আদালতে হাজির ‘মৃত’ দিলীপ, ‘মৃত্যুভয়ে’ হত্যার জবানবন্দি কিশোরের
ি
চট্টগ্রামের উত্তর হালিশহরে ২০১৯ সালে এক ব্যক্তিকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। লাশটি এতটাই বিকৃত ছিল যে, চিহ্নিত করা যাচ্ছিল না। পরে পুলিশের তদন্তকারী কর্মকর্তা জানান, লাশটি দিলীপ আচার্যের (৪০)। চার দিন পর তিনি দিলীপের দুই সহকর্মীকে এই মামলায় গ্রেপ্তার করেন। এক আসামি হত্যার নিখুঁত বর্ণনা দিয়ে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিও দেন।
কিন্তু গোল বাঁধে দেড় বছরের মাথায় মৃত দিলীপ আচার্য নিজেই আদালতে হাজির হলে! আদালত প্রশ্ন তুলেন, তাহলে ১৬৪ ধারার জবানবন্দি কীভাবে এলো? জবাবে আসামি জানালেন, চার দিন ধরে টানা নির্যাতন আর রীতিমতো ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে পুলিশের সাজানো গল্পই তিনি আদালতে জবানবন্দি হিসেবে দিয়েছেন।
আজ বৃহস্পতিবার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে নির্দেশে তথাকথিত দিলীপ হত্যা মামলার দিলীপ আচার্য নিজে, মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা সাইফুদ্দীন, বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম এবং জবানবন্দিপ্রদানকারী আসামি জীবন চক্রবর্তী (১৮) ও আসামি দুর্জয় আচার্য (১৮) হাজির হন।
আদালত তাঁদের সবার বক্তব্য শুনেন এবং পরে আসামি দুর্জয় আচার্যকে জামিন দেন। অপর আসামি জীবন চক্রবর্তীকে মারধর করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায়ের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে নির্দেশ দেন। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সারওয়ার হোসেন বাপ্পী, আসামিপক্ষের জাহিদুল আলম চৌধুরী পরে গণমাধ্যমকে এ ব্যাপারে ব্রিফ করেন।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সারওয়ার হোসেন বাপ্পী বলেন, ২০১৯ সালের ২১ এপ্রিল চট্টগ্রামের উত্তর হালিশহরে এক ব্যক্তিকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। নিহত ওই ব্যক্তির লাশটি চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয় পুলিশ। এ ঘটনায় অজ্ঞাত পরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। এরপর হালিশহর থেকে দুর্জয় ও জীবনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। চার দিন পর তাঁদের আদালতে হাজির করা হয়।
‘এর কয়েকদিন পর ১৬৪ ধারায় দীলিপ নামে একজনকে পুড়িয়ে হত্যা করার নিখুঁত বর্ণনা দিয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দেন জীবন চক্রবর্তী। কিন্তু পরে নিহত দিলীপ সশরীরে আদালতে এসে হাজির হন। রহস্য তৈরি হয় নিহত দীলিপ আদালতে হাজির হয়ে তাঁর জীবিত থাকার প্রমাণ দিলে’, বলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল।
আজ বৃহস্পতিবার হাইকোর্টে হত্যা মামলার আসামি জীবন ও দুর্জয়। ছবি : এনটিভি
সারওয়ার হোসেন বাপ্পী আরো বলেন, এরইমধ্যে গত ২৯ সেপ্টেম্বর আসামি দুর্জয় আচার্য হাইকোর্টে আসেন জামিন চাইতে। এ সময় মামলার নথি দেখে নড়েচড়ে বসেন আদালত। এর পরই কেন আসামি মিথ্যা জবানবন্দি দিলেন সে রহস্য জানতে তদন্ত কর্মকর্তা, জীবিত ফিরে আসা দিলীপ ও আসামিদের হাজিরের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। আজ মামলার সব নথিসহ হাইকোর্টে হাজির হন সবাই।
‘আদালতে বলবি, মাথায় পাথর মেরে দিলীপকে হত্যা করেছিস’
মামলার শুনানির সময় দিলীপ আচার্যসহ অন্যরা এজলাসে দাঁড়ানো ছিলেন। তখন আদালতে তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনি কোথায় ছিলেন?’
জবাবে দিলীপ বলেন, ‘আমার স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়। এ কারণে মামলার ভয়ে কিছুদিন বোনের বাড়িতে ছিলাম।‘
আদালত বলেন, ‘আপনি এ দুই আসামিকে চিনেন?’
জবাবে দিলীপ বলেন, ‘আমি তাদের চিনি। দুজনে আমার সঙ্গে চট্টগ্রাম স্টিল মিল এলাকায় একটি রডের কারখানায় চাকরি করেন।’
এরপর আদালত আসামি দুর্জয় আচার্যের কাছে জানতে চান, তাঁর বিরুদ্ধে কেন হত্যার মামলা হয়?
জবাবে দুর্জয় বলেন, ‘আমি জানি না স্যার। আমি সেদিন দুপুরে বাসার বাইরে খেলছিলাম। পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে যায়। চার দিন আটকে রেখে আমাকে নির্যাতন চালায়। ক্রসফায়ার দেওয়ার কথা বলে আমাকে জবানবন্দি দিতে বলে। কিন্তু আমি জবানবন্দি দিইনি।’
এরপর অপর আসামি জীবন চক্রবর্তীকে আদালত জিজ্ঞাসাবাদ করেন। আদালত বলেন, ‘আপনার নাম কী? বাবার নাম কী?
জীবন চক্রবর্তী প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পর আদালত দিলীপ হত্যা মামলার বিষয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন।
তখন জীবন চক্রবর্তী বলেন, “আমি চট্টগ্রামের স্টিল মিলে একটি রডের কারখানায় কাজ করি। সাপ্তাহিক বন্ধের দিন বাসায় ছিলাম। দুপুরবেলা পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে যায়। হালিশহর পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে আমাকে বলে, তোর নামে হত্যার মামলা আছে। চার দিন ধরে আমাকে তদন্ত কর্মকর্তা সাইফুদ্দীন ব্যাপক মারধর করেন। একপর্যায়ে একটি পাথর ও ফুলের টব নিয়ে এসে বলে, ‘তুই আদালতে গিয়ে বলবি, এই পাথর দিয়ে মাথায় আঘাত করে দিলীপকে হত্যা করেছিস।‘ আমি পুলিশের মারধরের ভয়ে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছি।”
এরপর মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা সাইফুদ্দীনকে ডাকেন আদালত।
সাইফুদ্দীন আদালতকে বলেন, ‘চট্টগ্রামের হালিশহর এলাকায় অজ্ঞাত এক ব্যক্তির লাশ পাওয়া যায়। লাশটির পুরো শরীর ভস্মীভূত ছিল। এত বেশি পুড়েছে যে, লাশটি কেউ শনাক্ত করতে পারেনি। এ ছাড়া ওই এলাকায় কোনো ব্যক্তি নিখোঁজ তাও জানা যায়নি। একপর্যায়ে হালি শহরের দিলীপ নামের এক ব্যক্তি নিখোঁজ হন। তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ওই দিলীপের সঙ্গে কাজ করে জীবন চক্রবর্তী ও দুর্জয় আচার্য। আমি তাদের গ্রেপ্তার করি। জিজ্ঞাসাবাদে তারা দিলীপকে হত্যার কথা স্বীকার করে। এ ছাড়া লাশের ফরেনসিক রিপোর্টে মাথার খুলিতে আঘাতের কারণে মৃত্যু হয় বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। জীবন চক্রবর্তীর জবানবন্দি ও ফরেনসিক রিপোর্টের সঙ্গে মিলে যাওয়ায় তাদের গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করা হয়।’
এ সময় আদালত বলেন, আপনারা তদন্ত করলেন কিন্তু দিলীপ তো ফিরে এলো। তাহলে নিহত ব্যক্তিটি কে? এখন ১৬৪ ধারার জবানবন্দির কী হবে?
এ সময় মামলার বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম বলেন, ‘মামলাটি তদন্তের স্বার্থে দিলীপ সর্ম্পকে জানার জন্য তাঁর পরিবারকে খুঁজতে থাকি। জানতে পারি, এ দুই আসামির সঙ্গে দিলীপ কাজ করতে। দিলীপের স্ত্রী নেই, তালাক দিয়েছেন। তখন দিলীপের স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি দিলীপের অবস্থান না জানলেও দিলীপ বোনের বাড়ি খাগড়াছড়ির গহীরা এলাকায় বলে জানান। তখন আমরা সেখানে যোগাযোগ করি। বোন জানান, দিলীপ জীবিত আছেন এবং কিছুদিন আগে তাঁদের এখানে গিয়েছিলেন। পরে মোবাইল ট্যাগ করে দিলীপের অবস্থান চিহ্নিত করা হয় এবং তাঁকে আদালতে হাজির করা হয়।‘
দিলীপ নিজেও আদালতে তার বোনের বাড়ি যাওয়ার কথা স্বীকার করেন। এবং তালাকের মামলার ভয়ে যে পলাতক ছিলেন তাও আদালতকে অবহিত করেন।
No comments: