রাশিয়ার বিরুদ্ধে কেন যুদ্ধের প্রস্তুতি ন্যাটোর?
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে বড় ধরনের সামরিক মহড়া শুরু করেছে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো। বুধবার (২৪ জানুয়ারি) ‘স্টেডফাস্ট ডিফেন্ডার ২০২৪’ নামে এ মহড়া শুরু হয়েছে। ৯০ হাজার সেনা, ৫০টির বেশি যুদ্ধজাহাজ, ৮০টির বেশি যুদ্ধবিমান এবং শত শত ট্যাংক ও সাজোয়া নিয়ে এই মহড়া চলবে কয়েক মাস ধরে।
বুধবার (২৪ জানুয়ারি) ‘স্টেডফাস্ট ডিফেন্ডার ২০২৪’ নামে বড় আকারের সামরিক মহড়া শুরু করেছে ন্যাটো। ছবি: সংগৃহীত
বুধবার (২৪ জানুয়ারি) ‘স্টেডফাস্ট ডিফেন্ডার ২০২৪’ নামে বড় আকারের সামরিক মহড়া শুরু করেছে ন্যাটো। ছবি: সংগৃহীত
পশ্চিমা নেতারা এটাকে স্নায়ুযুদ্ধের পর ‘সবচেয়ে বড়’ সামরিক মহড়া হিসেবে অভিহিত করেছেন। এবং তারা কোনোরকম ভনিতা ছাড়াই বলছেন, তাদের এই সামরিক মহড়া রাশিয়াকে মোকাবিলা করার জন্য। প্রশ্ন হলো ন্যাটো কি কারণে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে?
ন্যাটোর উদ্দেশ্য
ন্যাটো মূলত সামরিক জোট। স্নায়ুযুদ্ধের প্রাক্বালে এর জন্ম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৯ সালের এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ ইউরোপীয় ১২ দেশ নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে।
সেই চুক্তির মধ্যদিয়ে গড়ে ওঠে ন্যাটো। ওই চুক্তিতে প্রতিষ্ঠাতা দেশগুলো রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে একে অপরকে রক্ষার অঙ্গীকার করে। এর মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসনের হাত থেকে পশ্চিম বার্লিন ও ইউরোপের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
শুরুতে ১২টি সদস্য থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর সদস্য ও কর্মকাণ্ডের পরিধি বেড়েই চলেছে। বর্তমানে ৩১টি সদস্য নিয়ে এটা বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী সামরিক সংগঠন। সদস্য হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে ইউক্রেনসহ আরও কয়েকটি দেশ।
আরও পড়ুন: ৯০ হাজার সেনা নিয়ে বিশাল সামরিক মহড়ায় ন্যাটো
ন্যাটোর সংবিধান বলছে, তাদের কোনো সদস্যের ওপর হামলা মানে জোটের সবার ওপর হামলা। আর এই হামলা প্রতিরোধে জোটের সব সেনারা ঝাঁপিয়ে পড়বে। তবে আক্রান্ত না হয়েও ন্যাটো বিভিন্ন দেশে সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে।
প্রথম কোনো সামরিক হস্তক্ষেপ করে ১৯৯২ সালে বসনিয়ায়। এরপর ১৯৯৯ সালে কসোভো যুদ্ধে দ্বিতীয়বার। ২০০১ সালে আফগানিস্তানে। এরপর ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়াতেও।
ইউক্রেনে ন্যাটোর প্রক্সি যুদ্ধ
ন্যাটোকে শুরু থেকেই সন্দেহের চোখে দেখে আসছে রাশিয়া। সম্প্রতি এর দ্রুত বিস্তারকে সরাসরি নিজেদের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসেবে অভিহিত করে মস্কো।
ইউরোপের চতুর্থ বৃহত্তম ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশ ইউক্রেন। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ দেশটি বর্তমানে ন্যাটোর সহযোগী দেশ।
এর অর্থ হচ্ছে দেশটির সঙ্গে বোঝাপড়া আছে এবং ভবিষ্যতে এই জোটে যোগদানের সুযোগ দেয়া হবে। কিন্তু রাশিয়া কোনোভাবেই ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য হিসেবে দেখতে চায় না। পশ্চিমাদের কাছে সেই আশ্বাসই চায় রাশিয়া।
গত বেশ কয়েক বছর ধরে ন্যাটোয় যোগদানের চেষ্টা করছে। কিন্তু এর বিরোধিতা করে আসছিল প্রতিবেশী রাশিয়া। কারণ ইউক্রেন সদস্য হলে সেখানে সহজেই সেনা মোতায়েন করতে পারবে ন্যাটো।
রাশিয়ার বিরোধিতা সত্ত্বেও সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেনি কিয়েভ। বরং সম্প্রতি ন্যাটোয় যোগদানে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা আরও জোরদার করেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। যা রাশিয়াকে খেপিয়ে তোলে এবং এরই প্রতিক্রিয়ায় ২০২১ সালের শেষের দিকে ইউক্রেন সীমান্তে লক্ষাধিক সেনা মোতায়েন করে মস্কো।
আরও পড়ুন: সামরিক বিমান বিধ্বস্ত / নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকের আহ্বান রাশিয়ার
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি দেশটিতে সামরিক অভিযান শুরুর নির্দেশ দেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এরপর প্রায় দুই বছর ধরে ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে।
ন্যাটোয় যোগদান নিয়ে এই সংকটের শুরু হলেও সংঘাত শুরুর পর ইউক্রেনকে সরাসরি সামরিক সহায়তা দেয়নি জোটটি। তবে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সব ধরনের সহযোগিতা করছে। যেটাকে বিশ্লেষকদের অনেকেই ন্যাটোর প্রক্সি যুদ্ধ বলে অভিহিত করেছেন।
কিন্তু বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম নিয়েও রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পেরে উঠছে না ইউক্রেন। এমন পরিস্থিতিতে রাশিয়াকে আরও বেশি হুমকি মনে করছেন ন্যাটোর কর্মকর্তারা।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধের প্রস্তুতি
পশ্চিমা রাজনীতিক ও সামরিক কর্মকর্তাদের মুখে ক্রমবর্ধমানভাবে যুদ্ধের সুর শোনা যাচ্ছে। তারা বলছেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ করবে ন্যাটো। সেই লক্ষ্যে এরই মধ্যে প্রস্তুতি শুরু করেছে তারা।
গত ১৯ জানুয়ারি জার্মান প্রতিরক্ষামন্ত্রী বরিস পিস্টোরিয়াস বলেন, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ন্যাটোর ওপর হামলা চালাতে পারে রাশিয়া। জার্মান সংবাদমাধ্যম দার স্পিজেলকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি আরও বলেন, আমাদের গোয়েন্দারা মনে করছেন, পাঁচ থেকে আট বছরের মধ্যে এমন হামলা হতে পারে।
জার্মান প্রতিরক্ষামন্ত্রী আরও বলেন,
আমরা প্রায় প্রতিদিনই ক্রেমলিনের কাছ থেকে হুমকি শুনছি। তাই আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে যে, (রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট) ভ্লাদিমির পুতিন একদিন যেকোনো সময় ন্যাটোর সদস্য দেশ আক্রমণ করতে পারেন।
আরও পড়ুন: বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় ইউক্রেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ রাশিয়ার
স্কাই নিউজের প্রতিবেদন মতে, গত শনিবার (২০ জানুয়ারি) ন্যাটোর সামরিক কমিটির সভাপতি ও ডাচ নৌবাহিনীর এডমিরাল রব বোয়ার বলেছেন, এমনটা নয় যে আমরা শান্তিতে রয়েছি।
ন্যাটোর এই কর্মকর্তা আরও বলেন,
আগামী ২০ বছরের মধ্যে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হতে পারে। এমন অবস্থায় রাশিয়ার বিরুদ্ধে সংঘাতের জন্য জোট প্রস্তুতি শুরু করেছে। জোটের সদস্য দেশের বেসামরিক নাগরিকদেরও সেটাই করা উচিত।
বুধবার (২৪ জানুয়ারি) শুরু হওয়া কয়েক মাসব্যাপী ব্যাপক সামরিক মহড়ার মধ্যদিয়ে কার্যত সেই যুদ্ধের প্রস্তুতির সূচনা হয়ে গেল বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। রয়টার্সের প্রতিবেদন মতে, মহড়ায় অংশ নিতে আটলান্টিক পার হয়ে ইউরোপে জোটের অঞ্চলে ট্রানজিটের জন্য ওয়াশিংটন থেকে রওনা দিয়েছে মার্কিন যুদ্ধজাহাজ।
ন্যাটো প্রকাশ্যেই বলেছে, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধের কারণেই নিজেদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা পরীক্ষা করার জন্য এই মহড়ার আয়োজন করা হয়েছে। উত্তর আমেরিকা থেকে রাশিয়ার সীমান্তের কাছাকাছি ন্যাটোর পূর্ব প্রান্ত পর্যন্ত বিশাল অঞ্চল এই মহড়ার আওতায় আনা হয়েছে।
আরও পড়ুন: যুদ্ধবন্দি না ক্ষেপণাস্ত্র, কী ছিল বিধ্বস্ত রুশ সামরিক বিমানে?
এদিকে ন্যাটোর এই সামরিক মহড়ায় কঠোর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে রাশিয়া। এই মহড়াকে স্নায়ুযুদ্ধে ফিরে আসার চূড়ান্ত ও অপরিবর্তনীয় ইঙ্গিত বলে মন্তব্য করেছেন দেশটির উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী আলেকসান্দার গ্রুশকো। তিনি বলেন, ‘রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমারা যে হাইব্রিড যুদ্ধ চালিয়েছে, তার আরেকটি উপাদান এই মহড়া।’
সাম্প্রতিক সময়
Tag: English News politics world
No comments: