মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকা পরবর্তী প্রজন্মের বহন করা উচিত নয়: মঞ্জু
মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকার বোঝা পরবর্তী প্রজন্মের বহন করা উচিত নয় বলে জানিয়েছেন
মুজিবুর রহমান মঞ্জু। সকালে রাজধানীর একটি হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও সংগঠনের বিরুদ্ধে অভিযোগ স্বচ্ছ ও স্বাধীনভাবে নিষ্পত্তি প্রয়োজন।
নতুন দল গঠন নিয়ে তিনি বলেন, কোন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠন করা হবে না। যে দল গঠন করা হবে তা ধর্ম, বর্ণ, জাতি নির্বিশেষে সকলের জন্য উন্মুক্ত প্লাটফর্ম হবে।
মুজিবুর রহমান বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে সব সরকারই জনগণের প্রকৃত রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের পথকে রুদ্ধ করেছে। একই সাথে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি মঞ্জু একসময় চট্টগ্রাম কলেজ একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সংস্কারপন্থীদের একটি অংশ ‘মুক্তিযুদ্ধকে মেনে’ এবং সেই মুক্তিসংগ্রামকে ‘গর্বিত উত্তরাধিকার’ দাবি করে নতুন রাজনৈতিক উদ্যোগের ঘোষণা দিয়েছেন।
স্বাধীনতার প্রায় পাঁচ দশকের মাথায় দাঁড়িয়ে ‘যুদ্ধাপরাধে জড়িতদের সংগঠন’ জামায়াত ইসলামী থেকে বেরিয়ে আসা এই সংস্কারপন্থী নেতারা, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠনের’ দায়ে জড়িতদের বিচারও দাবি করেছেন। যদিও তাঁরা দাবি করেছেন, ‘জামায়াত ইসলামসহ বিদ্যমান কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই।’
আজ শনিবার সকালে ‘ধর্মভিত্তিক রাজনৈদিক দল’ জামায়াত থেকে সদ্য বহিষ্কৃত ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জু নতুন এই রাজনৈতিক উদ্যোগের ঘোষণাপত্র পাঠ করে বলেন, তাঁরা কোনো ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠন করবেন না। তাদের উদ্যোগ হবে ‘জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ নির্বিশেষে সবার জন্য গ্রহণযোগ্য, উন্মুক্ত একটি প্ল্যাটফর্ম।’
সংস্কারপন্থী নেতারা পল্টনের বিজয়নগরের যে হোটেলটিতে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন, তার নাম ‘হোটেল-৭১’। ‘জন-আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ’ শীর্ষক ছয় পৃষ্ঠার ঘোষণাপত্রের শিরোনাম ছিল ‘স্বাধীন সত্তার বিকাশে অধিকার ও কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রাজনীতি’; আর স্লোগান ছিল ‘জন-আকাঙ্ক্ষার নতুন রাজনীতি’। এ জন্য তাঁরা ১৯ দফা ভিত্তিক একটি কর্মসূচিও দিয়েছেন। উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য পাঁচটি কমিটির গঠন করা হয়েছে।
কিছুদিন আগেই একাত্তরের ভূমিকার জন্য দলের পক্ষ থেকে জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার প্রসঙ্গ এনে জামায়াতে ইসলাম ছাড়ার ঘোষণা দেন দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও যুদ্ধাপরাধে জড়িতদের প্রধান কৌঁসলি ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক। এরপর থেকেই সংস্কারপন্থীদের নতুন এই রাজনৈতিক উদ্যোগের বিষয়টি সামনে চলে আসে।
বলা হচ্ছিল, একাত্তর-পরবর্তী প্রজন্ম জামায়াতে ইসলামীর মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ভূমিকার দায় নিতে পারে না। এমনকি যাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ রয়েছে, তাদের বাদ দিয়ে সংগঠন পুনর্গঠনের, এমনকি দলের নাম পরিবর্তনের পক্ষেও কেউ কেউ প্রস্তাব আনেন।
স্বভাবতই বিষয়টি নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান নেতৃত্ব এক ধরনের অস্বস্তির মধ্যে পড়েন। সুরা সদস্য মজিবুর রহমান মঞ্জুকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। নতুন এই উদ্যোগের সঙ্গে যেন কেউ জড়িত না হয় সে ব্যাপারে কঠোর নজরদারি রাখা হয় বলেও জামায়াত নেতারা জানান। এসব ঘটনার মধ্যে আজকে সংস্কারপন্থীরা নতুন এই ঘোষণা দিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে ‘জন-আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ’-এর সমন্বয়ক মজিবুর রহমান মঞ্জু জামায়াতে ইসলামীর একাত্তরের ভূমিকা তুলে ধরে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী একমাত্র দল না হলেও পরবর্তী সময়ে জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান আর দলীয় ভূমিকা নিয়েই বেশি প্রশ্ন ও বিতর্ক তৈরি হয়েছে। দল হিসেবে জামায়াত মুক্ত ও স্বাধীন বাংলাদেশে সক্রিয় হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও মুক্তিযুদ্ধের সময়ের দলীয় ভূমিকার জন্য দায়-দায়িত্ব স্বীকার এবং ঐতিহাসিক ক্ষত উপশমের আক্ষরিক উদ্যোগ গ্রহণের দাবিকে বরাবরই অগ্রাহ্য করেছে। এই রাজনৈতিক অবস্থানের বোঝা একাত্তর পরবর্তী প্রজন্মের বহন করা উচিত নয় বলে আমরা বিশ্বাস করি। মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সকালের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার। একে বিভেদ বিভক্তি ও সংকীর্ণ স্বার্থে ব্যবহারের যেকোনো প্রবণতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে।’
জামায়াতে ইসলামীর ভেতর সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণেই কি নতুন রাজনৈতিক উদ্যোগ নেওয়া হলো কি না- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘আমি, আমরা আর অতীতে ফিরতে চাই না। আমরা আর পিছনের দিকে যেতে চাই না। এটা সম্পূর্ণ নতুন উদ্যোগ।’
জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যুক্ত কেউ নতুন এই উদ্যোগের সঙ্গে আছে কি না, জানতে চাইলে সংগঠনটির সাবেক এই শুরা সদস্য বলেন, ‘আমার সঙ্গে কে আছে, কে নাই- সেটা বিষয় না। যারা আমাদের চিন্তাকে সমর্থম করেন, তাঁরা আমাদের সঙ্গে আছেন। এখানে সব দল-মত, ধর্মের লোকজন আছে। আমরা অধিকারকেন্ত্রিক রাজনীতির কথা বলব।’
মঞ্জু আরো বলেন, ‘আমাদের আদর্শ ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা। আমরা বলে দিয়েছি, জন-আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ। যেমন মুক্তিযুদ্ধে সব দল-মতের লোক ছিল, কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতৃত্বে থাকায় তাদের দলের লোক ভারি ছিল। আমাদের অনুপ্রেরণা সাম্য ও উদারতা।’
নতুন এই উদ্যোগকে জামায়াতে ইসলামী ভাঙন হিসেবে দেখছেন কি না, জানতে চাইলে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক এই সভাপতি বলেন, ‘আমরা ভাঙা-গড়ার রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। ভাঙা-গড়ার রাজনীতির অতীত অভিজ্ঞতা ভালো না। তাই আমাদের এই উদ্যোগ সম্পূর্ণ নতুন। কারো ভাঙা-গড়ার দায়িত্ব আমরা নেব না।’
একাত্তরের ভূমিকা নিয়ে জামায়াতের কী করা উচিত- এ ব্যাপারে সরাসরি কিছু বলেননি মঞ্জু। তবে তিনি বলেন, ‘যেহেতু আমি এখন সেখানে নেই, তাই তাদের নিয়ে কিছু বলতে চাই না। কাউকে তালাক দিলে তার সম্পর্কে জানতে চাওয়া বিব্রতকর।’
নতুন এই রাজনৈতিক উদ্যোগের সঙ্গে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের সম্পৃক্ততার বিষয়ে মঞ্জু সরাসরি যদিও বলেন, ‘তিনি আমাদের এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে এখন যুক্ত নন।’ কিন্তু পাশাপাশি এটা বলেন, ‘তবে ভবিষ্যতের কথা বলতে পারব না।’
যত দ্রুত সম্ভব রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ হবে এবং সেটা নিয়ে কাজ করছেন জানিয়ে মঞ্জু এই উদ্যোগের সঙ্গে সরকারের কোনো ধরনের যোগসাজশও উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘কারো মদদ বা কারো চিন্তা বা কর্ম বাস্তবায়ন করতে আসিনি।’
অনুষ্ঠানের মঞ্চে অন্য অনেকের সঙ্গে জামাতপন্থী আইনজীবী হিসেবে আদালতপাড়ায় পরিচিত অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলামও ছিলেন। তবে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাকে জামায়াতের সাবেক নেতার কাতারে ফেলবেন না। আমি জামাতের আইনজীবী ছিলাম তাদের দলের লোক না।’
সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা মাওলানা আবদুল কাদের, ব্যবসায়ী নজমুল হুদা অপু, সাবেক বিমান বাহিনী কমকর্তা সালাহ উদ্দিন, জুবায়ের হোসেন, যুদ্ধাপরাধে জড়িতদের আইনজীবী হিসেবে কাজ করা তাজুল ইসলাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. কামাল উদ্দিন, অ্যাডভোকেট মোস্তফা নূর, গোলাম ফারুক, ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতি এহসান জুবায়ের প্রমুখ।এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরেরও সভাপতি ছিলেন। বহিষ্কৃত হওয়ার আগে জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সদস্য ছিলেন তিনি।
No comments: