বাইডেনের ‘ভুয়া উপদেষ্টা’ কাণ্ডে নিশ্চুপ যুক্তরাষ্ট্র
প্রবাসী বাংলাদেশি মিয়ান আরাফিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ‘উপদেষ্টা’ সাজিয়ে দলীয় কার্যালয়ে বিএনপি নেতারা সংলাপ করলেও, এ নিয়ে নিশ্চুপ যুক্তরাষ্ট্র। বুধবার (১ নভেম্বর) নিয়মিত ব্রিফিংয়ে কথিত ওই উপদেষ্টার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ভাষাহীন হয়ে পড়েন মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার। সময় সংবাদের প্রশ্নে কোনো উত্তরই দিতে পারেননি তিনি।
বিএনপি নেতাদের সঙ্গে জো বাইডেনের কথিত উপদেষ্টার সংবাদ সম্মেলনের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার।
গত ২৮ অক্টোবর শান্তিপূর্ণ সমাবেশের ঘোষণা দিয়ে রীতিমতো তাণ্ডব চালায় বিএনপি। পুলিশ সদস্যকে হত্যার পাশাপাশি পুরনো কায়দায় চলে আগুন সন্ত্রাস। সেদিন সন্ধ্যায় মিয়ান আরাফি নামে এক প্রবাসী বাংলাদেশিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ‘উপদেষ্টা’ সাজিয়ে দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন বিএনপি নেতারা।
আরও পড়ুন: বিএনপির সহিংসতার পর বাংলাদেশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে যুক্তরাষ্ট্র
আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদে আরাফি জানিয়েছেন, বিএনপির প্রেসক্রিপশনে বিতর্কিত সাবেক সেনা কর্মকর্তা চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী তাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন।
স্থানীয় সময় বুধবার মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলটির নেতাদের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কথিত ওই উপদেষ্টার সংবাদ সম্মেলনের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে যেন বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন ম্যাথিউ মিলার।
নানা সময়ে দেশটির পররাষ্ট্র দফতরের এই মুখপাত্র বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে কথা বললেও, এদিন কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। কোনো মন্তব্য না করে কৌশলে বিষয়টি এড়িয়ে যান মিলার।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদার করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র: মিলার
পরে আরেক প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্র পর্যবেক্ষণ করছে বলে আবারও জানান তিনি।
গত শনিবার (২৮ অক্টোবর) সন্ধ্যায় বিএনপি নেতা ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেনের সঙ্গে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আরাফির সংবাদ সম্মেলনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে এ নিয়ে হৈ চৈ সৃষ্টি হয়। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সাভারের রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় উদ্ধার কার্যক্রম নিয়ে ব্যাপকভাবে পরিচিতি পাওয়া সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী।
রোববার বিমানবন্দরে আরাফিকে আটক করে ইমিগ্রেশন পুলিশ।
বিএনপির সমাবেশ ও সংঘাত ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের প্রতিনিধিদল ওই এলাকা পরিদর্শন করেছে বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে।
ভিডিওতে নিজেকে মিয়া আরাফি নামে পরিচয় দেয়া সেই ব্যক্তি বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসসহ কোন কোন ব্যক্তিকে বার্তা পাঠিয়েছেন সে তথ্য তুলে ধরেন।
আরও পড়ুন: পাবনার বেলালই বাইডেনের কথিত উপদেষ্টা মিয়া আরাফি
এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ রাজনৈতিক মহলে আলোড়ন সৃষ্টি হলেও বিএনপির টনক নড়ে প্রায় দুই থেকে তিন ঘণ্টা পর। বিএনপির মিডিয়া সেল থেকে রাতে দেয়া এক বিজ্ঞপ্তিতে এই ব্যক্তি সম্পর্কে বলা হয়, যে ব্যক্তি সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেছেন, তার সম্পর্কে বিএনপির কাছে কোনো তথ্য নেই। ওই ব্যক্তির বিষয়ে মার্কিন দূতাবাস থেকে বিএনপিকে অবগত করা হয়নি বলেও বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
এদিকে,থে ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের মুখপাত্র এই ব্যক্তি সম্পর্কে বলেন, ‘ওই ভদ্রলোক যুক্তরাষ্ট্র সরকারের হয়ে কথা বলেন না। তিনি একজন বেসরকারি ব্যক্তি।’
বিমানবন্দরে আরাফিকে আটক ও মামলা
রোববার বিকেলে ইমিগ্রেশন পুলিশ আটক করে আরাফিকে। পরে তাকে ডিবির হাতে তুলে দেয় তারা। এরপর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ডিবি। পরে রাতে আরাফির বিরুদ্ধে রাজধানীর পল্টন থানায় মামলা হয়। রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর অভিযোগে মো. মহিউদ্দিন সিকদার নামে এক ব্যক্তি এ মামলা করেন। মামলায় তিনজনকে আসামি করা হয়েছে। বাকি দুজন হলেন: বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন এবং সাবেক সেনা কর্মকর্তা হাসান সারওয়ার্দী।
এ মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে আরাফিকে কারাগারে পাঠানো হয়।
বিএনপি শিখিয়ে এনেছিল আরাফিকে
মিয়ান আরাফিকে বিএনপির নেতারাই শিখিয়ে এনেছিলেন বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ।
হারুন বলেন, বিমানবন্দর থেকে যাকে গ্রেফতার করা হয়েছে তাকে বিএনপি নেতারা শিখিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি সব কথা স্বীকার করেছেন। তিনি একজন প্রবাসী।
আরও পড়ুন: তথ্যমন্ত্রী /বাইডেনের উপদেষ্টা পরিচয় দেয়া ব্যক্তি ইসরাইলের এজেন্ট
আরাফির বরাত দিয়ে হারুন আরও বলেন, বিএনপি নেতাকর্মীদের উৎসাহিত করতেই আরাফিকে দিয়ে মিথ্যা নাটক সাজানো হয়। যে কথাগুলো তাকে বলতে বলা হয়েছিল, বিমানবন্দরে সেগুলোই তিনি বলেছেন। আসলে এসব কথা তাকে দিয়ে বলানো হয়েছে।
আরাফির জন্য কনস্যুলার অ্যাক্সেস চায় মার্কিন দূতাবাস
মিয়ান আরাফির জন্য কনস্যুলার অ্যাক্সেস চেয়েছে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস। সোমবার (৩০ অক্টোবর) পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এ তথ্য জানিয়েছেন।
রাজধানীর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানাতে ঢাকার কূটনীতিকদের ব্রিফিং করা হয়। এতে এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জানান, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কথিত উপদেষ্টার জন্য কনস্যুলার অ্যাক্সেস (যোগাযোগ বা আলাপের জন্য অনুমতি) চেয়েছে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস। আমরা এ বিষয়ে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।
বিএনপির কার্যালয়ে ইশরাক হোসেনের পাশে মিয়ান আরাফি (লাল বৃত্তাকার চিহ্নের ভেতরে)। ছবি: সংগৃহীত
ধরা খেয়ে যা বললেন আরাফি
ডিবি কার্যালয়ে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আরাফি জানান, বিএনপি নেতা ও বিতর্কিত সেনা কর্মকর্তা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী তাকে ২৮ অক্টোবর বিএনপি কার্যালয়ে নিয়ে যান। এছাড়া সেখানে তাকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে বলেও স্বীকার করেন তিনি।
ডিবি কার্যালয়ে দেয়া বক্তব্যে আরাফি বলেন, ‘আমি ২৮ অক্টোবরের কর্মসূচির বিষয়ে বিশেষভাবে অবগত ছিলাম না। অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী আমাকে তাদের পার্টি অফিসে নিয়ে যান। সেখানে ইশরাকও উপস্থিত ছিলেন। পরে আমাকে তারা জো বাইডেনের উপদেষ্টা ও ডেমোক্রেটিক লিডার বলে পরিচয় করিয়ে দিয়ে কথা বলার অনুরোধ জানান। আমি তাদের শিখিয়ে দেয়া কথা সেখানে বলি।’
নিজের ভুল স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমাকে বিএনপি অফিসে শিখিয়ে দেয়া কথা বলানো হয়। আমি যা বলেছি তার জন্য আমি দুঃখিত, আমার ভুল হয়েছে। আমাকে তারা বুঝিয়ে দিয়েছিল কী বলতে হবে। আর আমি জানতাম না বিএনপির লোকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাকে জানানো হয়নি বিএনপির সঙ্গে সংঘর্ষে অনেক পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। এছাড়া বিচারপতির বাসভবনেও হামলা হয়েছে। বিষয়টি তারা ঠিক করেনি, আমারও ভুল হয়েছে।’
বিএনপির জ্বালাও-পোড়াওয়ের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘তাদের এমন করা ঠিক হয়নি।’
কে এই আরাফি
পাবনা জেলা সদরের দক্ষিণ রাঘবপুর এলাকায় পুরানো একতলা একটি বাড়ি আছে এ আরাফির। লোকজন তেমন নেই। মো. রইচ উদ্দিন নামে একজন ভাড়াটে থাকেন সেখানে। তিনিই বাড়িটি দেখভাল করেন। এলাকায় তিনি ‘বেলাল’ নামে পরিচিত।
মো. রইচ উদ্দিন বলেন, ‘পরিবারের সবাই যুক্তরাষ্ট্র থাকলেও গত বছরের কোরবানির ঈদ এবং গত ৩-৪ মাস আগে দুই দফা পাবনার বাড়িতে এসেছিলেন তিনি। তখন তার সঙ্গে কথা হয়েছিল।
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মিয়া আরাফি ওরফে বেলালরা ১০ ভাই-বোন। তাদের পৈতৃক বাড়ি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার সলঙ্গা থানার মানিকদিয়ার গ্রামে। তার বাবা পাবনা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ছিলেন। সেই সুবাদে পাবনা জেলা সদরের দক্ষিণ রাঘবপুর মহল্লার শায়েস্তা খাঁ সড়কে জমি কিনে বাড়ি করেন। এক সময় তারা পরিবার নিয়ে এ বাড়িতে থাকতেন। ৩০-৩৫ বছর আগে সপরিবারে আমেরিকা চলে যান। তবে এর মাঝে বেলাল বার কয়েক পাবনায় এসেছিলেন।
প্রতিবেশী হাদুল মিয়া বলেন, ‘বহু বছর থেকেই তিনি ও তার পরিবার আমেরিকায় থাকেন। গত ৩-৪ মাস আগে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। তার বাড়ির সীমানা নিয়ে আমার সঙ্গে কথা হয়। আমাদের বাড়ির সামনে রাস্তা খারাপ, তখন তিনি আমাকে বলেন যে, তার নাকি মেয়রের সঙ্গে কথা হয়েছে - এ রাস্তা তিনি ঠিক করে দেবেন। তারপর তিনি এখানে বাড়ি করবেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘পাবনার বাড়িতে এলেও তেমন কারও সঙ্গে মিশতেন না। এলাকায় তিনি বেলাল নামে পরিচিত ছিলেন। সবাই তাকে এ নামেই চেনেন।’
Tag: English News national
No comments: