকিস্তানী শাসকদের তেইশ বছরের নিষ্পেষণ ও শোষণের বিরুদ্ধে ধাপে ধাপে গড়ে ওঠা প্রতিবাদের প্রতীক, ছোট থেকে বড়ো হয়ে ওঠা তেইশটি স্তম্ভ। প্রায় এক হাজার আম গাছের জ্যামিতিক সারির মধ্যে পূর্বদিক কেন্দ্র করে উপবৃত্তাকার এই স্মৃতিসৌধ হয়ে আছে বাঙালি জাতির এক অফুরন্ত অনুপ্রেরণার উৎস। প্রায় দশটা বাজে। সকাল থেকে একটানা ছবি তোলার পর বিরতি দেন ষাটোর্ধ্ব অনিলবরণ। শমীক আরও ছবি তুলতে থাকে নানা অবস্থান থেকে, সময় নিয়ে। অনিন্দ্যের কাজ ছিল স্মৃতিসৌধটাকে ফাঁকা রাখা। কিছু শিশু ও কিশোর-কিশোরী বারবার দৌড়ে উঠতে যায়, আর অনিন্দ্য তাদের থামায়।। রুমালে ঘাস মুছতে মুছতে অনিলবরণ বলেন, ‘জানেন, আমি ভাবিনি যে আমার জীবদ্দশায় এখানে আসতে পারবো। একাত্তরের ১০ এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠন ঘোষণা দেয়ার পর হঠাৎ করেই যখন এই মুক্তাঞ্চল বেছে নেয়া হয় ১৭ এপ্রিল শপথ অনুষ্ঠানের জন্য, তখন আমি কলকাতায় ছিলুম না। অফিসের কাজে বাইরে ছিলুম। অনিন্দ্য জানতে চায়, ‘প্রবাসী সরকারের লোকজনের সাথে আপনার যোগাযোগ ছিল?' ‘হ্যা। মিডিয়া দেখাশোনা করতো যে ছেলেটা, আমিনুল হক বাদশাহ তো কলকাতা প্রেসক্লাবে নিয়মিত আসতোই। ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন সাহেবের বিশেষ সহকারী, উনিও আসতেন মাঝে মধ্যে। আমি তাজউদ্দীন সাহেব ও কর্ণেল ওসমানী সাহেবের অফিসেও গিয়েছিলুম একবার ব্রিটিশ এক সাংবাদিককে সাথে নিয়ে। স্মৃতিচারণ করেন অনিলবরণ। ক্যামেরার স্ট্যান্ড, ব্যাগ গুছিয়ে শমীক এসে যোগ দেয় ওদের সাথে। অনিলবরণ বলেন, 'আমার খুব আফসোস হয়েছিল এই অনুষ্ঠান মিস করায়। আজ ছবি তুলে স্বস্তি পেলুম।' অনিন্দ্য ভাবিত হয়। পেশার প্রতি কতোটা নিষ্ঠা থাকলে একজন আলোকচিত্র সাংবাদিক দীর্ঘ আঠারো বছর প্রতীক্ষার পর একটি ঐতিহাসিক স্থানের ছবি তুলে পরিতৃপ্ত হন! শমীক বলে, এখান থেকে সীমান্ত নাকি মাত্র পাঁচশ' গজ দূরে? ঐ ছেলেরা বলছিল। ‘আর পলাশী কতো দূরে জানেন? এখান থেকে বড়ো জোর পঞ্চাশ কিলোমিটার। পলাশী আম্রকাননের অনেক ছবি আছে আমার।' বলেন অনিলবরণ। বিস্মিত অনিন্দ্য ভাবে, মাত্র পঞ্চাশ কিলোমিটারের ব্যবধানে পলাশী ও বৈদ্যনাথতলা মুজিবনগর। বাংলা, তথা গোটা ভারতবর্ষের ইতিহাস বদলে দেয়া দুটি ঘটনা ঘটেছে। ১৯০ বছরের ব্যবধানে। দু'টি আম্রকাননে। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল পলাশীতে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন। আর বাংলাদেশের স্বাধীনতার নতুন সূর্যোদয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়েছে এই মুজিবনগরে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল। গাড়িতে ওঠার আগের মুহূর্তে অনিন্দ্য লক্ষ্য করে, শমীক একজন প্রৌঢ়ের ছবি তুলছে। আলাদা করে। যতেœর সাথে। এগিয়ে যায় অনিন্দ্য। শুনতে পায়, প্রৌঢ় বলছেন, 'আমি তো তখন কলেজের ছাত্র। বাড়ি এসে বসে আছি। ভাবছি কী ভাবে যুদ্ধে যোগ দেবো। সেসময় এই শপথ অনুষ্ঠান । আমাদের এসডিও তৌফিক এলাহী চৌধুরী সাহেব খবর দিয়েছিলেন শপথ অনুষ্ঠানের চেয়ার টেবিল যোগাড় রাখতে। আমরাই সব ব্যবস্থা করলাম। এখানকারই কয়েকজন পুলিশ ও আনসার গার্ড অব অনার দিল নতুন উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক কর্ণেল ওসমানীকে। ‘গার্ড অব অনার দেয়া কেউ আছেন এই গ্রামের?' শমীক জানতে চায়। অদূরে চায়ের দোকানে বসে থাকা আরেকজনকে দেখিয়ে প্রৌঢ় বলেন, “ঐ যে নজরুল ভাই । গার্ড অব অনারে উনি ছিলেন। আর আমি কয়েকজনের সাথে মিলে ‘আমার সোনার বাংলা গানটা গেয়েছিলাম। সুরটা মেলেনি। তবু চেষ্টা করেছিলাম। সলজ্জ ভঙ্গীতে হাসেন। নজরুল সাহেবের ছবি তুলতে যেয়ে ব্যর্থ হয় শমীক। তিনি বলেন, ছবি তুলে কী হবে? দেশ স্বাধীন করলাম শান্তির জন্য। গণতন্ত্রের জন্য। কী পেয়েছি আমরা?' ক্ষোভে ফেটে পড়েন নজরুল, দুই বেলা দু'মুঠো ভাত জুটছে কীনা সবার, সেদিকে খেয়াল আছে কারও? না পেয়েছি গণতন্ত্র, না সম্মান? উত্তর খুঁজে পায় না শমীক, অনিন্দ্য। আম্রকাননের ঘন সবুজের মাঝে ঝকঝকে স্মৃতিসৌধের সামনেই পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তারা। নীরবে । নিরুত্তর। লেখাটি সৈকত রুশদী রচিত রাজনৈতিক উপন্যাস ‘অচিন পাখি’-এ শেষ অধ্যায়ে ( প্রথম প্রকাশ ২০০২) প্রকাশ পেয়েছে । সৈকত রুশদী (৫ নভেম্বর ১৯৫৯):লেখক, কবি,রাজনৈতিক বিশ্লেষক, ও সাংবাদিক। কানাডা প্রবাসী বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সাংবাদিক, সম্পাদক এবং বেতার ও টেলিভিশন ভাষ্যকার লেখক ও কবি সৈকত রুশদী মেহেরপুরের কৃতী সন্তান। তাঁর প্রকাশনার মধ্যে রয়েছে: অমর একুশে, বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের উপরে সংকলন (লন্ডন, ১৯৮৪, সম্পাদক); হল্ট গ্রিনহাউজ, পরিবেশ বিষয়ক সংকলন (ঢাকা, ১৯৯১, সম্পাদক, বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া সহ); ও ;অচিন পাখি, উপন্যাস (ঢাকা, ২০০২ ও ২০২০)। কাঠের কাজ: শহীদ মিনার, বাংলাদেশ সেন্টার (লন্ডন, ১৯৮৪)। পুরস্কারে ভূষিত এই লেখক ও কবি, বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের লন্ডনস্থ সদর দফতরে সম্প্রচারক হিসেবে কাজ করেছেন বছর দুয়েক (১৯৮৩ -১৯৮৬)। জন্ম বাংলাদেশের মেহেরপুরে, ৫ নভেম্বর ১৯৫৯ সালে। সেখানে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনের পর ঢাকার ইন্টারমিডিয়েট টেকনিক্যাল কলেজ থেকে ১৯৭৪ সালে এসএসসি এবং আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে ১৯৭৬ সালে এইচএসসি পাশ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে ১৯৮০ সালে সমাজবিজ্ঞানে সম্মানসহ স্নাতক এবং ১৯৮১ সালে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। সাংবাদিক হিসেবে তাঁর পেশাগত জীবন শুরু হয় ১৯৭৮ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রদায়ক হিসেবে। ১৯৯২ সাল পর্যন্ত তিনি তিনটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা (দৈনিক দেশ, দৈনিক খবর ও দ্য বাংলাদেশ টাইমস) এবং তিনটি সাপ্তাহিকীতে (বিচিত্রা, মতামত ও কলকাতা থেকে প্রকাশিত দেশ) কাজ করেন। বাংলাদেশে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও ব্রিটেনের দূতাবাসে তিনি রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জনবিষয়ক কর্মকর্তা হিসেবেও কাজ করেছেন (১৯৯২-২০০৩) । বর্তমানে তিনি কানাডায় সিশন নামের একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম পর্যবেক্ষণ প্রতিষ্ঠানে মূল্যায়ন সম্পাদক ও গণমাধ্যম বিশ্লেষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তিনি ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের নির্বাচিত যুগ্ম সম্পাদক (১৯৯১-১৯৯২) ছিলেন। বিবিসি ছাড়াও বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন, ভয়েস অব আমেরিকা, চ্যানেল আই, এটিএন কানাডা ও এক্সএম স্যাটেলাইট রেডিওসহ অসংখ্য গণমাধ্যমে সাংবাদিক ও সম্প্রচারক হিসেবে অবদান রেখেছেন। তিনি স্ত্রী গণমাধ্যম বিশ্লেষক ও কবি শিউলী জাহান রুশদী হক এবং একমাত্র সন্তান টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক উপল রুশদী হক সহ কানাডায় বসবাস করেন। সুত্র:গ্রেটার কুষ্টিয়া,Slider
দেশ - বিদেশ
মেহেরপুর জেলা খবর
মেহেরপুর সদর উপজেলা
গাংনী উপজেলা
মুজিবনগর উপজেলা
ফিচার
খেলা
যাবতীয়
ছবি
ফেসবুকে মুজিবনগর খবর
Home
»
Education
»
English News
»
Featured
»
pedia
»
politics
» মেহেরপুরের সাহিত্য :সাংবাদিক, কবি,রাজনৈতিক বিশ্লেষক -সৈকত রুশদী
Mujibnagar Khabor's Admin
We are.., This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
Labels
- Advertisemen
- Advertisement
- Advertisementvideos
- Arts
- Education
- English News
- English News Featured
- English News lid news
- English News national
- English News news
- English Newsn
- Entertainment
- Featured
- games
- id news
- l
- l national
- li
- lid news
- lid news English News
- lid news others
- media
- national
- others
- pedia
- photos
- politics
- politics English News
- t
- videos
- w
- world
- Zilla News
No comments: