ন্যায্যমূল্য ও ওজনে কারচুপির কারনে মেহেরপুরের আখচাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে কৃষকরা
ন্যায্যমূল্য ও ওজনে কারচুপি করায় গাংনীতে আখচাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে কৃষকরা
ন্যায্যমূল্য ও ওজনে কারচুপির কারনে গাংনীতে আখচাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে কৃষকরা। অন্যদিকে আখচাষীদের নিজেদেও মাড়াই কলে গুড় করতে বাঁধা দেয়ায় আখ চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে কৃষকরা।
আখের রস আর গরম গুড় ! আহ! কি মজার মিষ্টি গন্ধ।শীতের সকালে চিড়া মুড়ি আর দইয়ের সাথে আখের গুড়ের সেই নাস্তা আর কোথাও পাওয়া গেল না। গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী সেই বিয়ে বাড়ি বা বিভিন্ন পালা পার্বনে সেই নাস্তা এখন পাশ্চাত্য সভ্যতার বিকাশে হারিয়ে গেছে। গ্রামের বিভিন্ন পাড়াতে ও আখের জমির পার্শ্বে আখ মাড়াইয়ের কল বসতো। শীতের মিষ্টি সকালে গ্রাম যেন আখের রস আর গুড়ের মিষ্টি গন্ধে চারিদিক মৌ মৌ গন্ধে ভরে থাকতো। এখন আর সেই দিনগুলি নেই।
মেহেরপুরের গাংনী উপজেলায় গুড়ের বাজারদর ভালো থাকলেও মাড়াইকল বসিয়ে গুড় করতে না পারায় আখ চাষীরা আবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।এমনকি সঠিক সময়ে ন্যায্য মূল্যে সরকারীভাবে মিল গুলো আখ ক্রয় না করার কারনেও চাষীরা আখ চাষ কমিয়ে দিয়েছে। সরকারী নির্দেশনায় আখ মাড়াই মৌসুমে আর গরু মহিষ ঘুরিয়ে মেশিন দিয়ে রস-গুড় করতে দেয়া হয় না। ফলে চাষীরা আখ চাষ লাভজনক হলেও মাঠে তেমন আখের জমি দেখা যায়না।
হাড়াভাঙ্গা গ্রামের আখচাষী রমজান আলী, শফিউল ইসলাম ও জোয়াদ হোসেন জানান, অন্যান্য গ্রামে আখ চাষ নেই বললেই চলে।অনেকদিন ধরে হাড়াভাঙ্গা, সাহেবনগর, দেবীপুর, হোগলবাড়ীয়া গ্রামে আখ চাষ হয়ে আসছে।।এছাড়াও হেমায়েতপুর, চাঁদপুর সালদহ গ্রামে কিছু কিছু চাষ হয়ে থাকে। একজন চাষী ২ থেকে ৫ বিঘা জমিতেও আখ চাষ করে থাকে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও জানান, আখের গুড়ের দাম এবছর ভালো। ২শ’২০ টাকা থেকে ২শ’৪০ টাকা কেজি দামে গুড় বিক্রি হচ্ছে। ১ বিঘা জমিতে কমবেশী ২০-২২ টিন গুড় উৎপাদন হচ্ছে।বিঘাপ্রতি খরচ হচ্ছে ২৫-৩০ হাজার টাকা। বীজ, সার ও উৎপাদন খরচসহ আনুসঙ্গিক খরচ বাদ দিয়ে মোটামুটি বিঘাপ্রতি ৬০-৭০ হাজার টাকা লাভ থাকছে। তবে আখ ফসল জমিতে ১ বছরেও বেশী সময় কাল থাকে বলে অনেকে আখ চাষ করতে রাজী হয় না।
কৃষকরা জানান, এক বছরের ফসল আখ চাষ করে আর লাভ হচ্ছে না।বাজার দর ভালো পাওয়ায় ধান, গম ,ভুট্টা চাষ বর্তমানে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। কারণ ধান গম ভুট্টাচাষে উৎপাদন খরচ বাদে লাভ বেশি। আখ চাষ উপজেলার কয়েকটি গ্রামে এখনও ধরে রেখেছেন।উপজেলার সবচেয়ে বেশী আখ চাষ হয় হাড়াভাঙ্গা, সাহেবনগর, কাজীপুর, দেবীপুর , হোগলবাড়ীয়া ও হেমায়েতপুর গ্রামে। এছাড়াও মটমুড়া, কোদাইল কাটি, বাদিয়াপাড়া, কুমারীডাঙ্গা, শানঘাট, আযান, বাহাগুন্দা, পাকুড়িয়া ইত্যাদি গ্রামে কমবেশী আবাদ হয়। আখের গাছ ও সবুজ পাতা উন্নত মানের গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পাশাপাশি আখের ছোবড়া জ্বালানী হিসাবে ব্যবহার করা হয়।
অনেকদিন থেকে বিভিন্ন ফসলের পাশাপাশি এ অঞ্চলের কৃষকরা আখ চাষ করে আসছে। মাড়াই মেশিন দিয়ে গুড় করতে না দেয়ায় বর্তমানে শুধুমাত্র আখের রস বিক্রির জন্য আখ চাষ করছেন। তবে গুড়ের বাজার দর লাভজনক আর চাহিদা অনেক বেশী থাকায় অনেকেই আখ চাষ করতে আবার এগিয়ে আসছে। ইদানিং দেখা যাচ্ছে, জুগিন্দা , হিন্দা ও চৌগাছা গ্রামের কয়েকজন চাষী হাইব্রিড আখ (গেন্ডারী) চাষে ঝুঁকে পড়েছেন। গেন্ডারী আখ লালচে ও কালো রংয়ের হয়ে থাকে। এই গেন্ডারী উচ্চতায় ২৫ থেকে ২০ ফুট লম্বা হয়ে থাকে। চাষীরা ৩০ টাকা থেকে ৬০ টাকা পিচ হিসেবে বাজারে বিক্রি করে থাকে। গেন্ডারী খুব নরম ও সুমিষ্ট হয়ে থাকে। সেকারনে সব বয়সের ছেলে মেয়েরা খেতে পারে। হিনদা গ্রামের শাহজাহান আলী জানান, আমি গত বছর ১০ কাঠা জমিতে গেন্ডারী আখের চাষ করেছিলাম। বিঘা প্রতি খরচ ২৫ হাজার টাকা। কিনতু বিক্রি করেছি ১ লাখ ১০ হাজার টাকায়। এবছর আশিক আখ চাষ করেছে সেও তুলনামূলক ভাল দামে বিক্রি করেছে।
হাড়াভাঙ্গা গ্রামের আখচাষী মকবুল হোসেন, আলী হোসেন, বাচ্চু মিয়া, মোমিন, শওকত আলী, আলামিন হোসেন জানান, আখের মিলগুলো প্রতিবছর লোকসান দিতে দিতে দেউলিয়া হয়েছে। তাই লোকসান কাটিয়ে উঠতে গ্রামের আখ মাড়াই বন্ধ করে দিয়েছিল। এমনকি মিল মালিকরা প্রশাসনের সহায়তায় মাড়াই কল জব্দ ও চাষীদের ধরে জেল জরিমানাও করেছিল।
বাংলাদেশ চিনিকল ও আখ চাষী ফেডারেশেনের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক মনিরুজ্জামান আতু জানান, এবছর আখ চাষীদের উদ্বুদ্ধ করতে আখের দাম দেয়া হয়েছে ২২০ টাকা মন। এছাড়াও সেসব কৃষক আখ বপন করবেন তাদের মনপ্রতি ২৪০ টাকা দেয়া হবে। তিনি আরও জানান, গত বছর গাংনী উপজেলায় ১ হাজার ৪২০ একর জমিতে আখ চাষ করা হয়েছিল। এর মধ্যে কেরুজ কোম্পানীতে এক হাজার একর জমির আখ ও বাদবাকী আখ ফরিদপুর ও মোবারকগঞ্জ চিনিকলে সরবরাহ করা হয়েছিল। এবছর আখ চাষ কিছুটা বেড়েছে।
গাংনী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইমরান হোসেন জানান, আখ চাষে আবারও চাষীরা আগ্রহী হবে বলে ধারনা করছি। আখ চাষ তুলনামূলক কম। এবছর উপজেলায় ১ হাজার ৫ শ’ একর জমিতে আখ চাষ করা হয়েছে। আখ চাষের মাধ্যমে দেশে চিনির চাহিদা পূরণ না হওয়ায় সরকার ভর্তুকি মূল্যে বিদেশ থেকে চিনি আমদানি করছে। কৃষকরা যাতে পরিকল্পিতভাবে আখ চাষ করতে পারে সেদিকেও নজর দেওয়া হচ্ছে ।
ধান, পাট, গম ও ভুট্টার পশাপাশি আখ চাষে চাষীদের উদ্বুদ্ধ করতে মাঠকর্মী গন পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন।
Tag: others Zilla News
No comments: