কারাগারে বসেও যেভাবে নির্বাচন জিততে চান ইমরান খান
সফল ক্রিকেটার হিসেবে পাকিস্তানকে বিশ্বকাপ উপহার দিয়েছিলেন ইমরান খান। এরপর ক্রিকেটের ২২ গজ থেকে সোজা নেমে আসেন রাজনীতির ময়দানে। দেরিতে হলেও ক্রিকেটের মতো এখানেও সফল হন ক্যাপ্টেন। দীর্ঘ ২২ বছর অপেক্ষার পর ২০১৮ সালে নির্বাচনে জিতে প্রধানমন্ত্রী হন।
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তেহরিক-ই-ইনসাফের নেতা ইমরান খান। ছবি: সংগৃহীত
কিন্তু পাকিস্তানের অন্যসব প্রধানমন্ত্রীর মতোই একই ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে ইমরান খানকে। মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। তার আগেই বিদায় নিতে হয়েছে। এরপর দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে কারাগারেও যেতে হয়েছে।
এখানেই শেষ নয়। যে নির্বাচনের আয়োজনের জন্য গত প্রায় দুই বছর ধরে ইমরান খান ও তার দল তেহরিক-ই-ইনসাফের নেতাকর্মীরা আন্দোলন করে আসছেন, সেই নির্বাচনেই অংশে নিতে তাদের নানাভাবে বাধা দেয়া হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে।
নির্বাচন সামনে করে পিটিআই’র ওপর নজিরবিহীন দমনপীড়ন চালানো হয়েছে। ইমরান খান ছাড়াও দলের বেশিরভাগ নেতাকর্মীকেই জেলে ভরা হয়েছে। পিটিআই এতদিন যে নির্বাচনী প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে আসছে, সেই ‘ব্যাট’ও কেড়ে নেয়া হয়েছে।
কিন্তু এতসব বাধা, বিপত্তি ও হয়রানি সত্ত্বেও এই মুহূর্তে পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল পিটিআই নির্বাচনের মাঠ ছাড়েনি। শুধু তাই নয়, দলটি এখনও বিশ্বাস করে, আগামী বৃহস্পতিবারের (৮ ফেব্রুয়ারি) ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি তথা জাতীয় পরিষদের নির্বাচন জেতার সক্ষমতা রয়েছে তাদের।
আরও পড়ুন: পাকিস্তানে নির্বাচন / ইমরান-সমর্থিত স্বতন্ত্ররা জয় পেলে কী হবে পরিস্থিতি?
নির্বাচন উপলক্ষে কয়েক সপ্তাহ আগেই জোর প্রচারণা শুরু করেছে পাকিস্তান মুসলিম লীগ (পিএমএর-এ) ও পাকিস্তান পিপল’স পার্টির মতো রাজনৈতিক দলগুলো। কিন্তু ভালোমতো প্রচারণা চালানোর সুযোগ পাচ্ছেন না পিটিআই নেতারা।
‘স্বতন্ত্র প্রার্থী’ হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিলেও নানাভাবে তাদের হয়রানি করা হচ্ছে। সরাসরি মাঠে-ময়দানে সভা-সমাবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। শুধু তাই নয়, প্রার্থীদের গুম ও হত্যাও করা হচ্ছে। সবশেষ গত ৩১ জানুয়ারি খাইবার পাখতুনখোয়ার পিটিআই নেতা ও সংসদ সদস্য প্রার্থী রিহান জেব খানকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনী প্রচারণায় বিকল্প ও অপ্রচলিত পদ্ধতি ব্যবহার করছেন পিটিআই নেতারা। কারাগারে থাকায় সরাসরি বক্তব্য দিতে পারছেন না ইমরান খান। এক্ষেত্রে একটি কৌশল বের করেছেন তিনি।
কারাগার থেকে আইনজীবীদের মাধ্যমে নোট আকারে বক্তব্য লিখে পাঠোচ্ছেন ক্যাপ্টেন। আর সেই নোট থেকে এআই ভয়েস জেনারেশন ব্যবহার করে অডিও বক্তব্য তৈরি করা হচ্ছে। সেই অডিও বক্তব্য দিয়ে টিকটকে ডিজিটাল সভা-সমাবেশ আয়োজন করছে পিটিআই নেতারা।
আরও পড়ুন: ইমরানের পর কুরেশিও নির্বাচনে অযোগ্য!
সভা-সমাবেশ আয়োজনে ইমরান খানের কারা নম্বর ‘প্রিজোনার নাম্বার ৮০৪’ ব্যবহার করা হচ্ছে। খানের ফেসবুক পেজেও একটি চ্যাটবট রয়েছে। যার মাধ্যম নির্বাচন সম্পর্কিত সব তথ্য ও দিক-নির্দেশনা মুহূর্তে পৌঁছে যাচ্ছে নেতাকর্মী ও নির্বাচনের প্রার্থীদের কাছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং নতুন প্রার্থীর মাধ্যমে কর্তৃপক্ষের দমনপীড়ন ও হয়রানি কাটিয়ে উঠতে চায় পিটিআই। বিবিসির এক প্রতিবেদন মতে, নির্বাচনী আমেজের মধ্যেই গ্রাম থেকে শহর সবর্ত্রই একটা ভয়ের পরিবেশ বিরাজ করছে। এই আতঙ্কের মধ্যেই কেউ কেউ সাহস করে প্রচারণায় নামছেন।
তেমনই একজন রেহানা ইমতিয়াজ দার। পাঞ্জাব প্রদেশের শিয়ালকোটের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির ৭১ নম্বর আসনে পিএমএল-এন’র রাজনীতিক ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফের বিরুদ্ধে থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তিনি।
গত কয়েকদিন ধরে শিয়ালকোটে প্রচারণা চালাচ্ছেন রেহানা দার। তবে কঠোর নিরাপত্তা ও দলের নেতাকর্মী বেষ্টিত হয়ে। রেহানার বয়স এখন ৭০-এর কোঠায়। একজন নারী হয়ে এই বয়সে তার প্রার্থী হওয়া অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই।
আরও পড়ুন: পাকিস্তানে নির্বাচন: মূল খেলোয়াড় কারা
ছেলে ওসমান দার ছিলেন পিটিআই’র অন্যতম নেতা। কিন্তু পিটিআই’র পতনের পর সম্প্রতি ‘অদৃশ্য চাপে’ দলের আরও অনেক নেতার মতোই সরে দাঁড়ান ওসমানও। এবার নির্বাচনেও অংশ নিচ্ছেন না তিনি। ছেলের অবর্তমানে তাই নিজেই প্রার্থী হয়েছেন মা রেহানা।
ভয়ে পিটিআই’র অনেক ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থী গা ঢাকা দিলেও বা রাজনীতি থেকে বিদায় নিলেও নির্ভিক চিত্তে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন সত্তরোর্ধ এই নারী রাজনীতিক। শিয়ালকোটের রাস্তায় প্রকাশ্যেই প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন। পাড়া, মহল্লার গলি রাস্তা থেকে শুরু করে শহরের মহাসড়কের দেয়ালে দেয়ালে সাটা হয়েছে নির্বাচনী পোস্টার।
No description available.
নিরাপত্তা বাহিনী ও দলবল বেষ্টিত হয়ে প্রচারণায় পিটিআই নেত্রী রেহানা দার
তার এই সাহসী নির্বাচনী প্রচারে সাড়া দিয়েছেন শিয়ালকোটের সাধারণ জনতাও। তারাও তার সাথে প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন। যেমনটা নিজেই জানালেন রেহানা। বিবিসিকে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘খুবই ভালো লাগছে। কারণ আমার শহর শিয়ালকোটের গর্বিত পুত্র-কন্যা, ভাই ও মায়েরা আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন।’
রেহানা বহু বছর ধরেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। সেই সুবাদে তার পরিচিতিও বেশ। এই ব্যাপারটার পাশাপাশি ইমরান খান ও তার দল পিটিআই’র প্রতি ভালোবাসা তাকে প্রার্থী হতে আত্মবিশ্বাস যুগিয়েছে। রেহানার কথায়, ‘আমি ইমরান খানের সঙ্গে আছি এবং ইমরান খানের সঙ্গেই থাকব। যদি আমাকে জনসমক্ষে একাও ছেড়ে দেয়া হয়, তবুও আমি ইমরান খানের পতাকা নিয়ে রাস্তায় নামব।’
আরও পড়ুন: পাকিস্তানে গণতন্ত্র / সেনাবাহিনী শত্রু, সেনাবাহিনীই মিত্র!
গত কয়েকদিন রেহানা দারের নির্বাচনী প্রচারণার যেসব ছবি ও ভিডিও গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসেছে, সেগুলোতে একটু নজর বুলালেই বিষয়টা যে সত্য তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। রেহানা দারের চারপাশে জড়ো হওয়া জনতা ইমরান খানের ছবি উঁচুতে ধরে রেখেছেন। পাশেই মাথার উপরে উড়ছে পিটিআই’র দলীয় পতাকা।
ইমরান খান ও পিটিআই’র পক্ষে লড়লেও রেহানা দার কিন্তু এই নির্বাচনে পিটিআই’র প্রার্থী নয়। তিনি মূলত আরও অনেক পিটিআই নেতার মতোই কৌশলগতভাবে একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। কারণ পিটিআইকে দলগতভাবে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে দেয়নি পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন। দলের নির্বাচনী প্রতীকও ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে।
নির্বাচনী প্রতীক কেড়ে নেয়ার সিদ্ধান্তটি ‘ছোট’ মনে হলেও পাকিস্তানের মতো একটি দেশের নির্বাচনের ক্ষেত্রে এর প্রভাবটা অনেক বড়।কারণ দেশটির জনসংখ্যার ৫৮ শতাংশই এখনও নিরক্ষর। ব্যালট পেপারে লেখা পড়ে ভোট দেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। ছবিই একমাত্র ভরসা। ক্রিকেট ব্যাট অতি পরিচিত প্রতীক হওয়ায় এর ওপর হামলা চালানো হয়েছে।
আরও পড়ুন: পাকিস্তানে সন্ত্রাসী হামলায় ১০ পুলিশ কর্মকর্তা নিহত
ব্যাটের বদলে পিটিআই’র ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থীদের বিকল্প প্রতীক বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সেই প্রতীক দিয়েই নির্বাচনের পোস্টার ছাপা হয়েছে। ব্যালট পেপারেও সেই ছবি থাকছে। রেহানা দার পেয়েছেন দোলনা। অন্যান্য প্রার্থীরা পেয়েছেন কেটলি ও স্যাক্সোফোনের মতো অপরিচিত সব প্রতীক। এসব প্রতীক নিয়েও নির্বাচনে লড়ছে ইমরানের দল পিটিআই।
No comments: