যেকোনো সময় তাইওয়ান আক্রমণ করতে পারে চীন!
রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত এখনো সামাল দিয়ে উঠতে পারেনি বিশ্ব। এর মধ্যে বিশ্ব নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা আভাস দিচ্ছেন, যেকোনো সময় বাঁধতে পারে আরেকটি যুদ্ধ। চীন নিজের এতদিনের উচ্চাভিলাষ পূরণের লক্ষ্যে আক্রমণ করতে পারে তাইওয়ানে।
যুদ্ধের মহড়ায় চীনা নৌবহর। ছবি: সংগৃহীত
বিশ্ব ইতিহাস ও সভ্যতার সঙ্গে সংঘাত শব্দটি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। এমন কোনো শতাব্দী যায়নি, যেখানে যুদ্ধ হয়নি। যুদ্ধের ধরণ বদলেছে, পরিবর্তন হয়েছে কলাকৌশল। কিন্তু দিন শেষে বাইবেলের বাণীর মতো এ কথাও সত্য যে, এই পৃথিবী পৃষ্ঠে এখন আর কোনো কিছুই নতুন না।
রাশিয়া যখন ইউক্রেন আক্রমণ করল, তখন পশ্চিমারা রাশিয়াকে রুখতে দেশটির ওপর সহস্রাধিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। এই রণকৌশল বহুদিনের পুরনো। যখন কোনো দেশকে অন্য দেশ নাস্তানাবুদ করতে চাইতো তখন তাদের রসদ বাজেয়াপ্ত ও নতুন রসদ আসার পাইপলাইন বন্ধ করে দেয়া হতো। আগে প্রাচীর ঘেরা ছোট ছোট নগর রাষ্ট্র অবরোধ করে তাদের অভাবের মধ্যে ফেলে যুদ্ধ জয় করতো আক্রমণকারীরা। এখন দৃশ্যমান সৈন্য-সামান্ত নিয়ে সীমান্তে অবরোধ দেয়া সম্ভব না হলেও, নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে প্রয়োগ করা হয় নতুন রূপে পুরনো নেই অস্ত্র।
আশির দশকের স্নায়ু যুদ্ধের সময় দেখা গেছে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধের আঁচ পাওয়া মাত্র নিজেদের রসদ জোগাড়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। খাদ্য তো বটেই সোভিয়েত স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচির মাধ্যমে বিশাল বিশাল ব্লাড ব্যাংকের বন্দোবস্ত করেছিল। সাবেক সোভিয়েত তথা বর্তমান রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সংঘাতের ইতিহাস পুরনো। তবে বর্তমান যুক্তরাষ্ট্রের যতটা না বড় শত্রু রাশিয়া, তার থেকে ঢের বড় শত্রু চীন।
আরও পড়ুন: চীনের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি, মার্কিন নৌবাহিনীর ২ নাবিক গ্রেফতার
অঘোষিতভাবে চলছে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক যুদ্ধ। সেমিকন্ডাকটারই হোক বা যেকোনো খাদ্যপণ্য আমদানি-রফতানি হোক, কেউ কাউকে ছাড় দিতে একেবারেই নারাজ। অনেক অর্থনীতিবিদ বলছেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে চীন যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে যাবে। পাবে সুপারপাওয়ারের তকমা। তবে এতদিনের মুকুটধারী যুক্তরাষ্ট্রও ছাড়বার পাত্র নয়। ভূরাজনীতিতে চীনের দুর্বলতা যেখানে তাইওয়ান, সেখানেই বারবার চীনকে আঘাত করছে পশ্চিমা এ দেশটি। এতে করে চীন বুঝে গেছে, যুদ্ধ ছাড়া তাইওয়ান অধিকারের আর কোনো রাস্তা খোলা নেই।
তবে অনেকের মনেই প্রশ্ন তাইওয়ানের যে ভৌগলিক অবস্থান, তাতে দ্বীপ রাষ্ট্রটিকে আক্রমণ করা চীনের জন্য আদৌ বুদ্ধিমানের কাজ হবে কি-না। তার থেকে বড় কথা অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাওয়া চীন যুদ্ধ বাঁধালে এবং গণনিষেধাজ্ঞার শিকার হলে সামাল দিবে কীভাবে?
আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের পর্যবেক্ষণ অনুসারে, চীন বহুদিন ধরে তাইওয়ান আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। নিজেদের সেনাবাহিনীর আকার ও সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সম্ভাব্য সব ধরণের নিষেধাজ্ঞা সামাল দেয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে এশিয়ার শক্তিমান এই দেশটি।
সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ইকনোমিস্টকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গ্যাব্রিয়েল কোলিন্স বলেন, চীন জ্বালানি, খাদ্য ও শিল্প কারখানার জন্য প্রয়োজনীয় ধাতব দ্রব্যাদি মজুত করছে। যুদ্ধ শুরু হলে যাতে কোনোভাবে জ্বালানি সংকট না হয়, খাদ্যে টান না পড়ে ও কারখানায় অস্ত্র তৈরির প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি যাতে থাকে- সে লক্ষ্যেই নিজেকে প্রস্তুত করছে চীন।
জ্বালানি মজুত
সম্প্রতি চীনের জ্বালানি আমদানির জরিপ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দেশটি তার ব্যবহারযোগ্য মোট জ্বালানির চার ভাগের তিন ভাগই আমদানি করে। তবে বর্তমানে চীন যে পরিমাণে জ্বালানি আমদানি করছে তার মাত্র ২০ শতাংশ ব্যবহার করছে। গত তিন মাসে চীনের তেল আমদানি বেড়েছে কয়েকগুণ, কিন্তু সে তুলনায় আমদানিকৃত তেলের ব্যবহার বেড়েনি। উল্টো চীন জ্বালানি তেল ব্যবহারে সাশ্রয়ী হচ্ছে।
আরও পড়ুন: চীনের মহড়ার পরদিনই তাইওয়ান প্রণালীতে মার্কিন যুদ্ধবিমান
একদিকে তেল ব্যবহারে সাশ্রয়ী হচ্ছে চীন, অন্যদিকে নিজেদের তেলের রিজার্ভ বাড়াচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, চীন নিজেদের রিজার্ভের আকার ও ধারণ ক্ষমতা বাড়াচ্ছে এবং এমন সব জায়গায় তেল জমা রাখছে যা খুঁজে পাওয়া কঠিন। যে হারে জ্বালানি সঞ্চয় করছে চীন, তাতে আভাস পাওয়া যাচ্ছে বড় কোনো পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে দেশটি। যদিও সৌদির সঙ্গে চীনের সম্পর্ক বর্তমানে বেশ উষ্ণ। তবে চীন নিজেকে এমনভাবে প্রস্তুত করছে যাতে যুদ্ধ শুরু হলে নিজের রিজার্ভে থাকা তেল দিয়েই বছরখানেক সামাল দেয়া যায়।
যদিও চীনের প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রয়োজনীয়তা অপেক্ষাকৃত কম, তবে রসদে তেলের বিকল্প হিসেবে গ্যাস কিনে রেখেছে চীন। পশ্চিমাদের ওপর প্রতিশোধ নিতে রাশিয়া যখন নর্ড স্ট্রিম-১ পাইপলাইন বন্ধ করে দেয়, তখন দেশটির ৯১ শতাংশ গ্যাস কিনে নেয় চীন। চীনের রাষ্ট্রায়াত্ত জ্বালানি বিষয়ক ২০টি কোম্পানি রাশিয়া থেকে গ্যাস কিনেছে; যেখানে নয়টি কোম্পানিই প্রথমবারের মতো গ্যাস কেনার সিদ্ধান্ত নেয়।
এবার প্রশ্ন হচ্ছে, প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রয়োজনীয়তা না থাকার পরেও চীন কেন গ্যাস কিনছে? এ ব্যাপারে বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনের নিজস্ব কয়লার কোনো কমতি নেই। তারপরও গ্যাস কেনার পেছনে দুটি যুক্তি আছে। প্রথমত, তাইওয়ান আক্রমণ নিয়ে চীন নিজেদের জ্বালানিতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা রাখতে চায় না। অন্যদিকে রাশিয়ার থেকে কম দামে কেনা গ্যাস পরে বেশি দামে বিক্রি করে লাভবান হওয়ার বাসনা। এতে করে যুদ্ধের খরচ চালাতে সুবিধা পাবে দেশটি।
খাদ্য মজুত
জ্বালানির পাশাপাশি খাদ্য মজুতের দিকেও জোর দিচ্ছে চীন। একদিকে যেমনি ট্যাংকের রসদ জ্বালানি ঠিক রাখছে, অন্যদিকে মানুষের রসদ খাদ্যকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখছে শি জিনপিং এর দেশটি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিভাগের ২০২১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চীনের কাছে যে পরিমাণে গম মজুত আছে তা দিয়ে অনায়াসে দেশটির দেড় বছর চলে যাবে। এত বড় মজুত থাকার পরেও দেশটি দেদারসে খাদ্য আমদানি করছে। শুধু গম না; ভুট্টা, চাল ও সয়াবিনের মতো খাদ্য আমদানি করে জমা করছে চীন।
চীন নিজেদের সয়াবিনের মজুতের ৮৪ শতাংশই পূর্ণ করেছে আমদানির মাধ্যমে। অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছে, এত সয়াবিন দিয়ে কী করবে দেশটি। মূলত চীনে মাংসের চাহিদার ৬০ শতাংশ পূরণ হয় শূকরের মাংস থেকে। আর শূকরের প্রধান খাদ্য সয়াবিন। অর্থাৎ শস্য আমদানি করলেও, আমিষের ব্যাপারটিও মাথায় রেখেছে চীন।
আরও পড়ুন: তাইওয়ানকে সাড়ে ৩৪ কোটি ডলারের সামরিক সহায়তা দেবে যুক্তরাষ্ট্র
মার্কিন সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা এবং বর্তমানে দেশটির কৃষিবিভাগে কর্মরত গুস্তাভ ফেরিরা বলেন, চীন যেভাবে শস্য কিনছে তা স্বাভাবিক না। না দেশটির মানুষের বর্তমান চাহিদার সঙ্গে তাদের শস্য ক্রয়ের সামঞ্জস্যতা আছে, না তাদের গবাদি পশুর সংখ্যা হিসাব করলে এই ক্রয়ের যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যাবে। চীনের কাছে বর্তমানে গবাদি পশুর জন্য যে পরিমাণ খাদ্য মজুত আছে তা দিয়ে অনায়াসে দুই মাস চলে যাবে। কিন্তু এর পরেও ব্যাপকহারে শস্য আমদানি করছে দেশটি। এতে করে চীন যে যুদ্ধের জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিচ্ছে এ সন্দেহ আরও ঘনীভূত হচ্ছে।
ধাতব দ্রব্যাদি মজুত
জ্বালানি ও খাদ্যের পাশাপাশি চীনের দৃষ্টি এখন ধাতব দ্রব্য ক্রয়ে। বিশেষ করে অস্ত্র তৈরিতে যেসব ধাতু ব্যবহার করা হয় তা কিনে রাখছে চীন। হঠাৎ করে চীন বেরিলিয়াম ও নিওবিয়ামের মতো ধাতু কেনা বাড়িয়ে দিয়েছে। মূলত অত্যাধুনিক অস্ত্রের গিয়ার তৈরিতে এ দুটি ধাতু ব্যবহৃত হয়। এর পাশাপাশি প্লাটিনাম ও প্যালাডিয়াম আমদানি করছে দেশটি। ট্যাংকের ইঞ্জিন তৈরিতে এসব ধাতুর ব্যবহার সর্বজনবিদিত।
ধাতু আমদানির পাশাপাশি রফতানিও সীমিত করেছে দেশটি। চলতি বছরের জুলাইতে যুক্তরাষ্ট্রে গ্যালিয়াম ও জার্মেনিয়াম আমদানি সীমাবদ্ধ করেছে চীন। মূলত চিপ ও সেমিকন্ডাক্টর তৈরিতে এসব ধাতু ব্যবহার করা হয়ে থাকে। চীনের এমন সিদ্ধান্ত অঘোষিতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টেক-যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে পশ্চিমারা।
ইকনোমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীন এমন সব দেশের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক উন্নত করতে শুরু করেছে যারা তাইওয়ানে চীনের আক্রমণ করা না করা নিয়ে মাথা ঘামায় না। অন্যদিকে নানা কারণে এসব দেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্বও কম; তাই তাদের নিষেধাজ্ঞা নিয়েও কোনো ঝামেলা নেই। এত বিকল্প রাস্তা খোলা থাকার পরেও চীনের এসব প্রস্তুতির মূল কারণ যেকোনো পরিস্থিতিতে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া।
অর্থনীতির কূটচাল
ডলার নিয়ে আসল শিক্ষাটি চীন পেয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে। রাশিয়াকে সুইফট থেকে বের করে দেয়া, দেশটির ডলারের মজুত বাজেয়াপ্ত করা থেকে অন্যান্য অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা চীনকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে- আর যা হোক ডলারের ওপর ভরসা করলে ভুগতে হবে। তাইতো নতুন করে চীন যাদের সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তি করছে সেখানে ডলারের পরিবর্তে ব্যবহার করছে নিজস্ব মুদ্রা ইউয়ান। নিজেদের রিজার্ভ থেকে ডলার এবং ইউরোর আধিপত্য কমিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার সব ধরণের চেষ্টা করছে দেশটি।
আরও পড়ুন: চীনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভুল করেছি: ইতালির প্রতিরক্ষামন্ত্রী
অনেক নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলছেন, চীন এখনো তাইওয়ান আক্রমণ করছে না, এর মূল কারণ দেশটি নিজেদের মুদ্রাব্যবস্থা ও অর্থনীতিকে ঢেলে সাজাতে আরও কিছুদিন সময় নিচ্ছে। তবে সৌদি থেকে শুরু করে শক্তিমান দেশগুলোর সঙ্গে ইউয়ানে চুক্তি চীনকে তাইওয়ান আক্রমণে আরও আশাবাদী করে তুলছে।
কবে নাগাদ চীন তাইওয়ান আক্রমণ করতে পারে তার দিনক্ষণ সঠিক জানা না গেলেও, পশ্চিমারা ধারণা করছে যেকোনো সময়ে চীন আরেকটি যুদ্ধের সূচনা করতে পারে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বিশ্ব নিরাপত্তা নিয়ে দেয়া বক্তৃতায় যখন বলেন, 'সমুদ্র ঝড় উঠতে যাচ্ছে' তখন বুঝতে বাকি থাকে না প্রশান্ত মহাসাগর অশান্ত হতে খুব বেশি দেরি নেই।
Tag: English News others world
No comments: