ইরান কি পরমাণু অস্ত্র তৈরি করছে?
সামরিক শক্তিতে বর্তমান বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলোর একটি ইরান। গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ারের তথ্য মতে, ১৪৫টি দেশের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশটির অবস্থান ১৭তম।
সম্প্রতি খোররামশাহর নামের এ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করে ইরান। ছবি: সংগৃহীত
১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর টানা কয়েক দশকের পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মুখেও স্থল, আকাশ ও সমুদ্রসীমায় প্রয়োজনীয় প্রতিরক্ষা চাহিদার সবটুকুই অর্জন করেছে দেশটি।
বহুদিন ধরে পরমাণু কর্মসূচী চালিয়ে আসছে ইরান। দেশটির কর্মকর্তারা বলছেন, পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন ও অন্যান্য শান্তিপূর্ণ উদ্দেশে ব্যবহারের জন্যই তাদের এই কর্মসূচী।
আরও পড়ুন: ইরান পরমাণু বোমা তৈরি করতে সক্ষম
তবে পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের নেতারা বলছেন, কর্মসূচীর আড়ালে পরমাণু অস্ত্র তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে দেশটি। শুধু বলেই ক্ষান্ত হয়নি। এজন্য দেশটির ওপর গত কয়েক দশক ধরে একের পর এক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে তারা।
পশ্চিমা গণমাধ্যমে প্রায়ই এমন খবর প্রচার করা হয় যে ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরির দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। যেকোনো সময় তারা এই মারণাস্ত্র তৈরি করে ফেলতে পারে। তবে তেহরান এ ধরনের খবরকে গুজব ও পশ্চিমা গণমাধ্যমের গল্প বলে অভিহিত করেছে।
ইরান পরমাণু চুক্তি
সামরিকভাবে শক্তিশালী ইরানকে প্রায়ই ‘নিরাপত্তা হুমকি’ হিসেবে উল্লেখ করে আসছে পশ্চিমারা। পরমাণু অস্ত্র তৈরি করে ফেললে দেশটি আরও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে-এমনটা আশঙ্কা তাদের।
সেই আশঙ্কা থেকে সম্প্রতি তেহরানের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে তারা। কয়েক বছরের আলোচনা শেষে ২০১৫ সালে উভয় পক্ষের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং পরের বছর তথা ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে কার্যকর হয়।
চুক্তিটির আনুষ্ঠানিক নাম ‘জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্লান অব অ্যাকশন’। তবে এটি ইরান পরমাণু চুক্তি হিসেবেই বেশি পরিচিত। চুক্তিটি হয়েছিল ইরান ও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য দেশ যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের মধ্যে। সঙ্গে ছিল জার্মানিও। এজন্য এই পক্ষকে ‘পি৫ + ১’ বলা হয়ে থাকে।
এই চুক্তিতে ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ ও মজুদ করার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। চুক্তি অনুসারে তেহরান তাদের কিছু পরমাণু স্থাপনা বন্ধ করে দিতে অথবা পরিবর্তন করতে সম্মত হয়।
এছাড়া ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলো পরিদর্শনের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক পরিদর্শকদের অনুমতিও দেয়া হয়। চুক্তির অধীনে ইরানের ওপর আরোপিত বেশ কিছু অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাও প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।
আরও পড়ুন: ইরান পরমাণু চুক্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে হুশিয়ারি মোসাদ প্রধানের
এই চুক্তির মধ্যদিয়ে পি৫ + ১ তথা পশ্চিমা পক্ষ এটা নিশ্চিত করতে চেয়েছিল যে ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা করবে না। যদিও ইরান বরাবরই এধরনের চেষ্টার কথা নাকচ করে এসেছে।
অন্যদিকে ইরানের প্রত্যাশা ছিল, নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হলে তাদের বিপর্যস্ত অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠবে। জাতিসংঘ ও পশ্চিমাদের দেয়া অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ফলে তাদের অর্থনীতি অনেকটাই ভেঙে পড়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলে চুক্তিটি স্বাক্ষর ও কার্যকর হয়। কিন্তু দুই বছর না যেতেই চুক্তিটিকে ‘বাজে ও ত্রুটিপূর্ণ’ আখ্যা দিয়ে তা থেকে একতরফাভাবে সরে যাওয়ার ঘোষণা দেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এরপর ২০১৮ সালে চুক্তি থেকে বের হয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্র।
শুধু তাই নয়, এরপরপরই ইরানের ওপর একের পর এক কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিতে থাকে ওয়াশিংটন। ফলে ওই চুক্তি তার কার্যকারিতা হারায়। ইরানও তার পরমাণু কর্মসূচি নতুন করে শুরু করে। এতে যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্কে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দেয়।
২০২০ সালের শুরুর দিকে পরমাণু চুক্তি থেকে সরে আসার ঘোষণা দেয় ইরান। দেশটির পক্ষ থেকে বলা হয়, চুক্তির ফলে তাদের পরমাণু কর্মসূচির ওপর যেসব নিষেধাজ্ঞা ছিল তা আর মানা হবে না। আরও বলা হয়, বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ও গবেষণার কাজে আর কোনো সীমাবদ্ধতা রাখবে না ইরান।
এরপর ২০২০ সালে জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর ওই চুক্তি নিয়ে আবারও উৎসাহ দেখায় যুক্তরাষ্ট্র। এরপর ইরানের সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর আবারও আলোচনা শুরু হয়।
এরপর গত কয়েক মাস আলোচনার পর গত বছরের (২০২২) আগস্টে একটি চূড়ান্ত খসড়া চুক্তি তৈরি হয়। তবে এখন পর্যন্ত চুক্তি স্বাক্ষর হয়নি। আলোচনাও স্থগিত হয়ে আছে। উভয় পক্ষ একে অপরের বিরুদ্ধে অযৌক্তিক দাবি করার অভিযোগ এনেছে।
ইরান কি পরমাণু তৈরি করছে?
ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরি করছে কিনা এটা বলা কঠিন। পশ্চিমারা এখনও সেই আগের মতোই বলছে, তেহরান পরমাণু অস্ত্র তৈরির কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। এদিকে ইরানি কর্মকর্তারাও বলছেন, তারা কোনো অস্ত্র তৈরি করছেন না। আর তৈরি করলে কেউ তাদের ঠেকাতে পারবে না।
গত বছরের (২০২২) নভেম্বরে জাতিসংঘের পরমাণু পর্যবেক্ষক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি তথা আইএইএ জানায়, চুক্তির থেকে সরে গিয়ে যাওয়ার পর ইরান নিজেদের ফোরদো ভূগর্ভস্থ পরমাণু কেন্দ্রে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের কাজ শুরু করেছে এবং দিনদিন পারমাণবিক সক্ষমতা বাড়িয়ে চলেছে।
এরপর চলতি বছরের জানুয়ারিতে আইএইএর প্রধান রাফায়েল গ্রোসি বলেন, ‘ইরান কয়েকটি পরমাণু অস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় ইউরেনিয়াম সংগ্রহ করে ফেলেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘তেহরান এখনও পরমাণু অস্ত্র তৈরি করেনি। তবে যেকোনো সময় তৈরি করে ফেলতে পারে। অস্ত্র তৈরি করা ঠেকাতে পশ্চিমা দেশগুলোর এখনই উদ্যোগ নেয়া উচিৎ।’
গ্রোসি আরও বলেন, ‘৯৯ শতাংশের বেশি সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম থেকে পরমাণু অস্ত্র করা যায়। ইরান ৭০ কিলোগ্রাম (১৫৪ পাউন্ড) ইউরেনিয়াম ৬০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ করে ফেলেছে।’
আরও পড়ুন: নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করলে ইরান পরমাণু চুক্তি মেনে চলবে : তেহরান
গত মাসে (১১ জুন) ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি বলেন, ‘তেহরান যদি পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি চালিয়ে যেতে চায়, তাহলে পশ্চিমারা চাইলেও ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করা থেকে আটকাতে পারবে না।’
খামেনি আরও বলেন, ‘তেহরানের পারমাণবিক অস্ত্র সম্পর্কে কথাবার্তা মিথ্যা এবং তারা (পশ্চিম) এটা জানে’। তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে পারমাণবিক অস্ত্র চাই না। অন্যথায় তারা এটি বন্ধ করতে পারত না।’
ইরানের পরমাণু কর্মসূচী নিয়ে চলতি সপ্তাহে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে মার্কিন গোয়েন্দারা। গত সোমবার (১০ জুলাই) প্রকাশিত অফিস অব দ্য ডিরেক্টর অব ন্যাশনাল ইনটেলিজেন্স-এর ওই রিপোর্টে ইরানি কর্মকর্তাদের বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি করা হয়েছে।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, ইরান কোনো পরমাণু অস্ত্র তৈরি করছে না। তবে তারা পরমাণু সক্ষমতা বৃদ্ধি করছে। এর ফলে তেহরানের পক্ষে পরমাণু অস্ত্র তৈরি আরও সহজ হবে বলেও রিপোর্টে মন্তব্য করা হয়েছে।
সূত্র: ফক্স নিউজ, বিবিসি, রয়টার্স ও সিএনএন
Tag: English News lid news world
No comments: