ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রীর উঠে আসার গল্প
বিশ্বের বেশিরভাগ রাষ্ট্রপ্রধানদের জীবনে রয়েছে নানা রকম গল্প। যুক্তরাজ্যের নতুন প্রধানমন্ত্রী আলেক্সান্ডার বরিস দ্য ফেফেল জনসন তার ব্যতিক্রম নয়। গত ২৪ জুলাই যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছেন তিনি। এই লেখাটিতে চেষ্টা করা হয়েছে যুক্তরাজ্যের নতুন প্রধানমন্ত্রীর জীবনের গল্প তুলে ধরবার।
আলেক্সান্ডার বরিস দ্য ফেফেল জনসন (ইংরেজি: Alexander Boris de Pfeffel Johnson, জন্ম: ১৯ জুন ১৯৬৪) একজন ব্রিটিশ রাজনীতিক যিনি ২০১৯ সাল থেকে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ও রক্ষণশীল দলের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১৫ সাল থেকে তিনি আক্সব্রিজ ও সাউথ রাইস্লিপের সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে তিনি ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত হেনলির সংসদ সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
এছাড়াও ২০০৮ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত লন্ডনের মেয়র ও ২০১৬ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। রক্ষণশীল দলের সদস্য হিসেবে তিনি এক-জাতি রক্ষণশীলতাবাদের ধারক হিসেবে পরিচিত। পূর্বে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উদারপন্থী নীতির সপক্ষের পাশাপাশি বর্তমানে বর্ণবাদ ও সমকামীতাবিরোধী বক্তব্যের জন্য সমালোচিত।
নিউ ইয়র্কের উচ্চ-মধ্যবিত্ত এক ব্রিটিশ পরিবারে জনসনের জন্ম। তিনি ব্রাসেলসের ইউরোপীয়ান স্কুল, অ্যাশডাউন হাউজ, ও ইটন কলেজে পড়াশোনা করেছেন। অক্সফোর্ডের ব্যালিয়ল কলেজে প্রাচীন সাহিত্য পড়ার সময় ১৯৮৬ সালে তিনি অক্সফোর্ড ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। দ্য টাইমস ম্যাগাজিনের প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেয়ার মাধ্যমে সাংবাদিকতায় তার পেশাজীবন শুরু হয়, যদিও একটি মনগড়া উদ্ধৃতি ব্যবহারের জন্য পরে তিনি চাকরি হারান।
পরবর্তীতে তিনি দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফের ব্রাসেলস প্রতিনিধি হিসেবে চাকরি শুরু করেন। ডেইলি টেলিগ্রাফের চাকুরীরত সময়ে তার লেখা ব্রিটিশ ডানপন্থীদের মধ্যে ইউরোপ নিয়ে সংশয়বাদের ধ্যান-ধারণা বিস্তারে প্রভাবশালী ভূমিকা রাখে। ১৯৯৪ সালে তিনি ডেইলি টেলিগ্রাফের সহকারী সম্পাদক পদে উন্নীত হন। এরপর তিনি টেলিগ্রাফের চাকরি ছেড়ে দ্য স্পেক্টেটরে যোগ দেন ও এক পর্যায়ে সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন যা তিনি ২০০৫ সাল পর্যন্ত চালিয়ে যান।
২০০১ সালে জনসন রক্ষণশীল দলের পক্ষ থেকে হেনলির সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সংসদে তার প্রথম মেয়াদে তিনি দলীয় মনোভাবের প্রতি দৃঢ় সংকল্পতার ছাপ রাখেন। সমকামী অধিকার সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে তখন তিনি সামাজিকভাবে উদারপন্থী মনোভাবও বজায় রেখেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ২০০৮ সালের লন্ডন মেয়র নির্বাচনে রক্ষণশীল দলের মনোনয়ন লাভ করেন। সেই মেয়র নির্বাচনে তিনি লেবার নেতা কেন লিভিংস্টোনকে পরাজিত করে লন্ডনের মেয়র নির্বাচিত হন ও একই সাথে হাউজ অফ কমন্সে তার সংসদীয় আসন থেকে পদত্যাগ করেন।
লন্ডনের মেয়র হিসেবে প্রথম মেয়াদে তিনি শহরের গণপরিবহণের অ্যালকোহল পান করা নিষিদ্ধ করেন এবং নিউ রুটমাস্টার বাস, সাইকেল ভাড়ার ব্যবস্থা, ও টেমস নদীর ওপর কেবল কার চালু করেন। ২০১২ সালে তিনি লিভিংস্টোনকে পুনরায় পরাজিত করে দ্বিতীয়বারের মতো মেয়র নির্বাচিত হন। তার দ্বিতীয় শাসন আমলেই ২০১২-এর লন্ডন অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৫ সালে তিনি আক্সব্রিজ ও সাউথ রাইস্লিপের আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে পুনরায় সংসদীয় রাজনীতিতে ফেরত আসেন এবং পরবর্তী বছর লন্ডনের মেয়রের পদ ছেড়ে দেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রেক্ষাপটে ২০১৬ সালে যে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিলো সেখানে ব্রেক্সিটের পক্ষে প্রচারণাচালনাকারীদের মধ্যে জনসন ছিলেন অন্যতম। গণভোটে সিদ্ধান্ত ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে আসলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন পদত্যাগে করেন কিন্তু সেসময় রক্ষণশীল দলের নতুন নেতা নির্বাচনের সময় জনসন প্রতিদ্বন্দীতা করতে অস্বীকৃতি জানান যদিও ধারণা করা হয়েছিলো যে তিনি প্রতিদ্বন্দীতা করবেন।
পরবর্তীতে টেরেসা মে নতুন নেতা ও প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলে তিনি জনসনকে মন্ত্রীসভায় নিয়ে আসেন ও পররাষ্ট্র ও কমনওলেথ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীত্বের দায়িত্ব দেন। দুই বছর এই দায়িত্বে থাকার পর মে’র ব্রেক্সিট কৌশলের প্রতিবাদস্বরূপ তিনি পদত্যাগ করেন। তিনি ছিলেন মে’র চেকার্স চুক্তির অন্যতম সমালোচক। এরপর ব্রেক্সিট জটিলতায় মে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত জানালে তিনি রক্ষণশীল দলের নেতৃত্বের দৌড়ে অংশ নেন এবং ২৩ জুলাই ২০১৯ দলের প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হন। এর পর দিন তিনি যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
ব্রিটিশ রাজনীতি ও সাংবাদিকতায় বরিস জনসন একজন বিতর্কিত ব্যক্তি। তার সমর্থকগণ তাকে একজন বিনোদনমূলক, হাস্যরসাত্মক, এবং জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রসংশা করেন। তার গ্রহণযোগ্যতা প্রথাগত রক্ষণশীল ভোটারদের পাশাপাশি অন্যদেরকেও আকর্ষণ করে। অপরদিকে বাম ও ডানপন্থী উভয় পক্ষ-ই অভিজাত্যবাদ, অসসততা, অলসতা, বর্ণবাদ ও সমকামীতাবিরোধী মন্তব্যের জন্য সমালোচনা করেন। বেশ কয়েকটি জীবনীমূলক ও কাল্পনিক সাহিত্যের বিষয়বস্তু হিসেবেও জনসনের পরিচিত রয়েছে।
শৈশব (১৯৬৪-১৯৭৭)
জনসন ১৯৬৪ সালের ১৯শে জুন ম্যানহাটনের আপার ইস্ট সাইডে ব্রিটিশ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃপক্ষ ও নিউ ইয়র্ক সিটির ব্রিটিশ কনস্যুলেটে তার জন্ম নিবন্ধন হয়েছিল, ফলে তিনি মার্কিন ও ব্রিটিশ উভয় নাগরিকত্ব লাভ করেন। তার পিতা স্ট্যানলি জনসন সে সময়ে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি শাস্ত্রে অধ্যয়নরত ছিলেন।
তার প্র-পিতামহ ছিলেন সার্কাসীয়-তুর্কি সাংবাদিক আলি কেমাল, তিনি ধর্মনিরপেক্ষ মুসলমান ছিলেন। পিতার দিক থেকে তিনি ইংরেজি ও ফরাসি বংশোদ্ভূত, তিনি গ্রেট ব্রিটেনের দ্বিতীয় জর্জের উত্তরসূরি। জনসনের মাতা শার্লট ফচেট একজন চিত্রশিল্পী ছিলেন, তিনি ১৯৬৩ সালে স্ট্যানলিকে বিয়ে করেন এবং তার সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। শার্লটের পিতা ও জনসনের মাতামহ ছিলেন আইনজীবী স্যার জেমস ফচেট। শার্লট হস্তলিপিবিদ এলিয়াস অ্যাভারি লো ও টমাস মানের অনুবাদক হেলেন ট্রেসি লু-পোর্টারের নাতনী। এলিয়াস ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আগমনকারী রুশ অভিবাসী। এলিয়াসের দিক থেকে জনসন লিথুয়ানিয়ার গোঁড়াবাদী র্যাবাইদের বংশধর। তার মুসলমান, ইহুদি ও খ্রিস্টান পূর্বপুরুষের সমন্বয়ের জন্য তিনি নিজেকে গলে যাওয়া পাত্রের সাথে তুলনা করেন। তিনি তার নামের মধ্যাংশ "বরিস" রাখেন তার পিতামাতার সাথে সাক্ষাৎ হওয়া এক রুশ অভিবাসীর নামানুসারে।
ব্যক্তিগত জীবন: বরিসের প্রাক্তন স্ত্রী ম্যারিনা হুইলার। বরিসের শাশুড়ী-মা ভারতীয় শিখ ডিপ সিং
সূত্র : উইকিপিডিয়া
Tag: world
No comments: