হাওরাঞ্চলের ১১টি উপজেলায় গ্রামীণ ফোন, বাংলালিংক ও রবির টাওয়ার বসানো হয়েছে বিভিন্ন গ্রাম ও পাড়ার মধ্যে। প্রতিটি টাওয়ার চালাতে ব্যবহার করা হচ্ছে উচ্চশক্তির জেনারেটর। এ জেনারেটরগুলো স্থাপন করা হয়েছে বসতঘর ও খোলা স্থানে। প্রতিটি টাওয়ারের তিনটি জেনারেটর থেকে উৎপন্ন বিকট শব্দ ও ঝাঁকুনিতে কাঁপছে পুরো এলাকা। গেল ১৫ বছর ধরে বাড়ির পাশে চলা এমন শব্দদূষণের কারণে নানা ধরনের অসুখে ভুগছেন টাওয়ারসংলগ্ন বাসিন্দারা। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য গ্রামবাসী ওই মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলো ও বিভিন্ন দপ্তরে নানা আবেদন নিবেদন করলেও সমস্যার সমাধানে কোনও উদ্যোগ নেই। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ চেয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
জানা যায়, জেলার তাহিরপুর, জামালগঞ্জ, ধর্মপাশা, দিরাই, শাল্লা, বিশ্বম্ভরপুর, ছাতক, দোয়ারা বাজার, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, সুনামগঞ্জ সদর, জগন্নাথপুরসহ ১১টি উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নের গ্রামের জনবসতি ও বসতবাড়ির পাশেই স্থাপন করা হয়েছে মোবাইল ফোনের টাওয়ার। বিদ্যুৎসংযোগ থাকলে কম শব্দ আর বিদ্যুৎ না থাকলে এসব টাওয়ারের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন জেনারেটরের শব্দের কারণে অবর্ণনীয় দুর্ভোগে আছেন সবাই। এখন উচ্চশব্দের কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পাড়ার শিশুদের পড়ালেখার মনোযোগ, সব বাসিন্দারা ভুগছেন উচ্চ রক্তচাপ ও কানে কম শোনা রোগে। ওইসব স্থানে জন্ম হচ্ছে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু। এমন অবস্থায় টাওয়ারসংলগ্ন পরিবার বাড়ি ছেড়েছে। আর যারা আছেন অন্যত্র যাওয়ার কোনও সুযোগ না থাকায় বাধ্য হয়ে অবস্থান করছেন। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ চেয়েছেন ভুক্তভোগী বাসিন্দারা।
আরও জানা যায়, জেলার তাহিরপুর উপজেলার দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নের রামসিংহপুর গ্রামের দাসপাড়ার বাসিন্দারা বিদ্যুৎবিহীন রামসার সাইট হিসাবে অন্তর্ভুক্ত টাঙ্গুয়ার হাওরের দক্ষিণ পাড়ে অবস্থিত। একশত বর্গগজ আয়তনের দাসপাড়া গ্রামটিতে ২০টি পরিবারের বসবাস। পাড়ার লোকসংখ্যা দেড় শতাধিক। রামসিংহপুর ও দাসপাড়া বছরের ছয়মাস হাওরের ১০ ফুট পানি দ্বারা বেষ্টিত থাকে। ১৫ বছর পূর্বেও এই পাড়াটি ছিল যান্ত্রিক শব্দবিহীন। পাড়ার বাসিন্দাদের ঘুম ভাঙত পাখির কলকাকলিতে। কানে আসত বাতাসের শব্দ আর বাড়ির ঢেউ রক্ষা বাঁধে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের গর্জন। এখন তাদের সবাই নানা ধরনের অসুখে ভুগছেন। আর তিনটি টাওয়ারের জেনারেটরের শব্দে পাখিরা পাড়া ছেড়েছে ১৫ বছর আগেই।
চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ও স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে আরও জানা যায়, ২০০৩ সালে গ্রামীণফোন টাওয়ার স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু করলে বাধা দেয় গ্রামবাসী। এসময় গ্রামবাসীর কাছে টাওয়ার নির্মাণ করতে আসা লোকজন কথা দিয়েছিলেন কোনও ধরনের শব্দদূষণ হবে না। আর পাড়ার বাসিন্দাদের ঘরে ঘরে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ দেবেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত প্রতিশ্রুতি রাখেননি তারা। এখন উচ্চশব্দের কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে শিশুদের পড়ালেখার মনোযোগ, বাসিন্দারা ভুগছেন উচ্চ রক্তচাপ ও কানে কমশোনাসহ নানা ধরনের নিউরোলজিকেল রোগে।
তারা আরও জানান, রামসিংহপুর দাসপাড়া গ্রামে ২০০৩ সালে গ্রামীণ ফোন, ২০১০ সালে বাংলালিংক ও ২০১৪ সালে রবি মোবাইল ফোন কোম্পানির টাওয়ার বসানো হয়। এয়ারটেল ২০১০ সালে একই স্থানে টাওয়ার স্থাপন করলেও ২০১৭ সালে এই টাওয়ারটি বন্ধ করে দেয়ায় দাসপাড়ায় তিনটি মোবাইল অপারেটর নিজ নিজ টাওয়ার থেকে তিনটি জেনারেটর ব্যবহার করে তাদের নেটওয়ার্ক সার্ভিস চালু রাখছে। এ শব্দদূষণ কমাতে তারা অসংখ্যবার ওই মোবাইল কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কথা বললেও পাত্তা দিচ্ছেন না তারা। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদে লিখিত আবেদন করা হলেও কোনও কাজ হচ্ছে না।
তাহিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা.ইকবাল হোসেন বলেন, মাত্রাতিরিক্ত শব্দদূষণ মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক। এতে করে মাথা ব্যথা, কানে কম শোনা, উচ্চ রক্তচাপ ও স্টোক হতে পারে। স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে। শিশু, গর্ভবতী ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে নানামুখী সমস্যা হতে পারে।
সংশ্লিষ্ট দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বিশ্বজিত সরকার বলেন, মোবাইল কোম্পানিগুলো তাদের নেটওয়ার্ক চালাতে ইউনিয়নের দাসপাড়া গ্রামে শব্দ সন্ত্রাস চালাচ্ছে। এই পাড়ার বাসিন্দারা দৈহিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ ভাইস চেয়ারম্যান ফেরদৌস আলম আখঞ্জি বলেন, শব্দদূষণের কারণে নানান রোগে ও সমস্যায় ভুগতে হয়। এর থেকে সংশ্লিষ্ট টাওয়ার সংলগ্ন এলাকা শব্দদূষণ মুক্ত থাকার জন্য মোবাইল কোম্পানিগুলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।
No comments: