ক্ষমতা হারাচ্ছে মিয়ানমারের জান্তা সরকার, এরপর কী?
দ্রুত বদলে যাচ্ছে মিয়ানমারের পরিস্থিতি। দেশটিতে একের পর এক এলাকা দখল করে নিচ্ছে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো। বিভিন্ন জায়গায় নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে ক্ষমতাসীন জান্তা সরকার। এরই মধ্যে ৩৩টি শহর নিজেদের দখলে নেয়ার দাবি করেছে বিদ্রোহীরা।
মিয়ানমারের সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বিপ্লব সফল হওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও জান্তাদের পতনের পর প্রতিরোধযোদ্ধারা ঐক্যবদ্ধ হতে পারবে এমন কোনো সম্ভাবনা নেই। ছবি: সংগৃহীত
মিয়ানমারের সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বিপ্লব সফল হওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও জান্তাদের পতনের পর প্রতিরোধযোদ্ধারা ঐক্যবদ্ধ হতে পারবে এমন কোনো সম্ভাবনা নেই। ছবি: সংগৃহীত
৪ মিনিটে পড়ুন
বর্তমান বিশ্বের কর্তৃত্ববাদী নেতারা যে কতটা প্রভাবশালী, এমনকি তারা ক্ষমতায় না থাকলেও, বিষয়টি গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলা লোকদের চিন্তারও বাইরে। তবে মিয়ানমার এখন এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। দেশটির প্রতাপশালী সামরিক জান্তাদের ক্ষমতাহীন হয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে। জান্তা জেনারেলদের কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে এবং নিজেদের অধিকার পুনরুদ্ধারে দেশটির জনগণ জীবনবাজি রেখে লড়াই করছে।
মিয়ানমারে সামরিক শাসন শুরু হয় ১৯৬২ সালে। এর অর্ধশতাব্দী পর দেশটিতে রাজনৈতিক উদারীকরণ, অর্থনৈতিক সংস্কার ও উন্নয়ন প্রক্রিয়া সীমিত আকারে হলেও শুরু হয়েছিল। সেই প্রক্রিয়া ২০১১ সালে শুরু হয়ে ২০২১ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের পুনর্নির্বাচিত বেসামরিক সরকারের হাত থেকে সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়ে সামরিক শাসন জারি করলে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। এরপর দেশটির তরুণ সম্প্রদায়, জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বেসামরিক নেতা-কর্মী ও ক্ষুব্ধ সাধারণ নাগরিকেরা জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। সম্প্রতি, প্রতিরোধ বাহিনী তাদের সংগ্রামকে ‘বিপ্লব’বলে দাবি করছেন। তারা যুদ্ধক্ষেত্রে মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে একাধিক রাজ্যে জান্তাকে হটিয়ে দিয়ে নিজেদের দখলে নিয়েছে।
তবে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে পরাজিত করা এক জিনিস, আর জাতিগতভাবে বিভক্ত দেশটিতে কার্যকর বহুত্ববাদী রাষ্ট্র পুনর্গঠন করা অন্য জিনিস। এরপরও মিয়ানমারের রক্তক্ষয়ী এ সংঘাত মাসের পর মাস চলতে পারে। কারণ সেনাবাহিনী দেশটির রাজধানী নেপিদোর পতন ঠেকাতে রাজধানী ও তার চারপাশে পদাতিক বাহিনী, গোলন্দাজ ও বিমানবাহিনীকে ব্যবহার করতে পারে।
আরও পড়ুন: আরাকান আর্মির দখলে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী শহর
জান্তা সরকারকে বর্তমানে যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি দুর্বল মনে হচ্ছে। তাদের হাতে একসময় পাঁচ লাখ সেনাবাহিনী ছিল। এখন সেই সংখ্যা দেড় লাখে নেমে এসেছে। এই সেনারাও এখন বিক্ষিপ্ত অবস্থায় রয়েছেন।
বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনী হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এই বাহিনী স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে জাতিগত সংখ্যালঘুদের মধ্য থেকে উঠে আসা মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে কয়েক দশক ধরে লড়াই করে আসছে। এত দিন তারা সফলভাবে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে এলেও এবার তারা ভুল লক্ষ্য বেছে নিয়েছে।
অভ্যুত্থানের সপ্তাহখানেকের মধ্যে দেশব্যাপী বিক্ষোভ দমনে সরকারি সেনারা তাদের বন্দুকের নল সাধারণ জনগণের ওপর চালায়। তারা নির্বিচারে শত শত সাধারণ বার্মি নাগরিককে হত্যা করেন। এটি জনগণের ক্ষোভকে আরও উগরে দিয়েছে।
প্রতিরোধ অন্দোলনের নেতৃত্ব মূলত বর্মি তরুণদের থেকেই উঠে এসেছে। দেশটিতে যখন অপেক্ষাকৃত উন্মুক্ত ও উদার অবস্থা, উন্নত জীবনযাপন এবং ক্রমবর্ধমান প্রত্যাশার পরিবেশ ছিল সেই সময়ে বেড়ে উঠা তরুণরা জান্তাবিরোধী অন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এ তরুণেরা প্রথমে দেশব্যাপী পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ) ইউনিটে সংগঠিত হয়েছেন। প্রাথমিকভাবে তারা বাড়িতে তৈরি অস্ত্র ও অন্যান্য প্রাথমিক অস্ত্র সংগ্রহ করেছেন। পরে তারা জাতিগত মিলিশিয়াদের সঙ্গে একত্রিত হয়ে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
আরও পড়ুন: মিয়ানমারে জান্তার সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত বিদ্রোহী জোট
বেসামরিক নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি), এথনিক আর্মড অর্গানাইজেশনস (ইএওএস) এবং পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ) সমন্বয করে কাজ করছে। এ স্কোয়াডগুলো গেরিলা কৌশলের পাশাপাশি শাসক বাহিনীকে আক্রমণ করার জন্য প্রচলিত যুদ্ধকৌশলও ব্যবহার করেছে। অভ্যুত্থানের মাত্র এক বছর পরে যুদ্ধ অচলাবস্থায় পৌঁছেছিল।
তবে সামরিক নৃশংসতা ও বর্বরতা জান্তার বিরুদ্ধে দেশব্যাপী বিদ্রোহকে উসকে দিলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ প্রতিরোধ যোদ্ধারা ক্রমবর্ধমানভাবে তাদের দখল বাড়াতে সক্ষম হন। যেখানে মিয়ানমারের জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশ অংশ নিয়েছে। সবদিক থেকে আক্রমণের শিকার হওয়ার পর সেনাবাহিনীর নতুন সদস্য নিয়োগ ও শক্তি বাড়ানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। তারা তীব্র রসদ-সংকটে পড়েছে। এতে তাদের মনোবলও ভেঙে পড়েছে।
মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি, আ’আং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি এবং আরাকান আর্মি-এই তিন সশস্ত্র সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ‘ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’ গত অক্টোবরের শেষের দিকে জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে ‘অপারেশন ১০২৭’ নামের একটি অভিযান চালায়। এই অভিযানের পর উভয় পক্ষের জন্যই ‘কিছুতেই আর পিছু হটার উপায় নেই’পরিস্থিতি তৈরি হয়।
মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলীয় চীনের সীমান্তবর্তী শান রাজ্যে বিদ্রোহীদের সমন্বিত অভিযানে জান্তা বাহিনীর কাছ থেকে দুই ডজন শহর এবং কয়েক শ সামরিক চৌকি হাতছাড়া হয়ে যায়।
আরও পড়ুন: মিয়ানমারে সাড়ে ৯ হাজারের বেশি বন্দিকে মুক্তির ঘোষণা
অন্যান্য জাতিগত সশস্ত্র সংগঠন এবং কায়াহ, চিন, রাখাইন ও কাচিন রাজ্যের প্রতিরোধ শিবিরগুলোর সমন্বিত হামলা এবং ম্যাগওয়ে ও সাগাইং অঞ্চলের প্রতিরোধযোদ্ধাদের হামলা সামরিক বাহিনীকে দুর্বল করে দিয়েছে। আর এই হামলা প্রতিরোধ যোদ্ধাদের শক্তির আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে। ফলে মনে হচ্ছে, জান্তার পতন এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। তবে মিয়ানমারের সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বিপ্লব সফল হওয়ার বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও স্বৈরাচারের পতনের পর জান্তাবিরোধী শক্তিগুলো যে ঐক্যবদ্ধ হতে পারবে, এমন কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
মিয়ানমারের সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বিপ্লব সফল হওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও জান্তাদের পতনের পর প্রতিরোধযোদ্ধারা ঐক্যবদ্ধ হতে পারবে এমন কোনো সম্ভাবনা নেই। ইএওএস বা জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনগুলো নিজেদের এলাকায় ক্ষমতা ধরে রাখায় বিশ্বাসী। তারা শুধু কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বকে হটানোর জন্য একত্র হয়েছে। অন্যদিকে, পিডিএফ ইউনিটের হয়ে লড়াইরত তরুণদের সরকার ও জোট গঠনে কোনো অভিজ্ঞতা নেই। আবার এনইউজি এখনও একটি বিশ্বাসযোগ্য নেতৃত্ব তৈরি করতে পারেনি।
গৃহযুদ্ধে জয়লাভের পর বিরোধীরা যদি শান্তি নষ্ট করে তাহলে এটা লজ্জার বিষয় হবে। এটি কেবলমাত্র হতাশার দিকেই পরিচালিত করবে না, নতুন করে জাতিগত সংঘাত এবং মিয়ানমারের স্বায়ত্তশাসিত রাজ্যগুলো মাদক পাচার এবং অপরাধমূলক কার্যকলাপের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হতে পারে।
দুর্ভাগ্যের বিষয়, সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনস অ্যাসোসিয়েশন (আসিয়ান) এ নিয়ে কী প্রতিক্রিয়া জানা
No comments: