মালদ্বীপে চীনপন্থিদের বড় জয় ভারতের জন্য যে বার্তা দিচ্ছে
মালদ্বীপের পার্লামেন্ট নির্বাচনে চীনপন্থি প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জুর পিপলস ন্যাশনাল কংগ্রেস (পিএনসি) বড় ব্যবধানে জয় পেয়েছে। প্রকাশিত প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গেছে, দেশটির ৯৩ আসনের পার্লামেন্টে পিএনসির প্রার্থীরা দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি আসনে জয়ী হয়েছে। নির্বাচনে বিপুল জয় প্রেসিডেন্ট মুইজ্জুর চীনপন্থি নীতির প্রতি সমর্থন বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
চীনপন্থি হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ মুইজ্জু ‘ভারত প্রথম’ নীতির বিরোধিতা করে এসেছেন। ছবি: সংগৃহীত
মালদ্বীপের নির্বাচন কমিশন পার্লামেন্টের যে ৮৬টি আসনের ফল প্রকাশ করেছে তার মধ্যে পিএনসির প্রার্থীরা পেয়েছেন ৭০টি আসন। পার্লামেন্টে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য এ অবস্থান যথেষ্ট।
রোববারের নির্বাচনের এই ফল ভারত মহাসাগরের দ্বীপ দেশটিকে দীর্ঘ দিনের মিত্র ভারত থেকে দূরে সরিয়ে চীনের আরও ঘনিষ্ঠ করে তুলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
পিএনসির জয় ভারতের জন্য কী বার্তা?
মালদ্বীপের এবারের সংসদ নির্বাচন দু’টি কারণে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল। মুইজ্জুর ‘ভারতবিরোধী অবস্থান’ এবং ‘চীন ঘেঁষা নীতি’ মালদ্বীপের মানুষের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য তা পরখ করার একটা পরিসর তৈরি করছিল এই নির্বাচন।
মুইজ্জু ক্ষমতায় আসার পর ভারতের সঙ্গে মালদ্বীপের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। এরইমধ্যে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছেন তিনি। এমনকি, মালদ্বীপ থেকে ভারতীয় সেনাসদস্যদের সরানোর নির্দেশও দেন তিনি। শেষ পর্যন্ত ভারত সরকার মালদ্বীপ থেকে সেনাসদস্যদের সরিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে।
এই আবহের মধ্যেই হয় দেশের পার্লামেন্ট নির্বাচন। মালদ্বীপের বিরোধী দলগুলো মুইজ্জু সরকারের ভারতবিরোধী অবস্থানের বিরোধিতা করে প্রচারও করে। কিন্তু কোনো কিছুই মুইজ্জুর দলের পার্লামেন্টে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পথে বাধা হতে পারেনি।
আরও পড়ুন: মালদ্বীপে চীনপন্থি প্রেসিডেন্ট মুইজ্জুর দলের ভূমিধস জয়
মালদ্বীপের এবারের নির্বাচনকে মোহাম্মদ মুইজ্জুর জন্য ছিল এক কঠিন পরীক্ষা। কারণ, চীনপন্থি মুইজ্জু প্রেসিডেন্ট হলেও পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণ ছিল তার পূর্বসূরি ভারতপন্থি ইব্রাহিম মোহাম্মদ সোলিহর দল মালদিভিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টির (এমডিপি) হাতে। ফলে পিএনসি পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারবে কি না, এটাকে তার জন্য চ্যালেঞ্জ বলে মনে করা হচ্ছিল।
নির্বাচনে মুইজ্জুর দলের এই বড় জয়ের অর্থ, ভারতের দিকে না-গিয়ে চীনের দিকে রাজনৈতিক ঝোঁক থাকা সত্ত্বেও তার দলকেই দেশবাসী সমর্থন দিয়েছে।
কেন গুরুত্বপূর্ণ এই ফলাফল?
গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভারতবিরোধী অবস্থান প্রকাশ করে বিজয়ী হন মুইজ্জু। তিনি মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিনের মতো চীনপন্থি অবস্থান নেন। দুর্নীতির অভিযোগে ইয়ামিনের ১১ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। তবে গত সপ্তাহে আদালত এ সাজা বাতিল করলে তিনি মুক্তি পান।
মোহাম্মদ মুইজ্জুর দলের এবারের জয়কে ‘সুপার মেজরিটি’ হিসেবে বর্ণনা করেছে স্থানীয় গণমাধ্যম। সংবিধান সংশোধনের জন্য সংসদে যে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা দরকার, এই নির্বাচনের মাধ্যমে তার দল পিএনসি সেটি অর্জন করেছে।
আরও পড়ুন: মুইজ্জুকে ‘একগুঁয়েমি’ ছাড়তে বললেন সাবেক প্রেসিডেন্ট
মোহাম্মদ মুইজ্জু প্রেসিডেন্ট হলেও দেশটির পার্লামেন্ট পিপলস মজলিশে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় বিরোধী পক্ষের আইনপ্রণেতাদের আপত্তিতে তার মনোনীত তিনজনের মন্ত্রিসভায় যোগদান আটকে যায়। মুইজ্জু প্রস্তাবিত কয়েকটি বিল পাসেও আপত্তি জানান বিরোধীরা।
আগের পার্লামেন্টে ভারতপন্থি হিসেবে পরিচিত সাবেক প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহর দল এমডিপির নিয়ন্ত্রণে ছিল। তবে এবারের নির্বাচনে দলটি মাত্র ১৫টির মতো আসনে জয় পেয়েছে। ফলে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায় মুইজ্জুর সরকারের জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হবে।
মালদ্বীপের বিশ্লেষক ও ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার লেকচারার আজিম জহির বলেন, মুইজ্জুর জন্য এটা একটা উল্লেখযোগ্য প্রাপ্তি। এই জয়ের ফলে রাজনৈতিক প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিকোণ থেকে এবার মুইজ্জু সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করবেন। তাত্ত্বিক দিক থেকে বিচার বিভাগকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন তিনি। কারণ সংসদে পর্যাপ্ত আসন পেয়েছে তার দল।
এদিকে মালদ্বীপের এই নির্বাচনকে চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য মুইজ্জুর পরিকল্পনার পরীক্ষা হিসেবে দেখা হচ্ছিল। প্রেসিডেন্টর দায়িত্ব নেয়ার পর তিনি বেইজিং সফর করেন। সফরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংসহ দেশটির উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। সেই সফরে তিনি বেইজিংয়ের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার করেন।
মালদ্বীপের পার্লামেন্ট নির্বাচনের ফলাফল ভারতের জন্য অবশ্যই চিন্তার বিষয়। দেশটির বিদেশনীতি বিশেষ করে ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে বলেই মনে করা হচ্ছে। মুইজ্জুর জয় চীনের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠতা বাড়বে যা ভারত মহাসাগর অঞ্চলে কৌশলগত ভারসাম্যকে প্রভাবিত করতে পারে।
সূত্র: বিবিসি ও এনডিটিভি
No comments: