ঋষি সুনাকের সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ
অনেকটা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়ই যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির নেতা নির্বাচিত হয়েছেন ভারতীয় বংশোদ্ভুত সাবেক অর্থমন্ত্রী ঋষি সুনাক। ফলে প্রথমবারের মতো ব্রিটিশ-এশীয় রাজনীতিক হিসেবে ইউরোপীয় দেশটির প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন তিনি।
মঙ্গলবারই (২৫ অক্টোবর) তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব নিতে পারেন। তবে যুক্তরাজ্য এই মুহূর্তে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে যেসব সংকটের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে, তাতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন তার জন্য খুব একটা সহজ হবে না। এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
সুনাকের সামনে বেশ কয়েকটা চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। এই মুহূর্তে যুক্তরাজ্যের সমস্যাগুলোর তালিকায় প্রথমেই রয়েছে লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতি, চলমান শ্রমিক ধর্মঘট, স্বাস্থ্যখাত সংকট ও সর্বোপরি রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত। তবে সুনাকের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হতে যাচ্ছে অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখা।
ব্রিটিশ অর্থনীতি যে মন্দার কবলে পড়েছে সেখান থেকে টেনে তোলার চেষ্টা করতে হবে সুনাককে। একই সঙ্গে নৈতিকভাবে ভেঙে পড়া ও শতধা বিভক্ত দলকে নতুন করে ঐক্যবদ্ধ করার কঠিন কাজটাও তাকেই করতে হবে।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে জয়ী হওয়ার পরপরই নিজের প্রথম ভাষণে সামনে যে গভীর অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ তা নিয়ে কথা বলেছেন সুনাক। ২ মিনিটেরও কম সময়ের ওই ভাষণে তিনি বলেন, ‘যুক্তরাজ্য একটা বিশাল দেশ। তবে সন্দেহ নেই, এই মুহূর্তে একটা বড় অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে আমরা আছি।’
সুনাক তার ভাষণে ঘোরতর এই অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রয়োজন বলেও উল্লেখ করেছেন। তার কথায়, ‘আমাদের এখন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও ঐক্য প্রয়োজন। দেশ ও দলকে একটা জায়গায় ঐক্যবদ্ধ করাই হবে আমার প্রথম কাজ।’
বাস্তবিকই সাবেক অর্থমন্ত্রী সুনাকের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে এমন একটা সময়ে তিনি দায়িত্ব নিচ্ছেন যখন যুক্তরাজ্য রাজনৈতিক বিবেচনায় গভীরভাবে বিভক্ত। এছাড়া অর্থনৈতিক সংকটের কারণে লাখ লাখ নাগরিক নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়ার পথে।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এতসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও সেগুলো সমাধানের ব্যাপারে সুনাককে আত্মবিশ্বাসী বলেই মনে হচ্ছে। যেমনটা বলছেন আল জাজিরার অ্যান্ড্রি সিমনস।
সোমবার (২৪ অক্টোবর) লন্ডন থেকে তিনি বলছিলেন, ‘একদিক থেকে তার (সুনাকের) বেশ কিছু কাজ এরইমধ্যে সম্পন্ন হয়ে গেছে। আর সেটা হয়েছে সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসের যে নতুন পরিকল্পনা ও সংক্ষিপ্ত বাজেট বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছিল তা প্রশমনের মাধ্যমে।’
আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই নতুন প্রধানমন্ত্রীকে একটা অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রকাশ করতে হবে। সেই পরিকল্পনায় যুক্তরাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নত করার চেষ্টায় কিছু কঠোর পদক্ষেপও তিনি নিতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে। তবে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তিনি কি কি করতে যাচ্ছেন তা স্পষ্ট নয়।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকট
নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সংকটের কবলে পড়েছে যুক্তরাজ্য। উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে দেশটির অর্থনৈতিক সক্ষমতা আগের মতো নেই। মুদ্রাস্ফীতি ১০ শতাংশ ছাড়িয়েছে যা এই মুহূর্তে জি৭ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। ফলে জ্বালানি ও খাদ্যের দাম আকাশচুম্বী।
ঋণমান যাচাইকারী বৈশ্বিক সংস্থা মুডি জানিয়েছে, যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি ‘স্থিতিশীল’ অবস্থা থেকে ‘নেতিবাচক’ পর্যায়ে চলে গেছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাজ্যে সরকারি ঋণ বেড়েছে। সেই সঙ্গে আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে খুচরা কেনাবেচা।
যুক্তরাজ্যের পরিসংখ্যান কার্যালয় জানিয়েছে, গত সেপ্টেম্বরে দেশটির ঋণ ছিল ২০ বিলিয়ন (১ বিলিয়নে ১০০ কোটি) পাউন্ড ছাড়িয়েছে। অর্থনীতিবিদদের ধারণার চেয়ে এ ঋণের অঙ্ক তিন বিলিয়ন বেশি। বেশি ঋণ নেয়ার কারণে গত সেপ্টেম্বর মাসে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় আড়াই বিলিয়ন পাউন্ড বেশি সুদ দিতে হয়েছে দেশটিকে। ১৯৯৭ সালের পর এবারই সর্বোচ্চ সুদ পরিশোধ করেছে দেশটি।
ক্ষমতায় আসার পর ‘মিনি বাজেট’ দিয়ে এ সংকট মোকাবিলার চেষ্টা করেছিলেন লিজ ট্রাস। মূলত কর ছাড়সহ নানা ধরনের ছাড়ের ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। এ প্রক্রিয়ায় ২০২৭ সালের মধ্যে মোট ৪৫ বিলিয়ন পাউন্ড কর ছাড় দেয়া হবে বলে জানানো হয়। এর ফলে সংকট সমাধানের বদলে পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়। যে কারণে লিজ ট্রাসের পতন। তাই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে সেই সমস্যাগুলোই আগে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে সুনাককে।
ক্ষমতাসীন টোরি পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ করা
কনজারভেটিভ পার্টিকে টোরি পার্টিও বলা হয়। দলটি গত প্রায় ১২ বছর ধরে যুক্তরাজ্যের শাসনক্ষমতায়। একই সঙ্গে বিশাল একটা সময় ধরে ক্ষমতা আকড়ে থাকার ফলে দলটি এ মুহূর্তে অন্তর্কোন্দলের কারণে এ যাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিভক্ত। দায়িত্ব নেয়ার তিন বছরের মাথায় নিজের মন্ত্রিসভার সদস্যদের আস্থা হারিয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন।
বরিসের পর দায়িত্ব নেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ ট্রাস। কিন্তু নিজ দলের এমপি ও মন্ত্রীদের চাপের মুখে মাত্র ৪৫ দিন পরই দায়িত্ব ছেড়ে দিলেন তিনি। ২০১৬ সালের পর পঞ্চম টোরি নেতা ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন সুনাক। হাউস অব কমন্সের সংখ্যাগরিষ্ঠ টোরি এমপিই তাকে সমর্থন জানিয়েছেন।
তা সত্ত্বেও দলের ভেতরে বড় বিভাজন দেখা যাচ্ছে। বরিস জনসনের সমর্থক এমপির সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়। বরিসের পদত্যাগের পেছনে সুনাকের বড় ভূমিকা ছিল; যাকে বরিস সমর্থকরা ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ হিসেবেই দেখে আসছে। দলের নেতা হওয়ার পর সুনাক টোরি এমপিদের উদ্দেশে ঐক্যের বার্তা দিয়েছেন। কিন্তু সেই কাজটা নিশ্চিতভাবেই অন্য কেউ করে দেবে না। আর এটাই সুনাকের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ।
বিরোধীদের আগাম নির্বাচনের দাবি
ক্ষমতাসীন টোরিদের দুর্বলতার সুযোগে আবারও সোচ্চার হয়েছে বিরোধীরা। বিরোধীদল লেবার পার্টি আবারও সাধারণ নির্বাচনের ডাক দিয়েছে। স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি, লিবারেল ডেমোক্র্যাটস ও গ্রিন পার্টিও সাধারণ নির্বাচন দাবি করেছে। তবে সুনাক আগাম নির্বাচন নাকচ করেছেন এবং দলকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, নতুবা দল শেষ হয়ে যাবে।
লেবার পার্টির উপনেতা অ্যাঞ্জেলো রেইনার টুইট করেছেন, ‘যে ব্যক্তি ক্ষমতায় গিয়ে কী করবেন তা নিয়ে বিন্দুমাত্র কিছু বলেননি, তাকেই কনজারভেটিভ পার্টি তাদের নেতা বানিয়েছে। ব্রিটিশ জনগণ নতুন নির্বাচন চায়।’
লিবারেল ডেমোক্র্যাট নেতা এড ডেভি এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘দেশের বর্তমান বাস্তব পরিস্থিতির সাথে যার কোনো সম্পর্ক নেই তেমন একজনকে কনজারভেটিভ পার্টি তাদের নেতা নির্বাচিত করেছে। টোরি ব্রিটিশ অর্থনীতির যে সর্বনাশ করেছে তা তিনি কিভাবে ঘোচাবেন সে ব্যাপারে তার কোনো প্রতিশ্রুতি নেই। এখন একমাত্র সমাধান নতুন নির্বাচন।’
ইউক্রেন সংকট
ইউক্রেনের পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোয় যোগদান ঠেকাকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে দেশটিতে সামরিক অভিযান শুরু করে রাশিয়া। এরপর প্রায় আট মাস ধরে সেই অভিযান অব্যাহত রয়েছে এবং এখন পর্যন্ত থামার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাতে সেই শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও ফ্রান্সসহ ইউরোপের অন্য দেশগুলোর পাশাপাশি কিয়েভকে সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে আসছে যুক্তরাজ্য।
নিজ দেশের অর্থনৈতিক সংকট ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে ইউক্রেনকে যুক্তরাজ্যের সামরিক ও আর্থিক সহযোগিতা চালিয়ে নিতে বাড়তি চাপের মুখে থাকবেন সুনাক। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যদি অভিযান আরও জোরদার করেন, সেক্ষেত্রে কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাতে হবে বা কী পদক্ষেপ নেয়া হবে সে বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে তাকে। পাশাপাশি নিজ দেশের সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি নিয়ে টোরি এমপিদের পক্ষ থেকে চাপ মোকাবিলা করতে হবে।
Tag: English News others world
No comments: