যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে বেড়েই চলেছে দক্ষিণ এশীয়দের প্রভাব
যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে দক্ষিণ এশীয়দের প্রভাব দিন দিন বেড়েই চলেছে। দেশটির রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্ব শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদও অলংকৃত করছেন দক্ষিণ এশীয়রা। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মাধ্যমে যার সবশেষ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন ভারতীয় ও পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত রাজনীতিক ঋষি সুনাক।
প্রায় দুইশ বছর দক্ষিণ এশিয়ার বিশাল একটা অঞ্চল শাসন করেছে ব্রিটেন তথা যুক্তরাজ্য। বিশাল একটা সময় ধরে ঔপনিবেশিক শাসনের কারণে এ অঞ্চল থেকে দেশটিতে ব্যাপক অভিবাসন ঘটে, যা এখনও চলমান রয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর অন্যতম যুক্তরাজ্য। উদার গণতান্ত্রিক রাজনীতির সুবাদে দেশটিতে দক্ষিণ এশীয়দের প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ইউরোপের মধ্যে দক্ষিণ এশীয়দের প্রভাব সবচেয়ে বেশি এই যুক্তরাজ্যেই। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় কনজারভেটিভ পার্টি ও লেবার পার্টি-এই দুটি দলের মধ্যেই ক্ষমতার অদল বদল হয়। আরও কিছু দলের ভোটব্যাংক ক্রমে বাড়লেও এখনও সরকার গড়ার মতো অবস্থানে নেই। ফলে প্রধান দুই দলেই বেশি সক্রিয় দক্ষিণ এশীয়রা।
ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির পাশাপাশি বিরোধী লেবার পার্টিতেও দক্ষিণ এশীয় বিশেষ করে ভারতীয়, পাকিস্তানি ও বাংলাদেশিদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। প্রধানমন্ত্রী পদ ছাড়াও মেয়রের মতো আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সামলাচ্ছেন তারা।
প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক
জন্মসূত্রে ব্রিটিশ নাগরিক সুনাক। তার মা-বাবার জন্ম কেনিয়ার নাইরোবিতে। সেখান থেকেই তারা যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান। তবে তার দাদা-দাদির জন্ম অবিভক্ত ভারতের গুজরানওয়ালায়। বর্তমানে জায়গাটা পাকিস্তানের পাঞ্জাবের অন্তর্ভুক্ত। দাদা-দাদির সুবাদে সুনাককে ভারতীয় বংশোদ্ভূত বলা যায়। সেদিক থেকে তিনি পাকিস্তানি বংশোদ্ভূতও।
১৯৮০ সালে যুক্তরাজ্যের সাউদাম্পটনে জন্ম ঋষির। মেধার স্বাক্ষর রেখে ছাত্রজীবন শেষে লোভনীয় চাকরি দিয়ে পেশাজীবনের শুরু। পরবর্তীতে বিনিযোগ ব্যবসার মাধ্যমে এক সফল ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন। তার স্ত্রী বিশ্ববিখ্যাত বহুজাতিক ব্যবসায়ী এনআর নারায়ণমূর্তির কন্যা।
ফলে সব মিলিয়ে দ্রুতই যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে পাকা আসন করে নেন ঋষি। কনজারভেটিভ দলের সদস্য হন। অবশেষে দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে গত সোমবার (২৪ অক্টোবর) অনেকটা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কনজারভেটিভ পার্টির নেতা নির্বাচিত হন।
পরদিন মঙ্গলবার (২৫ অক্টোবর) রাজা তৃতীয় চার্লসের অনুমতিক্রমে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন। তার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার খবরে উচ্ছ্বসিত ভারতীয়রা। একইভাবে উচ্ছ্বাস দেখা গেছে পাকিস্তানেও।
লন্ডন মেয়র সাদিক খান
২০১৬ সালে কনজারভেটিভ ও লেবার পার্টির ভোট যুদ্ধে বেশ কিছু চমক দেখা গিয়েছিল। ওই ভোটযুদ্ধে লেবার পার্টি থেকে প্রথমবারের জন্য কোনো দক্ষিণ এশীয় লন্ডনের মেয়র হন সাদিক খান।
একই সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত কোনো দেশের রাজধানী শহরের প্রথম মুসলিম মেয়রও তিনি। মেয়র হিসেবে সফলতার পুরস্কার হিসেবে ২০২১ সালে দ্বিতীয়বার মেয়র নির্বাচিত হন তিনি।
সাদিক খানের জন্ম ১৯৭০ সালে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে। বাবা-মায়ের আট সন্তানের অন্যতম তিনি। তার জন্মের কিছুদিন আগে ১৯৬৮ সালে বাবা আমানুল্লাহ খান ও মা সেহেরুন খান পাকিস্তান থেকে লন্ডনে আসেন। সেখানে প্রথম জীবনে তারা থাকতেন দক্ষিণ লন্ডনে দরিদ্রদের জন্য তৈরি সরকারি ফ্ল্যাটে।
দারিদ্র্য সত্ত্বেও ছোটবেলা থেকেই নিজের আদর্শ ও বিশ্বাস নিয়ে লড়তে ও সাফল্যের জন্য সব প্রতিকূলতার মোকাবেলা করতে পিছপা হননি সাদিক খান। স্থানীয় একটি সরকারি স্কুলে তিনি পড়তেন তিনি। সেখানেই ১৫ বছর বয়সে তিনি রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়েন ও লেবার পার্টিতে যোগ দেন।
সাদিক খান আইন বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নেন এবং ১৯৯৪ সালে একটি আইন সংস্থায় মানবাধিকার আইনজীবী হিসাবে যোগ দেন। প্রায় ১০ বছর পর ২০০৪ সালে আইনজীবীর কাজ ছেড়ে তিনি পুরো সময়ের জন্য রাজনীতিতে যোগ দেন। ২০০৫ সালে তিনি দক্ষিণ লন্ডনের টুটিং এলাকা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
টাওয়ার হ্যামলেটসের মেয়র লুৎফুর রহমান
লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটসের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত লুৎফুর রহমান। চলতি বছরের মে মাসে অনুষ্ঠিত স্থানীয় নির্বাচনে তৃতীয়বারের মতো বাঙালি অধ্যুষিত এলাকাটির মেয়র নির্বাচিত হন।
২০১০ সালে প্রথমবার মেয়র হন। দায়িত্ব পালন করেন ২০১৫ সাল পর্যন্ত। এরপর দ্বিতীয়বার মেয়র পুনর্নির্বাচিত হয়েছিলেন লুৎফুর। তবে তার বিরুদ্ধে ভোট জালিয়াতির অভিযোগে নতুন করে নির্বাচন হয়; যাতে তাকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়।
লেবার পার্টির সাংসদ টিউলিপ সিদ্দিক
১৯৪৭ সালে ব্রিটেন থেকে পাকিস্তান আর ১৯৭১ সালে রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে পাকিস্তান থেকে সৃষ্টি হয় বাংলাদেশ। বর্তমানে ব্রিটেনে বাংলাদেশিদের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি সেখানকার রাজনীতিতেও তাদের প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
যুক্তরাজ্যে প্রথম বাংলাদেশি এমপি নির্বাচিত হন রুশনারা আলী ২০১০ সালে। তার পথ ধরে পরবর্তী ৯ বছরে মোট চারজন জনপ্রতিনিধি হাউজ অব কমন্সে প্রতিনিধিত্ব করছেন। যার অন্যতম বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাতনি টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক।
বঙ্গবন্ধুর ছোট কন্যা শেখ রেহানার সন্তান টিউলিপ ব্রিটিশ লেবার পার্টি থেকে ২০১৫ সালে লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড ও কিলবার্ন আসনে প্রথমবার সাংসদ নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৯ সালে সর্বশেষ নির্বাচনে একই আসনে টানা তৃতীয়বারের মতো জয়ী হন তিনি।
লন্ডনে জন্ম নেয়া ক্যারিয়ার পলিটিশিয়ান টিউলিপ ১৬ বছর বয়সে লেবার পার্টির সদস্য হয়ে যুক্ত হন ব্রিটিশ রাজনীতিতে। এমপি নির্বাচিত হওয়ার আগে টিউলিপ ক্যামডেন কাউন্সিলের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। সাংসদ টিউলিপ আগামী দিনে আরও চমক দিতে চলেছেন বলেই মনে করা হচ্ছে।
Tag: English News lid news others world
No comments: