Sponsor



Slider

বিশ্ব

জাতীয়

মেহেরপুর জেলা


গাংনী উপজেলা

মুজিবনগর উপজেলা

ফিচার

খেলা

মেহেরপুর সদর উপজেলা

ছবি

ফেসবুকে মুজিবনগর খবর

» » » » » » » মেহেরপুরের সাহিত্য: অ্যাডভোকেট হাফিজুর রহমান: আইনজীবী, আবৃত্তি শিল্পী, উপস্থাপক ও নাট্যশিল্পী




মেহেরপুরের সাহিত্য: অ্যাডভোকেট হাফিজুর রহমান: (৩ মে ১৯৩৭-১৯ আগস্ট ২০১৯)আইনজীবী,লেখক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, আবৃত্তি শিল্পী, উপস্থাপক ও নাট্যশিল্পী আমাদের সময়ের কথা -অ্যাডভোকেট হাফিজুর রহমান

বর্তমান সময়ে মেহেরপুরে শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে যে ক্রাইসিস, আমাদের সময়ে সেটা ছিল না। তখন আর্থিক সমস্যা সহ অন্যন্য প্রতিকূলতা সবই ছিল, কিন্তু তার মধ্যেও আমরা আমাদের কর্মকান্ড চালিয়ে গেছি। বছরে মিনিমাম ছয়-সাতটি নাটক আমরা মঞ্চায়ন করেছ। একটা মজার ঘটনা বলি: এ্যাডভোকেট মতিন সাহেবের আব্বা রহিম সাহেবদের খুব ভাল একটা নাট্যদল ছিল। তাদের সাথে আমাদের একটা প্রতিদ্বন্ধিতা সবসময়েই ছিল। উনারা যে নাটক করবেন, আমরাও সেটা করবো- উনারা যেদিন করবেন আমাদেরকেও সেদিন করতে হবে-এই ছিল মনোভাব। শিব নারায়ণ চক্রবর্তী, শ্রদ্ধেয় রহমান ফাট, মফিজুর রহমান-এরা আমাদের লীড করতেন। যা হোক সেবার হঠাৎ খবর পেলাম রহিম সাহেবরা আগামী পরশু সোনার বাংলা মঞ্চস্থ করবেন। শোনা মাত্রই আমাদের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। আমরা কালই করবো। স্থান: বালিকা বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। মঞ্চায়নের দিন ও অভিনেতাদের মাঝে চরিত্র বন্টন হয়নি-নানা কাজে সকলেই মহাব্যস্ত। দু‘তিনটা নারী চরিত্র আছে। সেগুলা কে করবে সেও এক দুর্ভবনার বিষয়। অবশ্য তখন ছেলেরাই নারী চরিত্রে অভিনয় করতাম। আর চিত্তবিনোদনের জন্য আজকের মতো নানাবিধ ব্যবস্থা ছিল না। আমাদের সেই যেন তেন প্রকার আয়োজনেই দর্শক যেন উপচে পড়তো। তখন সরাসরি মেহেরপুর কুষ্টিয়া বাস ছিল না। কুষ্টিয়া থেকে আসতে হলে চুয়াডাঙ্গা হয়ে আসতে হতো। আজকের যেখানে রূপালী ব্যাংক ওখানেই ছিল বাসস্টান্ড। সেদিন সন্ধ্যায় দেখি সাখাওয়াৎ বাসে ফিরছে। আমরা হৈ চৈ করে বাসস্টান্ডে দৌড় দিলাম। ওর সাথে টিনের সুটকেস-সম্ভবত: কলেজ থেকে ফিরছিল। আমাদের দেখে ব্যস্ত হয়ে শুধালো, ‘কি ব্যাপার?’ সব বললাম। ও বিপুল উৎসাহে আমাদের সঙ্গ নিল। ‘নে আমার সুটকেসটা রাখ আর বল, আমাকে কি করতে হবে।’ হাফিজ ভাই বললেন, ‘তুমি একটা ফিমেল চরিত্র করো।’ এ প্রস্তাবে সাখাওয়াতের তো আপত্তির প্রশ্নই ওঠে না। বললো, ‘বইটা দেন-সংলাপগুলো একটু দেখে নিই।’ তারপর মেকাপের সময় হলো সমস্যা। সাখাওয়াতের মুখে সপ্তাহখানেকের না কাটা দাড়ি। কী করা যায়? তখন তো আজকের মতো সেলুন ছিল না। নাপিতরা রাস্তার ধারে বসে কাজ সারতো; তাও দিনের আলোয়। সন্ধ্যার পরে কোন দোকানও খোলা নেই যে, বেলড কেনা যাবে।সাখাওয়াতের কথামত শেভ না করেই গৌরদা যখন মেকাপের রং চড়ালেন তখন আরো বিশ্রী অবস্থা। এরমধ্যে হেডমৌলভী সিদ্দীক সাহেবের দুই ছেলে হেলাল ও বাদল তাঁদের বাড়ি থেকে একটা নক কাটা ব্লেড যোগাড় করে আনলো। কিন্তু তা দিয়ে কি সেভ করা যায়? মেঝেতে ঘষে দাড়ি কাটবার সে এক প্রাণন্তকর প্রচেষ্টা। কোন রকমে অর্ধেকটা কাটা হয়েছে।। এমন সময়ে পুলিশী হস্তক্ষেপ: পার্মিশন ছাড় নাটক করা যাবে না। আমরা বুঝলাম এটা রহিম সাহেবের চক্রান্ত। তাঁদের পরামর্শে পুলিশের আগমন। সাখাওয়াৎ সেটা বলতেই, ‘তবে রে’ বলে হংকার দিয়ে উঠলো। সে যেন রহিম সাহেবের একটা কিছু করেই ছাড়বে। আমার যতই তাকে আটকানোর চেষ্টা করি। ততই তার তর্জন-গর্জন বেড়ে যায়। এখানে বলা উচিৎ যে, রহিম সাহেব ছিলেন সাখাওয়াতের ভগ্নিপতি। যাহোক, মুখে সেই অসমাপ্ত মেকাপ, অর্ধেক দাড়ি গোঁফ , পরনে শাড়ির মালকোঁচা, মাথায় মেয়েদের পরচুলা, হাতে হুড়কো-সব মিলিয়ে সে এক অদ্ভুত মূর্তি। শান্তি তো বলেই বসলো, ‘তোরা দেখ, এটাই হচ্ছে কালি মায়ের রণ-রঙ্গিণী রূপ। আর একদিনের কথা, এটাও অভিনয় সংক্রান্ত। আমি তখন বেতবাড়ি স্কুলে শিক্ষকতা করি। এ স্কুলের মাঠে যাত্রা প্যান্ডেলে আমরা যাচ্ছি ‘রাজা হরিশ চন্দ্র’ করার জন্য। পথে সাখাওয়াৎকে হঠাৎ পেয়ে গেলাম। সাধারণতঃ গ্রামাঞ্চলে যাত্রা শুরু হয় রাত ১২টা ১টার দিকে, কিন্তু আমরা ৯টায় শুরু করে ভয়ানক সমস্যায় পড়ে গেলাম। অভিনয় শেষ হলো রাত প্রায় দুইটার দিকে। দর্শক ক্ষেপে গেল। ভোর পর্য়ন্ত না চললে সে আবার কেমন নাটক? শালা-বানচোৎ গালাগালিতে মারমুখী হয়ে উঠলো আর হাতের লাঠি তো আছেই। আমার যত বলি,‘হরিশ চন্দ্রের মৃত্যুর দৃশ্যের মাধ্যমে নাটক শেষ হয়ে গেছে’-ততই ওদের সেই একই যুক্তি । ‘মরে যাবে কোথায়? আবার বাঁচাও। না হলে লাশ নিয়ে কান্নাকাটি চলুক।’ এ স্কুলের হেড মাস্টার ছিলেন এ্যাডভোকেট খালেদ সাহেব, তিনি অনুরোধ করতে গিয়ে অপদস্ত হলেন। অতঃপর সাখাওয়াৎ মঞ্চে গিয়ে মাউথপিচ হাতে নিলো। সে বললো, ঠিক আছে, আপনাদের দাবি আমরা মেনে নিলাম। নাটক ভোর পর্যন্ত চলবে। তবে মরে যাওয়া হরিশ চন্দ্রকে বাঁচাতে হলে কিছুটা সময় প্রয়োজন: সে পর্যন্ত আপনাদের চুপচাপ থাকতে হবে-হরিশ চন্দ্রকে বাঁচানোর চেষ্টা চলছে- সে জ্যান্ত হলেই আবার অভিনয় শুরু হবে।’ তার বলার ভঙ্গিতে দর্শকরা হেঁসে উঠলো এবং শান্ত হলো। পরে সেই ভোর পর্যন্ত কিছু বাছাই করা দৃশ্যের পূনর্বার অভিনয় করতে হয়েছিল। সাখাওয়াৎকে নিয়ে নাটক বিষয়ে শেষ স্মৃতি ১৯৮০ সালে। সেবার আমরা বিশেষ এক মহলের বিরোধিতার কারণে স্থান সংকটে ভুগছি। ইতিমধ্যে সাখাওয়াতের রাজনৈতিক জীবন ও আমার পেশাগত জীবন সেই সার্বক্ষণিক বন্ধুত্বের কিছুটা শৈথিল্য এনেছে-তবুও এ বিষয়ে সাখাওয়াৎ আমাদেরকে আন্তরিক ভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিল। সে তার মিসেসকে রাজী করিয়ে মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় মাঠে আমাদের প্যান্ডেল তৈরির ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। মনে আছে, আমন্ত্রণ গ্রহণ করে করে সাখাওয়াৎ সস্ত্রীক অভিনয় দেখতে এসেছিল। আমার ওদের দু‘জনের জন্য চা নাস্তার ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু সাখাওয়াৎ এতে খুবই মনক্ষুন্ন হয়ে বলেছিল, ‘দ্যাখ হাফিজ, আমি তোদের সহযোগিতা করেছি বন্ধুত্বের কারণে, বিশেষ অতিথি হয়ে চা নাস্তা খাওয়ার জন্য নয়। ১৯৫১ সালে আমি যখন মেহেরপুর উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হই তখন মুন্সি সাখাওয়াৎ হোসেনের সঙ্গে আমাদের পারস্পারিক পরিচয়। আমার এক শিক্ষকের কথা মনে পড়ে। তিনি বলতেন, ‘তোমরা যখন কোন স্কুল বা ইনষ্টিউশনে ভর্তি হও-তখন অনেক সহপাঠি থাকে কিন্তু বন্ধুত্ব হয় লিমিটেড কয়েকজনের সঙ্গে, তোমার চাইতে ভাল ছাত্রের ক্যালিবার, কার্যকলাপ ভালো-তার সঙ্গে বন্ধুত্ব হবে না; বন্ধুত্ব হবে ম্যাগনোটিক পাওয়ারের মতন সমমনাদের সঙ্গে।’-তো ১৯৫১ সালে এই আমরা ক‘জন সমমনা একত্রিত হয়েছিলাম। এরা হচ্ছে,সাখাওয়াৎ, শান্তি নারায়ণ চক্রবর্তী, আমি হাফিজুর রহমান, গোপাল চক্রবর্তী, আমাদের মাস্টারমশাই জীবন বাবুর ছেলে নিমু এবং সতীনাথ ঘোষণ বংকা।বংকা বয়সে আমাদের সকলের বড়,কিন্তু তার কার্যকলাপ, মন-মানসিকতা আমাদের এতো বেশি আকৃষ্ট করেছিল যে, সকলেই আমরা তার গুণমুগ্ধ ছিলাম। তার বাবা ছিল না, মা ও ভাই বোনরা থাকতেন ভারতে। বংকা মেহেরপুরে তার পৈত্রিক সম্পত্তি নির্ভর একাকী জীবন কাটাতো। নিজেই রান্না-বান্না করে খেত। পড়াশোনায় ততটা মনযোগ ছিল না-এ নিয়ে আমরা ঠাট্টা করতাম। বংকা ঘোষের একটা পিকিউলারিটি ছিল-এ নিয়ে সাখাওয়াৎ তাকে ইনিস্পিয়ার করতো; বাজার থেকে কখনও মাছ মাংস কিনলেও খাবার টেবিলে সেই পেয়াজ লংকা ছাড়া আর কিছু জুটতো না। ওর ভালো বাজার করবার খবর পেলেই টিফিনের সময় ভাগ বসাতে ছুটে যেতাম। কিন্তু যা হবার তাই; রান্না করতে করতে ওর সেসব খাওয়া হয়ে গেছে। সে সময় বিকেলে আমাদের সময় কাটাবার জায়গা ছিল গড়ের পুকুর পাড়। তখন মেহেরপুর এতা চাকচিক্য ছিল না, কিন্তু নির্মল আনন্দ ছিল। সে দিন বর্ষার পানিতে পুকুর টাইটুম্বর। আমার সন্ধ্যার পর পুকুর পাড়ে বসে গল্প করছি। বংকা-হ্যা, বংকাই তো। বংকা হঠাৎ প্রস্তাব দিল। ‘এই পুকুরে যে এখন লাফ দিয়ে সাঁতরাতে পাবে তার জন্য নগদ পাঁচ টাকা পুরষ্কার।’ সেই সময়ে পাঁচ টাকা কম কথা নয়। সাখাওয়াৎ আমাকে উসকে দিলো. ‘কেন ঝাঁপ মারা যাবে না?’এই হাফিজ, তুই ঝাঁপ মার-আমি টাকা জমা রাখছি।’ আমি নিশ্চিন্তে ঝাঁপ দিয়ে সেই অন্ধকারে সাঁতার কাটলাম।’ ১৯৫৪ সালে আমরা ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিচ্ছি। পরীক্ষা সেন্টার চুয়াডাঙ্গাতে। জীবন স্যার আমাদের গাইড। তখন ব্রীজ ছিল না। খেয়া পারের ব্যবস্থা ছিল। অন্য ছেলেরা উঠেছিল জীবন বাবুর ব্যবস্থামত ঘাট পাড়ের বাস অফিসের দোতলায়। কিন্তু জীবন বাবুর কাছে থাকলে ‘বই ছেড়ে মুখ তোলা যাবে না’-এই ক্ষোভে সাখাওয়াতের যুক্তি মত বংকা ও শান্তিসহ আমরা চার জন থানার সামনে রুম ভাড়া করলাম। সেটা যেন পরীক্ষা নয়, এক ধরণের এক্সারশন। পড়ার চেয়ে হৈ হুল্লোড়ই বেশি। যত সব উদ্ভট পরিকল্পনা সেটা যার মাথাতেই আসুক না কেন, বাস্তবায়নেই যেন আনন্দ। নদী সাঁতরিয়ে ভিজে কাপড়ে জীবন স্যারের ব্যবস্থায় খেতে গেছি।ভাতের সাথে চুপচাপ স্যারের গালাগালিও গিলতে হয়েছে। একদিন সাখাওয়াৎ বললো, ‘শান্তি ভালো ছেলে, ওকে তাড়াতে হবে।’ পরিকল্পনা মাফিক রাতে ওর মাথার কাছে খাসীর মাংসের উচ্ছিষ্ট কয়েক টুকরা হাড় রেখে দেওয়া হলো। সাখাওয়াৎই সেটা রাখলো, কিন্তু সকালে উঠে আমার উপরে সে কী কপট চোটপাট।‘হোটেলে গরুর গোশত খেলি ভাল কথা, কিন্তু শান্তির মাথার কাছে সেই হাড় কেন রাখলি? তুই একটা অমানুষ, জানোয়ার-ওটা কি বাইরে ফেলে দেওয়া যেত না?’ আমরা সে দিনগুলিতে খুবই চমৎকার বন্ধুত্বপূর্ণ সময় কাটিয়েছি। আর্থ সামাজিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তনের সাথে সাথে সামাজিক মূল্যবোধেরও পরির্তন হয়েছে প্রচুর;-এটা সামাজিক অবক্ষয়ও বলা যায়।এখন দেখি ছোটরা বয়ঃজ্যেষ্ঠদের ও শিক্ষকদের কোন তোয়াক্কা করে না। এঅবস্থার জন্য দায়ী কে সেটা সামাজিক গবেষণার বিষয়। তবে আমার মনে হয়, আগে শিক্ষকতা ছিল একটা মিশন, আর এখন নিছক একটা পেশা। আমাদের সময়ে আমরা এতো দুরন্ত থাকা সত্ত্বেও বড়দের , বিশেষ করে শিক্ষকদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাবোধ ছিল অবিচল। কিছু দিন পূর্বে হাদুবাবু বেঁচে থাকতে, তিনি আমাদের শিক্ষক ছিলেন। আমার তাঁর সামনে সাইকেল চড়ে যেতাম না।হাদুবাবু রাস্তার ধারের ঘরের বারান্দায় প্রায় সারাদিনই বসে থাকতেন। আমার সেই পুরানো বন্ধুদের মধ্যে নিমু, বংকা এরা আগেই দেশ ছেড়েছে। আগে পরে শান্তি ও সাখাওয়াৎ এ দু‘জনও চলে গেল। মেহেরপুরে আমি এখন একা। লেখাটি মুন্সি সাখাওয়াৎ হোসেন স্মরণে প্রকাশিত ‘হৃদয়ে অনির্বণ’ (১৪ অক্টেবর ১৯৯৬) –এ প্রকাশিত।অনুলিখনে কাজী হাফিজ। অ্যাডভোকেট হাফিজুর রহমান:(৩ মে ১৯৩৭-১৯ আগস্ট ২০১৯)আইনজীবী,লেখক মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, আবৃত্তি শিল্পী, উপস্থাপক ও নাট্যশিল্পী। মেহেরপুর জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট হাফিজুর রহমান (৮৩) ১৯ আগস্ট ২০১৯ মেহেরপুরের নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেন ।তিনি স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়েসহ অসংখ্য আত্মীয়-স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। এ্যাড. হাফিজুর রহমান এর জন্ম ১৯৩৭ সালের ৩ মে অবিভক্ত বাংলার ২৪ পরগনা জেলার নৈহাটিতে।দেশভাগের পর তাঁর পরিবার পূর্ব পুরুষের আদি নিবাস ছেড়ে মেহেরপুর শহরে চলে আসেন। তাঁর পিতার নাম মতিয়ার রহমান। হাফিজুর রহমান মেহেরপুর গভ. হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। রাজশাহী কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট ও স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সিটি ল'কলেজ থেকে আইন শাস্ত্রে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। প্রবীণ আইনজীবী, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, আবৃত্তি শিল্পী, উপস্থাপক, নাট্যশিল্পী, শিক্ষক, সরকারি কর্মকর্তা ও একজন সফল পিতা হাফিজুর রহমান। তিনি মেহেরপুর থেকে প্রকাশিত পাক্ষিক সীমান্ত পত্রিকার লেখক ছিলেন। এই পত্রিকা তিনি মেহেরপুরের ইতিহাস-ঐতিহ্যসহ গল্প ও নিবন্ধ রচনা করতেন। অ্যাড. হাফিজুর রহমান কর্মজীবনে একজন চৌকষ আইনজীবী ছিলেন। তিনি ১৯৬৩ সাল থেকে ৫৩ বছর মেহেরপুর আদালতে আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং একজন আবৃত্তি শিল্পী। জেলা শিল্পকলা একাডেমী থেকে গুণিজন হিসেবে তিনি সম্মাননা লাভ করেন। তিনি মেহেরপুর কলেজ প্রতিষ্ঠায় বিশেষ ভুমিকা রাখেন। কলেজের প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে এ্যাড. হাফিজুর রহমান বাংলা বিষয়ের অবৈতনিক শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কর্মজীবনে তিনি মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার বেতবাড়িয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। পরবর্তিতে মহকুমা খাদ্য নিয়ন্ত্রক হিসেবে চাকরি করেন। মুক্তিযুদ্ধেও তিনি সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন একজন সচেতন সংস্কৃতি-কর্মী হিসেবে। ১৯৭১ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে তিনি ভারতে যান বাংলাদেশ সরকারের সাংস্কৃতিক দলের প্রতিনিধি হিসেবে। এ দলের নেতৃত্ব দেন খ্যাতিমান আইনজীবী এ্যাড. আব্দুর রাজ্জাক। প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে সেখানে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনমত গঠনে কাজ করেন। সাহিত্যিক সৈয়দ মজতুবা আলী, দক্ষিণারঞ্জন বসু, জ্যোতি বসুর সাথে সাক্ষাৎ করেন। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথেও সাক্ষাৎ করেন এবং নির্বাক কবিকে পুষ্পস্ত্মবক দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। দক্ষিণারঞ্জন বন্ধুর সাথে দেখা করতে গেলে তিনি আবেগে আপস্নুত হয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি দৃঢ় সমর্থন জ্ঞাপন করেন। মেহেরপুর সরকারি মহিলা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবদুল্লাহ আল-আমিন(ধুমকেতু) লিখেছেন, ‘মেহেরপুরের শিল্প-সংস্কৃতি ভুবনের আলোকিত মানুষ হিসেবে পরিচিত এ্যাড. হাফিজুর রহমান এর জন্ম ১৯৩৭ সালের ৩ মে অবিভক্ত বাংলার ২৪ পরগনা জেলার নৈহাটিতে। হাফিজুর রহমান বেড়ে ওঠেন এক উদার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে এবং মেহেরপুরের সব সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড এক সময় তাঁর পরিবারকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। তাঁর অগ্রজ মফিজুর রহমান ছিলেন খ্যাতিমান নাট্যাভিনেতা, নির্দেশক ও সংগঠক। যাত্রাশিল্পকে আধুনিক ও উঁচুমানের লোকপ্রিয় শিল্পে পরিণত করতে তিনি কাজ করে গেছেন সারাজীবন। অগ্রজের অনুপ্রেরণায় হাফিজুর রহমানের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পদার্পণ। তিনি কবিতা আবৃত্তির তালিম নেন প্রমোদ কুমার রায়ের কাছে। ১৯৫১ সালে স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তির মধ্যদিয়ে আবৃত্তিকার হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ।’ আবদুল্লাহ আল-আমিন(ধুমকেতু) লিখেন,‘রবীন্দ্র শিল্পাদর্শের রূপ-রস-গন্ধে মুগ্ধ ও মগ্ন হাফিজ সারাজীবন নানা অনুষ্ঠান মঞ্চে, উৎসব পার্বণে রবীন্দ্রনাথ থেকেই পাঠ করেছেন বারবার তার ভরাট গলা দিয়ে; সেখানে নজরুলও বাদ যায় নি। পথের শেষ কোথায় তিনি জানেন না, তবুও রবীন্দ্র-নজরুলের কবিতাকে সঙ্গী করে আজও তিনি পথ চলেন। কবিতাতেই খুজে পান ভালোবাসার মন্ত্র, নিভৃত জীবনে প্রাণের খোরাক। কবিতাপ্রেমী শূচিস্নিগ্ধ এই মানুষটি কবিতার আলো দিয়েই মা-মাটি-মানুষকে ভালবেসেছেন। সাংস্কৃতিক সংগঠক নূরুল আহমেদ লিখেছেন,‘ স্বাধীনতা উত্তরকালেও তিনি বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেছেন। সৎ ও বিজ্ঞ আইনজীবী হিসেবেও সমাজে তার বিপুল জনপ্রিয়তা ও খ্যাতি রয়েছে। মেহেরপুর অরণি থিয়েটার ও রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদকে সহায়তা করেছেন নানাভাবে। বহুমাত্রিক ভূমিকার কারণে তাঁকে কেবল সংস্কৃতি কর্মী হিসেবে নয়, প্রাজ্ঞ বিদগ্ধজন হিসেবেও মান্য করা হয়। অবক্ষয়িত মূল্যবোধ, দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি যে ভাবে আমাদের সমাজের সব স্ত্মরে অপচ্ছায়া বিস্ত্মার করে আছে, সেখানে এ্যাড, হাফিজুর রহমান দল নিরপেক্ষ মানুষ হিসেব স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্য নিয়ে উজ্জ্বল হয়ে আছেন।’






«
Next
Newer Post
»
Previous
Older Post

No comments:

Leave a Reply