হবিগঞ্জে মেডিকেল কলেজের দুর্নীতিতে অধ্যক্ষসহ ৮ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ
হবিগঞ্জ শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজে সাড়ে ১৫ কোটি টাকার কেনাকাটায় অনিয়মের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ডা. আবু সুফিয়ানসহ ৮ জনকে তলব করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। রোববার (০৯ ফেব্রুয়ারি) দুদক প্রধান কার্যালয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে।
এর আগে দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপ-পরিচালক শামসুল আলমকে প্রধান করে একটি তদন্ত টিম গঠন করা হয়। ওই তদন্ত টিমের মাধ্যমে টেন্ডার কমিটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ৮ জনকে তলব করেছেন বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়।
সূত্রমতে, রোববার টেন্ডার কমিটির বাজার দর যাচাই কমিটির সদস্য ডা. জাহাঙ্গীর, ডা. শাহীন ভূঁইয়া, ডা. প্রাণকৃষ্ণ, ডা. আব্দুল কদ্দুছকে, ডা. হালিমা খাতুন ও ডা. পংকজ কান্তি গোস্বামীকে তদন্ত কমিটি জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আগামীকাল সোমবার (১০ ফেব্রুয়ারি) টেন্ডার কমিটির প্রধান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ডা. আবু সুফিয়ান ও সদস্য সচিব হবিগঞ্জ পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক ডা. নাসিমা খানম ইভাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
সম্প্রতি হবিগঞ্জ শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের বইপত্র ও মালামাল ক্রয়ে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে ১৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ আসে প্রতিষ্ঠানটিতে। ভ্যাট ও আয়কর খাতে সরকারি কোষাগারে জমা হয় এক কোটি ৬১ লাখ টাকা ৯৭ হাজার ৭৪৮ টাকা। ১৩ কোটি ৮৭ লাখ ৮১ হাজার ১০৯ টাকা মালামাল ক্রয় বাবদ ব্যয় দেখানো হয়। কিন্তু বাস্তবে ওই মালামালের মূল্য পাঁচ কোটি টাকার বেশি নয়। বাকি টাকার পুরোটাই ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মালামাল ক্রয় বাবদ ব্যয় দেখানো হয় ১৩ কোটি ৮৭ লাখ ৮১ হাজার টাকা। কিন্তু বাস্তবে ওই মালামালের মূল্য ৫ কোটি টাকার বেশি নয়। সরবরাহকৃত মালামালের মধ্যে ৬৭টি লেনেভো ১১০ মডেলের ল্যাপটপের মূল্য নেয়া হয় ৯৯ লাখ ৪৯ হাজার টাকা। প্রতিটির মূল্য পড়েছে ১ লাখ ৪৮ হাজার ৫শ’ টাকা। অথচ বাজারে একই মডেলের ল্যাপটপ বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৪২ হাজার টাকায়। ৬০ হাজার টাকা মূল্যের এইচপি কালার প্রিন্টার এর দাম নেয়া হয়েছে ২ লাখ ৪৮ হাজার ৯শ’ টাকা। ১ লাখ ৩৮ হাজার টাকার ইন্টারেক্টিভ বোড কেনা হয়েছে ১৫ লাখ ৩৫ হাজার টাকায়। ৬ হাজার ৪শ’ ৭৫টি বইয়ের জন্য বিলে দেখানো হয়েছে ৪ কোটি ৪৯ লাখ ৮ হাজার ৬৬৪ টাকা। এ ছাড়াও মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ১০৪টি প্লাস্টিক মডেলের মূল্য ধরা হয়েছে ১ কোটি ১৪ লাখ ৮৬ হাজার ৩১৩ টাকা। যেগুলোর বাজার মূল্য অর্ধেকের চেয়েও কম। ৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা দরে ৮১টি কার্লজিস প্রিমো স্টার বাইনোকুলার মাইক্রোস্কোপ সরবরাহ করেছে। যার মূল্য নিয়েছে ২ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। অথচ এর বাজার মূল্য ১ লাখ ৩৯ হাজার টাকা। ৫০ জন বসার জন্য কনফারেন্স টেবিল, এক্সিকিউটিভ চেয়ার ও সাউন্ড সিস্টেমে ব্যয় দেখানো হয়েছে ৬১ লাখ ২৯ হাজার টাকা। দেশের নামিদামি ফার্নিচার প্রতিষ্ঠান হাতিল ও রিগ্যালে এ সব চেয়ারের মূল্য ওই দামের অর্ধেকের চেয়েও কম। ওয়ালটনের যে মডেলের ফ্রিজ ৩৯ হাজার ৩৯০ টাকা, একই মডেলের ফ্রিজের মূল্য গুণতে হয়েছে ৮৫ হাজার টাকা। এ রকম ৬টি ফ্রিজ কেনা হয়। বাজারমূল্য থেকে কয়েকগুণ বেশী দরে এসব যন্ত্রপাতি ও সামগ্রী সরবরাহ করে ঢাকার নির্ঝরা এন্টারপ্রাইজ ও পুনম ট্রেড ইন্টার ন্যাশনাল নামে দুটি প্রতিষ্ঠান। এছাড়াও প্রায় প্রতিটি মালামাল অতিরিক্ত মূল্যে সরবরাহ করে এ দুটি প্রতিষ্ঠান।
অভিযোগ উঠে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ডা. আবু সুফিয়ান ও তার সহযোগীরা দরপত্রের শর্ত ভঙ্গ করে এ দুই প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ প্রদান করেন। এছাড়াও প্রায় প্রতিটি মালামাল অতিরিক্ত মূল্যে দেয় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নির্ঝরা এন্টারপ্রাইজ এবং পুনম ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল।
১০৬ হটলাইনে শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজে দুর্নীতির ব্যাপারে অভিযোগের পর প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশে গত ৩ ডিসেম্বর প্রাথমিক তদন্তে নামে দুদক হবিগঞ্জ জেলা কার্যালয়। যা ছিল তাদের প্রথম পদক্ষেপ। পরবর্তীকালে বিষয়টি তদন্তের অনুমতি চেয়ে প্রধান কার্যালয়ে আবেদন করা হয়। এদিকে এ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আলাদা তদন্ত কমিটি গঠন করে। গত ৫ ডিসেম্বর কমিটির একমাত্র সদস্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. আজম খান শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজে দুর্নীতির সরেজমিন তদন্তে আসেন। পরে তিনি অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে মর্মে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। তবে নবনির্মিত এ মেডিকেল কলেজে পুকুর চুরির ঘটনার বিচার দেখতে দুদকের তদন্তের দিকে চেয়েছিলেন হবিগঞ্জবাসী।
এ ব্যাপারে হবিগঞ্জ দুদকের উ-পরিচালক মোহাম্মদ কামরুজ্জামান জানান, বিষয়টি আমাদের প্রধান কার্যালয় থেকে তদন্ত হচ্ছে। আমরা অভিযুক্তদের তলবের ব্যাপারে অফিসিয়ালভাবে কোন কাগজপত্র পাইনি। তবে জানতে পেরেছি আজ (রোববার) থেকে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
উল্ল্যেখ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত ইচ্ছায় ২০১৫ সালের ১ জানুয়ারি হবিগঞ্জ শেক হাসিনা মেডিকের কলেজটি অনুমোদন লাভ করে। ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে ৫১ জন শিক্ষার্থী ভর্তির মাধ্যমে কলেজটির আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়।
Tag: others
No comments: