ব্যর্থ কোহলি, রাহানে, রাহুল,
বিজয়, দুরন্ত ক্যাচ খাওয়াজার
পূজারার অনবদ্য সেঞ্চুরি
লড়াইয়ে ফেরাল ভারতকে
ভারত ২৫০/৯
তারকারা জানেন বড় মঞ্চকে কীভাবে কাজে লাগাতে হয়! অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে প্রবল চাপের মুখে শতরান করে সেটাই প্রমাণ করলেন চেতেশ্বর পূজারা। টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে দীর্ঘ সাধনা ও নিবিড় অনুশীলনের কারণেই দলে বাকিদের থেকে তিনি আলাদা। দুই ওপেনার লোকেশ রাহুল ও মুরলী বিজয় যথাক্রমে মাত্র ৮ ও ২২টি বল, কোহলি খেলেন ১৬টি বল। এতেই স্পষ্ট ভারতের টপ অর্ডার ব্যাটিংয়ের দৈন্যদশা।
টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে একটা সময় ১২৭ রানে ৬ উইকেট পড়ে গিয়েছিল ‘টিম ইন্ডিয়া’র। কুম্ভের মতো একা দুর্গরক্ষা করে পূজারা শুধু টেস্ট কেরিয়ারের ষষ্ঠদশ সেঞ্চুরি পূর্ণ করেননি, সেই সঙ্গে দলকে খাদের কিনারা থেকে লড়াইয়ে ফিরিয়ে আনেন। ২৪৬ বলে তাঁর ১২৩ রানের ইনিংসের ওপর ভর করে প্রথম দিনের শেষে ‘টিম ইন্ডিয়া’ ৯ উইকেট ২৫০ রান তুলেছে। শেষলগ্নে কামিন্সের অসাধারণ ডাইরেক্ট থ্রোয়ে পূজারা রান আউট না হলে অজিরা হয়তো নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারতেন না! শর্ট মিড উইকেটে বল ঠেলে পূজারা স্ট্রাইক ধরে রাখতে গিয়ে ঝুঁকিবহুল সিঙ্গলস নিতে যান। মাত্র একটা স্টাম্প দৃশ্যমান ছিল প্যাট কামিন্সের সামনে। অনবদ্য থ্রোয়ে তিনি স্টাম্প ভেঙে দেন।
বিগত কয়েকদিন ধরে প্রচারের পুরো আলোটাই শুষে নিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন বিরাট কোহলি। অ্যাডিলেড ওভালে তাঁর চমকপ্রদ সাফল্যের পরিসংখ্যান প্রত্যাশার পারদ আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু ডনের শহরে কোহলির ব্যাটে ডঙ্কা বাজেনি। ১৬ বলে মাত্র ৩ রান করেছেন ভারত অধিনায়ক। প্যাট কামিন্সের বলে ড্রাইভ করতে চেয়েছিলেন কোহলি। কিন্তু গালিতে উসমান খাওয়াজা দুরন্ত প্রয়াসে তাঁর ক্যাচটি তালুবন্দি করতেই কমেন্ট্রি বক্সে অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন অধিনায়ক মাইকেল ক্লার্ক বলে ওঠেন ‘কিং গন’। অফ স্টাম্পের অনেকটা বাইরের বল খেলে কোহলি বড় ভুল করেছেন। তবে প্রশংসা করতেই হবে উসমান খাওয়াজার ফিল্ডিংয়ের। বাজপাখির মতো বাঁদিকে ঝাঁপিয়ে তিনি কোহলির ক্যাচটি শূন্যে উড়ে গিয়ে একহাতে তালুবন্দি করতেই উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে অজি শিবির। হ্যাজলউড, স্টার্কদের দাপটে মাত্র ১৯ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে শুরুতেই বিপাকে পড়ে যায় ভারত। মৃত্যু মিছিলে দেশের সম্মানার্থে একা লড়ে গিয়েছেন শুধুই পূজারা।
প্রথম টেস্টে পৃথ্বী সাউয়ের অভাব বেশ ভালোই টের পাওয়া গেল। দুরন্ত ফর্মে থাকা পৃথ্বীর চোট ভারতের টপ অর্ডার ব্যাটিংয়ের ভিতটাই নড়িয়ে দিয়েছে। যে পরীক্ষার্থী টেস্টে পাস করতে পারেন না, তিনি ফাইনালে কী আর করবেন? পারেননি লোকেশ রাহুল। মাত্র ৮ বল খেলে ২ রান করে তিনি হ্যাজলউডের অফ স্টাম্পের বাইরের বলে ড্রাইভ করতে গিয়ে তৃতীয় স্লিপে ফিনচের হাতে ধরা পড়েন। কামব্যাক ম্যাচে ব্যর্থ মুরলী বিজয়ও। অ্যাডিলেডের পিচে তেমন কোনও জুজু ছিল না। প্রথম এক ঘণ্টায় পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তেই বল মুভ করে। কারণ, সিম পজিশন নতুন থাকায় পেসাররা সুবিধা পান। তাই প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক সুনীল গাভাসকর বলেছিলেন, ‘টেস্ট ক্রিকেটে ব্যাটসম্যানদের সাফল্য পাওয়ার মূল মন্ত্র হল, প্রথম এক ঘণ্টা বোলারকে দাও, বাকি পাঁচ ঘণ্টা তুমি খেল।’ কিন্তু লোকেশ রাহুল, মুরলী বিজয়, এমনকী বিরাট কোহলিও সেই যুক্তির ধার ধারেননি। টেস্ট ব্যাটসম্যান হিসাবে পরিচিতি রয়েছে অজিঙ্কা রাহানের। দল যখন বিপদে, তখন পূজারার সঙ্গে বড় জুঁটি বাধা উচিত ছিল তাঁর। তিনি সহ-অধিনায়ক। কিছু দায়িত্ব তো তাঁরও রয়েছে। চতুর্থ উইকেটে পূজারার সঙ্গে জুটি বেঁধে ৫৯ বল খেলে ২২ রান যোগ করার পরেও রাহানে বিশ্রী শট খেলে আউট হন। হ্যাজলউডের বিলম্বিত সুইংয়ে পরাস্ত হয়ে দ্বিতীয় স্লিপে হ্যান্ডসকম্বের হাতে ধরা পড়েন রাহানে। ৩১ বলে তাঁর সংগ্রহ ১৩ রান।
লাঞ্চে ভারতের স্কোর ছিল ৫৬ রানে ৪ উইকেট। পঞ্চম উইকেটে পূজারার সঙ্গে রহিত শর্মার জুটি বেশ ভালোই এগচ্ছিল। দীর্ঘদিন পর টেস্ট খেলতে নেমে রহিত প্রথম থেকেই আক্রমণাত্মক মেজাজে ব্যাট করছিলেন। তিনটি ওভার বাউন্ডারি ও দু’টি বাউন্ডারিও হাঁকান তিনি। যদিও আগ্রাসী ব্যাটিং করতে গিয়েই ফাঁদে পড়েন রহিত। একটা ওভার বাউন্ডারি হাঁকানোর পর নাথান লিয়ঁর বলে তুলে মারতে গিয়ে তিনি ৬১ বলে ৩৭ রানে হ্যারিসের হাতে ক্যাচ দিয়ে মাঠ ছাড়েন। টি-২০ এবং ওয়ান ডে’র দাপটে টেস্ট খেলার ‘সহজ পাঠ’ ভুলে বসেছেন অধিকাংশ ভারতীয় ব্যাটসম্যান। তার জলজ্যান্ত উদাহরণ ঋষভ পন্থ। উলটো দিকে চেতেশ্বর পূজারার মতো একজন ব্যাটসম্যানকে দেখেও তাঁর শেখার কোনও তাগিদ নেই। প্রথম বল থেকেই চালিয়ে খেলে দ্রুত গতিতে রান তুলতে গিয়েই ভুল করেন ঋষভ। ২টি চার ও একটি ছক্কার সাহায্যে ৩৮ বলে ২৫ রান করে নাথান লিয়ঁর স্পিনে পরাস্ত হয়ে উইকেটরক্ষকের হাতে ধরা পড়েন ঋষভ।
একটা সময় মনে হয়েছিল দু’শোর গণ্ডিও টপকাতে পারবে না ভারত। কিন্তু সপ্তম উইকেটে চেতেশ্বর পূজারার সঙ্গে জুটি বেঁধে রবিচন্দ্রন অশ্বিন দুরন্ত ব্যাটিং করে ৬২ রান যোগ করেন। এটাই ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট। ১৫৩ বলে হাফ-সেঞ্চুরি করেন পূজারা। ধীরে ধীরে দুই ব্যাটসম্যান ম্যাচের উপর জাঁকিয়ে বসতে শুরু করেন। ২৫ রানে অশ্বিন আউট হওয়ার পর পূজারা কিছুটা চালিয়ে খেলেন। টেল এন্ডারদের নিয়ে এই লড়াই যে দীর্ঘস্থায়ী হবে না সেটা ভালোই বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। ৮৪তম ওভারে হ্যাজলউডের পঞ্চম বলে পূজারা দ্বিতীয় ছক্কাটি হাঁকান। পরের বলটি বাউন্ডারির বাইরে পাঠিয়ে ৯৯-এ পৌঁছে যান পূজারা। সেই সঙ্গে তিনি দ্বাদশ ভারতীয় ক্রিকেটার হিসাবে টেস্টে পাঁচ হাজার রান পূর্ণ করেন। শেষ পর্যন্ত ২৩১ বলে কেরিয়ারের অন্যতম সেরা সেঞ্চুরির স্বাদ পান পূজারা। বড় রান না করতে পারলেও লড়াইয়ে পূজারাকে দারুণভাবে সাহায্য করেছেন ইশান্ত শর্মা (২০ বলে ৪), মহম্মদ সামি (অপরাজিত ৬)। শতরানের পর পূজারা ১৫ বলে যোগ করেন ২৩ রান। তাঁর এই লড়াই তখনই প্রাপ্য মর্যাদা পাবে, যদি ম্যাচের দিনে নতুন বলে ভারতীয় পেসাররা পালটা আঘাত হানতে পারেন অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিংয়ে।
No comments: