স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বাঙালির জাতীয় উল্লম্ফনে চার মাত্রার সংগ্রাম হাসানুল হক ইনু
উনিশশ সাতচল্লিশ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির কূটচক্রে হিন্দু জাতীয়তাবাদ ও মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে যে বিকৃত দেশ পাকিস্তান গঠন হয়, ২৩ বছরের মধ্যে বাঙালি তা ধূলিসাৎ করে দেয়। ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করে ইসলামভিত্তিক পাকিস্তানকে; ভাষা-সংস্কৃতিভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে একাত্তরে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ। এর আলোকোজ্জ্বল উদ্ভাস তাড়িয়ে দেয় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভূত। বিশ্ব রাজনীতির মোড়লদের প্রতিনিধি হেনরি কিসিঞ্জার স্বাধীন বাংলাদেশের কোনো সম্ভাবনা দেখেননি; এ দেশকে তিনি বলেছিলেন তলাবিহীন ঝুড়ি। সে মোড়ল কিসিঞ্জার ও দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রেতাত্মাদের দৃষ্টিতে সুবর্ণজয়ন্তীর বাংলাদেশ আজ নিশ্চয়ই চোখের বালির মতোই বেদনাদায়ী! কারণ, ৫০ বছরে বাংলাদেশ উঠে দাঁড়িয়েছে স্বমহিমায়। সুবর্ণজয়ন্তীর বাংলাদেশের অর্জন একেবারে কম নয়। প্রথমত, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও স্বাধীনভাবে টিকে থাকা নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বড় অর্জন। দ্বিতীয়ত, স্বাধীন দেশে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের অপূরিত প্রত্যাশার অর্জনে জাতির রাজনৈতিক প্রয়াস থেমে থাকেনি, জাতি হয়েছে শোষণমুক্তির স্বপ্নবিভোর। তৃতীয়ত, মোট জাতীয় আয়, মাথাপিছু গড় আয় ও মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনসহ বাংলাদেশের পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিশ্ব পরিসরে আজ বিস্ময়কর হিসেবে বিবেচ্য। চতুর্থত, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচন, গড় আয়ু বৃদ্ধি, মাতৃমৃত্যু-শিশুমৃত্যু হ্রাস, স্কুলগামী শিশুর বৃদ্ধি, নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি বিবিধ সামাজিক সূচকেও বাংলাদেশের সাফল্য অনেক বড় বড় দেশের রাজনীতিকদের ব্যর্থতার লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পঞ্চমত, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, খুনি জিয়া কর্তৃক তাহের হত্যা বিষয়ে আদালতের রায়, যুদ্ধাপরাধের অব্যাহত বিচার ও সংবিধান ও প্রশাসন বিষয়ে আদালতের বিবিধ নির্দেশনা দেশ থেকে বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর করার বলিষ্ঠ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। ষষ্ঠত, বাংলাদেশ ৩৫ বছর ধরে টিকে থাকা বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচির বিভিন্ন মোড়কের নীতি-আধিপত্য ছুড়ে ফেলে ২০১০ সাল থেকে চালু করেছে জাতীয় ভিশন, আউটলাইন পারস্পেকটিভ প্ল্যান ও পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন আর সে সবের বাস্তবায়ন; একধাপ এগিয়েছে অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বের দিকে। সপ্তমত, বাংলাদেশ প্রতিরোধ করেছে সামরিকতন্ত্র ও জঙ্গিতন্ত্র আর এদের সমন্বিতরূপ পাকিস্তানপন্থা এবং এ রকম আরও অনেক কিছুই। পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের কিছু অনার্জন ও পশ্চাৎপসরণও রয়েছে। প্রথমত, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও দেশে ১৯৭৪ সালের তুলনায় নাগরিকদের মধ্যে আয়বৈষম্য বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি, সূচক অনুসারে তা এখন চরম ও অসহনীয় পর্যায়ে পতিত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পরাজিত সাম্প্রদায়িকতা গত ৫০ বছরে এক ভয়াবহ সর্বগ্রাসী সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষে পরিণত হয়েছে- তেঁতুলতত্ত্ব আজ লালায়িত করছে প্রায় সবার মানসজগৎ। তৃতীয়ত, আমরা সাংবিধানিক নির্দেশনা উপেক্ষা করে এখনও স্থানীয় সরকারের ওপর আমলা কর্তৃত্ব ও কেন্দ্রীয় সরকারের নগ্ন থাবা বিস্তার করে রেখেছি। চতুর্থত, রাজনীতিতে সামরিকতন্ত্র-জঙ্গি-যুদ্ধাপরাধীদের আপাতত পরাজিত করা গেলেও ১৪ দলের অন্তর্গত বামপন্থি দলগুলো ছাড়া এ জোটের ভেতরে-বাইরের সব রাজনৈতিক দল-মত কৌশলের নামে আর আওয়ামী লীগ ও বিএনপি থেকে দূরে থাকার নামে সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী-তেঁতুল হুজুরদের সঙ্গে আপস করছে, রাজনীতিতে তাদের স্পেস দিচ্ছে ও তাদের পুনরুত্থানের শক্তি জোগাচ্ছে। এ রকম অর্জন-অনার্জন-পশ্চাৎপসরণের প্রেক্ষাপটে একুশ শতকের চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের নববাস্তবতার পৃথিবীতে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ও এগিয়ে যেতে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকালে বাংলাদেশকে একটি জাতীয় উল্লম্ম্ফন সূচনা করতে হবে। একুশ শতকে আমরা প্রবেশ করেছি চতুর্থ শিল্পবিপ্লব যুগে- তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বা ডিজিটাল প্রযুক্তি এ যুগের প্রধান চারিত্র্য-বৈশিষ্ট্য; বিগডাটা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও যান্ত্রিক-শিখন, জৈবপ্রযুক্তি-বংশানুবিদ্যা-যথৌষধ, ন্যানোপ্রযুক্তি-ড্রোন-আকাশসীমা, ইন্টারনেট অব থিংস ও রোবোটিক্স, ব্লকচেইন ও ডিস্ট্রিবিউটেড লেজার টেকনোলোজি আর অপরাপর প্রযুক্তিশানিত চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সব উদ্ভাবন সমন্বিতভাবে পাল্টে দিচ্ছে দেখা-শোনা-জানা দুনিয়ার সবকিছু। এ অবস্থায় রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রাম ও সংগঠনকে নতুনভাবে বিন্যস্ত করার আর কোনো বিকল্প নেই। আমরা মনে করি, করোনাকাল গোটা বিশ্বের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে কেবল সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাই জনগণের জীবন ও জীবিকার নিশ্চয়তা দিতে পারে; আমেরিকার মতো শক্তিমান দেশও তার জনগণকে রক্ষা করতে পারে না। সুতরাং বর্ণিত চতুর্থ শিল্পবিপ্লব যুগের গ্রহগত ও বৈশ্বিক বাস্তবতা, করোনাকালীন অভিজ্ঞতা আর বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তীকালের জাতীয় বাস্তবতা আমাদের মার্কসবাদের সৃজনশীল বিকাশের মাধ্যমে রাজনীতি পরিচালনার নির্দেশনা দেয়। সেটা আমাদের করতে হবে। একুশ শতকে আমাদের জাতীয় উত্থানের জন্য যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো- ক. দুর্নীতি, লুটপাট ও ক্ষমতার অপব্যবহারের চক্র ধ্বংস করে সুশাসন ও আইনের শাসন নিশ্চিত করা। খ. রাজনৈতিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে মুক্তিযুদ্ধ ও অতীতের সব ঐতিহাসিক গণআন্দোলনে মীমাংসিত বিষয়গুলো অমীমাংসিত করার সব অপচেষ্টা রোধ। পাকিস্তানপন্থার রাজনীতি তথা সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী-জঙ্গিবাদী-সন্ত্রাসবাদী রাজনীতি ও তাদের পৃষ্ঠপোষক জামায়াত-বিএনপিকে রাজনীতির মাঠ থেকে চিরতরে বিদায় করা। গ. সংবিধান পর্যালোচনা করে সংবিধানের অসংগতি ও গোঁজামিল দূর করতে হবে। শাসন-প্রশাসনে গুণগত পরিবর্তন, রাজনীতিতে ভারসাম্য তৈরি, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, আরও গণতন্ত্র অর্জন, অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র কায়েম আর জনগণের ক্ষমতায়ন করতে শ্রমজীবী-কর্মজীবী-পেশাজীবী জনগণ, নারী, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, আদিবাসীদের প্রতিনিধি এবং স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের নিয়ে জাতীয় সংসদে উচ্চকক্ষ গঠন করে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদীয় ব্যবস্থা ও সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন চালু করা। ঘ. মুক্তবাজার অর্থনীতির ভ্রান্ত ও ব্যর্থ ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে সমাজের চাহিদা, বাজার শক্তির চাহিদা, উদ্যোক্তার উদ্যোগ ও সৃজনশীলতার সঙ্গে রাষ্ট্রের ভূমিকা সমন্বিত করে সংবিধান নির্দেশিত সমাজতন্ত্র লক্ষ্যাভিমুখী অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। ঙ. বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থার নৈরাজ্য-বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি ও দলবাজিমুক্ত করা এবং জনশক্তি গড়ে তুলতে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। শিক্ষিত যুবকদের জন্যও দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করা। চ. তথ্যপ্রযুক্তির সর্বব্যাপক উত্থান ও আধিপত্য গোটা দুনিয়ায় যে নতুন ভার্চুয়াল-বাস্তবতা তৈরি করেছে, তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে ও তাকে রেগুলেট করে এগিয়ে যেতে সমন্বিত জাতীয় ডিজিটাল ও সাইবার ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা। ছ. পৃথিবী ও প্রতিবেশ-ব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। জ. ক্ষুদ্রায়তন বাংলাদেশে জনসংখ্যা বিস্ম্ফোরণের ঝুঁকি ও চাপ মোকাবিলা করে জনসম্পদ ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত নীতি ও পদক্ষেপ গ্রহণ। ঝ. বিশ্বায়ন-আঞ্চলিকায়ন-বাণিজ্যায়ন-যোগাযোগায়নের দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে দেশের স্বার্থ সমুন্নত রাখতে বহুমাত্রিক কৌশলের ভিত্তিতে জোরালো কূটনীতি অনুসরণ করা। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সুবর্ণজয়ন্তীকালে এসব বিষয় বিবেচনা করে জাতীয় উল্লম্ম্ফন নিশ্চিত করতে আমাদের আবারও বায়ান্ন-একাত্তর-নব্বইয়ের মতো ঐক্যবদ্ধ হতে হবে; জাতীয় আত্মপরিচয়ের পুনর্জাগরণভিত্তিক আত্মশক্তির পুনরুত্থান করতে হবে; বাঙালিয়ানায় উদ্ভাসিত হতে হবে। আজ প্রয়োজন জঙ্গিতন্ত্র ও সামরিকতন্ত্রের পাকিস্তানপন্থা নির্মূল, বাঙালিয়ানা চর্চার মাধ্যমে সাংস্কৃতিক-সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ, দলবাজি-দলীয়করণ-দুর্নীতি-লুটপাটের অবসানে সুশাসন কায়েম এবং ভেদ-বিভেদ-অসমতা-বৈষম্য নিরসনের সমাজতন্ত্রের আন্দোলন পরিচালনার এক চতুর্মাত্রিক সংগ্রামের। লেখক: সভাপতি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ। সংসদ সদস্য। সভাপতি, তথ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ।Slider
দেশ - বিদেশ
মেহেরপুর জেলা খবর
মেহেরপুর সদর উপজেলা
গাংনী উপজেলা
মুজিবনগর উপজেলা
ফিচার
খেলা
যাবতীয়
ছবি
ফেসবুকে মুজিবনগর খবর
Home
»
English News
»
politics
» স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বাঙালির জাতীয় উল্লম্ফনে চার মাত্রার সংগ্রাম--- হাসানুল হক ইনু
Mujibnagar Khabor's Admin
We are.., This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
Labels
- Advertisemen
- Advertisement
- Advertisementvideos
- Arts
- Education
- English News
- English News Featured
- English News lid news
- English News national
- English News news
- English Newsn
- Entertainment
- Featured
- games
- id news
- l
- l national
- li
- lid news
- lid news English News
- lid news others
- media
- national
- others
- pedia
- photos
- politics
- politics English News
- t
- videos
- w
- world
- Zilla News
No comments: