৬ বছর পূর্তিতে রানা প্লাজার উদ্ধারকর্মীর আত্মহত্যা
নিজের প্রিয় কুকুরের সঙ্গে হিমালয় হিমু। ছবি : ফেসবুক থেকে নেওয়া
ঢাকার সাভারে বহুতল ভবন রানা প্লাজা ধসের ছয় বছর পূর্তিতে নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছেন উদ্ধারকর্মী হিসেবে কাজ করা নওশাদ হাসান হিমু (২৭)। বুধবার রাত ৯টার দিকে উপজেলার বিরুলিয়া ইউনিয়নের শ্যামপুর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
নিহত হিমু বরিশালের উজিরপুর উপজেলার বাবরখানা গ্রামের মৃত সরদার আবুল হোসেনের ছেলে। তিনি বিরুলিয়ার আব্দুল হক মোল্লার বাড়িতে ভাড়া থাকতেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। ছাত্র ফেডারেশনের ঢাকা মহানগর শাখার সাবেক ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক হিমু রানা প্লাজা ধসের সময় উদ্ধারকর্মী হিসেবে কাজ করে ‘হিরো’ বলে পরিচিত ছিলেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এ ছাড়া বন্ধু-শুভানুধ্যায়ীদের কাছে পরিচিত ছিলেন ‘হিমালয় হিমু’ নামে।
সাভার মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আজগর আলী বলেন, আমরা স্থানীয়দের মাধ্যমে খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। এ থেকে যতটুকু জেনেছি হিমু কারো সঙ্গে তেমন মিশতেন না। এ ছাড়া তিনি তাঁর মা-বাবার সঙ্গেও থাকতেন না। তাঁর মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
সাভার মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ এফ এম সায়েদ বলেন, হিমুর মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তিনি তিন বছর ধরে বিরুলিয়ায় থাকতেন। বুধবার রাতে নিজেই নিজের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছেন বলে প্রাথমিকভাবে জানতে পেরিছি। তবে কীভাবে তাঁর মৃত্যু হলো ময়নাতদন্তের পরই তার সঠিক কারণ জানা যাবে বলেও জানান তিনি।
ছাত্র ফেডারেশনের শোক
বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের দপ্তর সম্পাদক এম এইচ রিয়াদের পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ছাত্র ফেডারেশনের ঢাকা মহানগর শাখার সাবেক ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক নওশাদ হাসান হিমু ওরফে হিমালয় হিমু গতকাল রাতে সাভারের বিরুলিয়ায় ভাড়া বাসায় গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। ছাত্র ফেডাশেনের সভাপতি গোলাম মোস্তফা, সাধারণ সম্পাদক জাহিদ সুজন, দপ্তর সম্পাদক এম এইচ রিয়াদ হিমালয় হিমুর অকাল মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেন। নেতারা হিমুর মা আফরোজা বেগম ও ছোটবোন নওশীন আফরোজ হিয়া, চাচা মাসুদ রানাসহ পরিবারের স্বজনদের সাথে দেখা করেন এবং তাঁদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন।
আজ রাত ৯টায় বরিশালের উজিরপুর উপজেলার বাবরখানা গ্রামে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে হিমুকে দাফন করা হবে। ছাত্র ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় নেতা নবীন আহমেদ জানাজায় অংশ নেবেন।
১৯৯১ সালে ২৭ জানুয়ারি নওশাদ হাসান হিমুর জন্ম। হিমু আশা ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের ছাত্র ছিলেন। হিমুর বাবা মৃত সরদার আবুল হোসেন একজন আইনজীবী ছিলেন।
ছাত্র ফেডারেশনের নেতারা জানিয়েছে, হিমুর এই মর্মান্তিক আত্মহত্যার ঘটনায় তাঁর পরিবার, সংগঠনের সহযোদ্ধা ও বন্ধুবান্ধব আমরা সবাই গভীরভাবে শোকাহত। ২০১৩ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত হিমু সক্রিয়ভাবে ছাত্র ফেডারেশনের সাথে যুক্ত ছিলেন। সর্বশেষ ঢাকা মহানগর শাখার ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধস হলে ছাত্র ফেডারেশনের উদ্ধার টিমের সবচেয়ে সাহসী ও পরিশ্রমী কর্মী হিসেবে উদ্ধার কাজ করেছেন।
রানা প্লাজায় চাপা পড়া মানুষের হাত-পা করাত দিয়ে কেটে বের করার কাজের যে অসহনীয় অভিজ্ঞতা তা প্রায়ই হিমুকে ঘুমাতে দিত না। বিভিন্ন সময় তিনি বলতেন, মানুষের রক্তাক্ত শরীরের কাটা টুকরোগুলো ঘুমের ভেতর হাজির হয়! এই দুঃসহ স্মৃতি প্রতিদিন পীড়া দেয়, তাড়া করে বেড়ায়। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজার সেই ভয়াবহ ধসের ছয় বছর পর সেই একই দিনেই নিজেকে পুড়িয়ে ফেললেন হিমু!
ছাত্র ফেডারেশন জানিয়েছে, মানবিক সমাজের স্বপ্ন দেখত বলেই পরিবর্তনের লড়াইয়ের সাথী ছিলেন হিমু। যত দিন তিনি সংগঠনে ছিলেন তত দিন বেশ উদ্যম ও পরিশ্রম দিয়ে কাজ করেছেন। বিনয়ী ও সদা হাস্যোজ্জ্বল স্বভাবের হিমুর মৃত্যুতে যে ক্ষতি তা অপূরণীয়।
মৃত্যুর আগ মুহূর্তে ফেসবুকে সাত স্ট্যাটাস
এদিকে হিমুর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ‘হিমালয় হিমু’তে গিয়ে দেখা যায়, বুধবার রাতে আত্মহত্যার আগে তিনি ফেসবুকে সাতটি পোস্ট দেন। বিকেল ৪টা ২৩ মিনিটে লিখেন, ‘এমনি করেই হয় যদি শেষ হোক না।’ বিকেল ৬টা ১১ মিনিটে লিখেন, ‘অতপর তাহারা সুখে শান্তিতে...লাগিল।’ সন্ধ্যা ৭টা ৮ মিনিটে লিখেন, ‘ছোটবেলা হইতেই আগুন আমার অনেক পছন্দ।’ এর ২০ মিনিট পর আবার লিখেন, ‘ছোটকাল হৈতেই আগুন আমার অনেক পছন্দ।’ এর কিছুক্ষণ পর লিখেন, ‘আগুন সর্বগ্রাসি তাই ভালোবাসি।’ তারপর লিখেন ‘কোনো মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।’ সর্বশেষ পোস্ট দেন, ‘জয়বাংলা প্যারানাই।’
No comments: