প্রয়াত লেখক, সাংবাদিক ও অধিকারকর্মী এ এন মাহফুজা খাতুন বেবী মওদুদ বর্তমান সময়ের সাংবাদিকতায় উজ্জ্বল এক ব্যতিক্রম। একজন নারী হয়েও তিনি সব সামাজিক বাঁধা ডিঙ্গিয়ে সাহসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন সাংবাদিকতার পেশায়। এই পেশায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন অনন্য এক উচ্চতায়। নারী সাংবাদিকতার ধারণাটাই তিনি পাল্টে দিয়েছেন। যেখানে নারীরা এই পেশায় টিকতে পারবেনা বা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে না, এমন ধারণা পোষণ করতেন সেখানে তিনি বিপ্লব সাধন করেছেন।
সাংবাদিক ও ব্যক্তি হিসেবে তিনি সততা, নিষ্ঠা, নির্লোভ, উপকারী মানুষ হিসেবে সবার কাছে চিরকাল অমর হয়ে থাকবেন। এ রকম মানুষ বেশি হয় না। তিনি সাদা শাড়ি পড়তেন, তার মনটাও ছিল সাদা। অনেকে তার ভাল মানুষের সুযোগও নিয়েছে, প্রতিষ্ঠিত হয়ে তাকে ভুলেও গেছে।
লেখক-সাংবাদিক বেবী মওদুদের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবে শুভানুধ্যায়ীদের আয়োজনে আয়োজিত স্মরণসভায় বিশিষ্টজনেরা এসব কথা বলেন।
স্মরণ সভায় বক্তরা বলেন, বেবী মওদুদ পার্থিব জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে আয়ত্ত করে নিয়েছেন মানবিকতার মহৎ গুণগুলো। তাই তার কথা ও কাজে প্রাধান্য পেয়েছে বঞ্চিত মানুষের কথা। তার ভাষায় ‘আমার কাছে মানুষই প্রথম এবং মানুষই প্রধান। জীবন দর্শন এমনই ছিল বলে, তিনি হয়েছিলেন দেশের সংবাদ ও সাংবাদিকতা জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, এক অগ্রপথিক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে অনার্সসহ মাস্টার্স করা বেবী মওদুদ পেশাগত জীবনে কাজ করেছেন অনেক পত্রিকায়। সাপ্তাহিক ললনা, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক মুক্তকণ্ঠ ও বিবিসিতে তিনি কাজ করেন। সাপ্তাহিক বিচিত্রার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন। এখানে উল্লেখ্য, এই সাময়িকীর সম্পাদক ছিলেন বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ রেহানা। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার বাংলা বিভাগটি গড়ে তুলেছেন প্রধান বার্তা সম্পাদক হিসেবে। তিনি অনলাইন নিউজপোর্টাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর সোস্যাল অ্যাফেয়ার্স সম্পাদক ছিলেন। সাংবাদিকতা জীবনে তার এই দীর্ঘপথ চলায় একজন নারী হিসেবে পেশাগত দায়িত্ব পালনে অনেক অপ্রীতিকর উপদেশ ও বিধিনিষেধের মধ্যে পড়তে হয়েছে। কিন্তু তার এই সাহসী পথচলা থেমে থাকেনি। তিনি লড়াকু মানসিকতায় এগিয়ে গেছেন দুর্দান্তভাবে।
বেবী মওদুদ ছিলেন প্রচারবিমুখ, নির্লোভ ও নিরহংকারী মানুষ। স্বামী দৈনিক সংবাদের বার্তা সম্পাদক অ্যাডভোকেট মো. হাসান আলী ১৯৮৫ সালের এপ্রিল মাসে আকস্মিকভাবে প্রয়াত হলে শুরু হয় তার লড়াকু জীবন। দুই সন্তান রবিউল হাসান অভী ও শফিউল হাসান দীপ্ত-কে নিয়ে শুরু করেন কঠিন জীবন যুদ্ধ। এই যুদ্ধের পাশাপাশি আরো এক যুদ্ধে তিনি লিপ্ত হন, সেটা ছিল সমাজ, দেশকে বদলে দেয়ার যুদ্ধ। মাথা উঁচু করে বাঁচার চেষ্টা করেছেন তিনি। এক্ষেত্রে সফলও হয়েছিলেন। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও ছিলেন অত্যান্ত দৃঢ়চেতা।
সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ১৯৬৭ সালে তাকে আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হিসেবে পেলাম, তখন ছাত্র ইউনিয়নের রোকেয়া হল সংসদে নির্বাচিত হয় বেবী মওদুদ। এ সময় আমি লক্ষ্য করেছি প্রতিপক্ষের প্রতি অশিষ্টাচার করতে দেয়নি, ছাত্র ইউনিয়নের একনিষ্ঠ কর্মী থাকলেও অন্যদের সঙ্গে ছিল সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক।
প্রিয় ছাত্রীর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আনিসুজ্জামান আরও বলেন, সে (বেবী মওদুদ) নিয়মিত ক্লাস করেছে, ছাত্রী হিসেবে কর্তব্য পালন করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব থাকা সত্ত্বেও কোনদিন কোন সুযোগ নেয়নি এবং তাকে দিয়ে কেউ তদবিরও করাতে পারেননি। বেবীর কর্ম পরিধি ব্যাপক ছিল, প্রেসক্লাব ছিল তার নিজের বাড়ির মতো। সাংবাদিক হিসেবে সে সততা বজায় রেখেছে। আর বেবী মওদুদ নানা গুণে গুণান্বিত মানুষ। বেবী মানুষকে সেবা করতে ভালবাসত, দেশের জন্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যুক্ত থেকে নিজেকে ধন্য মনে করত, এরকম মানুষ বেশি হয় না।’
সভাপতির বক্তব্যে বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেন, বেবী মওদুদ আমার ছোট বোনের মতো ছিল। তার বিষয়ে দুটি দিক নিয়ে বলতে চাই। কখনও তাকে নীতির প্রশ্নে একটু বাঁকা করা যায়নি, তিনি এমপি হওয়ার জন্যও রাজি হচ্ছিলেন না। তাকে ধরে রাজি করাতে হয়েছে। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তার সততা-নিষ্ঠা সত্যিই অনুস্মরণীয় হয়ে থাকবে। আর বেবী মওদুদের সাহিত্য প্রতিভাও সামান্য নয়, তার বইয়ের সংখ্যাও কম নয়। বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের সদস্য সচিব শেখ হাফিজুর রহমান স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ‘তাকে আমি বেবী ফুপু বলতাম। প্রধানমন্ত্রী তাকে সংসদ সদস্য হিসেবে মনোনীত করলেন। কিন্তু তিনি কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। তিনি বলতেন, আমার পরিচয়ের দরকার নেই। কোন স্বার্থ চিন্তা করে তিনি কোন কাজ করেননি। তার সঙ্গে আমাদের যে স্মৃতি, লেখালেখি, গবেষণা, স্মৃতি তা পাঁচ ঘণ্টা বলেও শেষ হবে না। আর বেবী মওদুদ বহু লোককে নীরবে উপকার করেছেন, কিন্তু কখনও তা প্রকাশ করেননি। তার স্মৃতি আমাদের কাছে চিরকাল অমর হয়ে থাকুক।’
শামসুজ্জামান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও স্মৃতিচারণ করেন আওয়ামী লীগের উপ-দফতর সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, প্রেসক্লাবের সভাপতি সাইফুল আলম, বেবী মওদুদের সহপাঠিনী সাবেক এমপি কবি কাজী রোজী, অপর সহপাঠিনী ডাঃ মাখদুমা নার্গিস রত্না, জ্যেষ্ঠ চিত্র সাংবাদিক পাভেল রহমান, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সোহেল হায়দার চৌধুরী, বেবী মওদুদের অনুজ আজিমুল হক রায়হান ও জ্যেষ্ঠপুত্র রবিউল হাসান অভি।
সাংবাদিকতায় উজ্জ্বল এক ব্যতিক্রম বেবী মওদুদ`
Tag: others
No comments: