ইকোনমিস্টের নিবন্ধ ইউরোপ আসলে কে চালান
?
ইংলিশ ফুটবলার গ্যারি লিনেকার একবার ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন, ‘বিশ্বকাপ ফুটবল এমন একটি খেলা যেখানে ২২ জন লোক ৯০ মিনিট ধরে একটি বলের পিছনে ছোটে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জয়ী হয় জার্মানরা।’
ইউরোপ আসলে কে চালান?
ইউরোপীয় ইউনিয়নের গত কয়েক দশকের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতিও একইভাবে একপ্রকার অনুমানযোগ্যই ছিল। তা সে ছয়টি দেশের জোটই হোক আর ১২ কিংবা ২৭টি দেশ নিয়েই গঠিত হোক না কেন।
কোনো একটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার বেলায় সদস্য রাষ্ট্রগুলো আপোষের তালেই থাকে। যতক্ষণ না ফ্রান্স ও জার্মানি তাতে শেষ ফোড়টা দিচ্ছে। এই দেশ দুটি সম্মত হলেই সবাই রাজি।
কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে জোটের দুই বড় সদস্যের আধিপত্য বিস্তারের সেই পুরোনো মডেলটি বেশ কিছুদিন ধরেই ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছে। ইউরোপ যখন একের পর এক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তখন ক্ষমতার একটি নতুন ক্ষেত্র গড়ে উঠছে।
তিন বছরের করোনা (কোভিড-১৯) মহামারি, তারপর ইউক্রেন যুদ্ধ ইউরোপীয় প্রকল্পের পুনর্গঠনে সাহায্য করেছে। এর মধ্যে রয়েছে কে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সে ব্যাপারে মনোযোগ দেয়া।
আরও পড়ুন: টাইমসের নিবন্ধ / ভারতে একটি ধর্মীয় স্থাপনা যেভাবে রাজনৈতিক যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে উঠল
প্রতিরক্ষা ও পূর্বমুখী সম্প্রসারণ- একসময় এ বিষয় দুটি সুপ্ত নীতির অন্তর্ভূক্ত থাকলেও এখন তা অগ্রাধিকার পাচ্ছে। যার ফলে মধ্য-ইউরোপে ইউক্রেনের প্রতিবেশী দেশগুলো গলায় জোর পাচ্ছে।
একদিকে চীনের উত্থান আরেকদিকে আমেরিকায় ট্রাম্পবাদের পুনরুত্থানের আশঙ্কা ইউরোপীয় ইউনিয়নকে তার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করেছে। তবে তা প্রায়ই ফরাসি ফর্মুলায়।
জলবায়ু বিষয়ক প্রতিষ্ঠানগুলো সম্মিলিত স্তরে পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজনীয়তাকে জোরদার করেছে। এদিকে আগামী জুনের ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচন সামনে করে ফিনল্যান্ড থেকে ফ্রান্স পর্যন্ত কট্টর ডানপন্থীরা প্রভাব বিস্তার করছে।
খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, জার্মানির অ্যাঞ্জেলা মার্কেল নিঃসন্দেহে পুরো মহাদেশের নেতা ছিলেন। তবে জার্মান চ্যান্সেলর হিসেবে তার উত্তরসূরি ওলাফ শলজ তার সেই জায়গা গ্রহণ করেননি বা করতে পারেননি। অনেকে এখন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর দিকে তাকিয়ে আছেন, যে তিনি সেই দায়িত্ব নেবেন।
আরও পড়ুন: প্রজেক্ট সিন্ডিকেটের নিবন্ধ /ইউরোপ কি ভেঙে পড়ছে?
কিন্তু নিজ দেশেই ক্রমবর্ধমান জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতির মুখে রয়েছেন ম্যাক্রোঁ। যার ফলে গত ৮ জানুয়ারি সরকার পুনর্গঠনের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করেন। ফ্রান্সে ২০২৭ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। তবে চাইলেও নির্বাচনে আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না ম্যাক্রোঁ।
এবং যে কারণে তিনি (ম্যাক্রোঁ) এমন একটি আত্মবিশ্বাসী ভাব প্রকাশ করেন যা প্রায়ই অন্যান্য ইউরোপীয় নেতাদের প্রভাবিত করে। জার্মানি ও ফ্রান্স একসাথে এমন কর্তৃত্ব তৈরি করে যা অতুলনীয়। কিন্তু সেটা খুব কমই দেখা যায়।
ফলে ইউরোপের এখন কার্যত প্রকাশ্য কোনো নেতৃত্ব নেই। ফলে আজকাল কে কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝা যায় সংকটকালে। ইউক্রেন যুদ্ধ ও সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তার মতো প্রধান দুই ইস্যুকে উদাহরণ হিসেবে নিলে বিষয়টা সহজেই স্পষ্ট হবে।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে কিয়েভ অভিমুখে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর পর দিকনির্দেশনার জন্য খুব কম সংখ্যক লোকই জার্মানির দিকে তাকিয়েছিল। কারণ জার্মানি আগেই নিজেকে পুরোপুরি রাশিয়ান গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল করে ফেলেছে।
আরও পড়ুন: নেদারল্যান্ডসে নির্বাচন / ইসলামবিদ্বেষীদের জয়, আতঙ্কে মুসলিমরা
তাছাড়া জার্মান সশস্ত্র বাহিনী তার কাজে এতটাই অযোগ্য যে শলজ জেইটেনওয়েন্ডে তথা সবকিছু নতুন করে ঢেলে সাজানোর প্রয়োজনীয়তার কথা জানান।
অন্যদিকে পোল্যান্ড ও তিন বাল্টিক রাষ্ট্রের নেতৃত্বে মধ্য ইউরোপের দেশগুলো বুঝতে পারলো যে, বছরের পর বছর ধরে তাদের সাবেক অধিপতি রাশিয়ার সৃষ্ট বিপদ সম্পর্কে যে তাদের সতর্ক করা হয়েছে তা শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত।
এর ফলে জোটের নীতিগত দুটি পরিবর্তনে তাদের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। একটি হলো ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠানোর জন্য ইইউ নিজেই অর্থ প্রদান করছে, যা প্রতিরক্ষা ব্যয়ের প্রথম পদক্ষেপ। দ্বিতীয়টি হলো জোটের পরিবর্ধন বা বিস্তার, যা ইতোপূর্বে জোটের মূল এজেন্ডার বাইরে ছিল।
২০১৩ সালে ক্রোয়েশিয়ার পর থেকে আর কোনো দেশই জোটে যোগ দেয়নি। কিন্তু এখন অন্তত নয়টি দেশে জোটের সদস্যপ্রার্থী। যারা আলোচনার বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো ইউক্রেনের সদস্যপদের বিষয়টি। ফ্রান্স ও ডেনমার্কের পিছুটান সত্ত্বেও মধ্য-ইউরোপই বিষয়টাকে সামনে এগিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আরও পড়ুন: ইউরোপে উগ্রপন্থার উত্থান, হুমকির মুখে মূলধারার রাজনীতি
যুদ্ধের মধ্যেই গত ১৪ ডিসেম্বর ইউরোপীয় নেতারা আনুষ্ঠানিকভাবে ইউক্রেনের জোটে যোগদানের বিষয়ে আলোচনা শুরু করতে সম্মত হন। ফলে ২৭ সদস্যের জোট ৩৬টি দেশে বিস্তৃত হতে যাচ্ছে। এর জন্য কয়েক বছর সময় লাগতে পারে। সেক্ষেত্রে ভরকেন্দ্র নিশ্চিতভাবে মহাদেশের পূর্ব দিকেই সরে যাবে।
Tag: English News others world
No comments: