এগারো দিন পরই বাজবে রাশিয়া বিশ্বকাপের বাঁশি। ২০টি বিশ্বকাপ পেরিয়ে এসেছে ফুটবল মহাযজ্ঞের যাত্রাপথ। প্রথম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিল উরুগুয়ে। আগের আসরগুলোর পরতে পরতে ঠাসা রোমাঞ্চকর নানা গল্প। চ্যানেল আই অনলাইনের পাঠকদের ধারাবাহিকভাবে ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে ইতিহাসের ধূলিজমা সেসব পাতায়। আজ থাকছে জার্মানি বিশ্বকাপ ২০০৬’র কথা-
শুধু ফুটবল খেলা বা শিরোপা জয়ের জন্য নয়, কার্ডের জন্যও যে একটা বিশ্বকাপ ইতিহাসে ‘চিরস্মরণীয়’ হয়ে থাকতে পারে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ২০০৬ বিশ্বকাপ। জার্মানির মতো পরাশক্তি ঘরের মাঠে শিরোপা জিততে পারেননি। তবু হলুদ আর লাল কার্ডের চাপে ঢেকে যায় স্বাগতিকদের ব্যর্থতা আলোচনা।
২০০৬ সালে জার্মানিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের আছে সর্বোচ্চ ২৮টি লাল কার্ডের বিশ্বরেকর্ড; আছে বিশ্বকাপের এক ম্যাচে সবচেয়ে বেশি চারটি লালকার্ড আর চার চারে ষোলোটি হলুদ কার্ডের রেকর্ডও। আর ম্যাচপ্রতি ৫.৩৯ গড়ে মোট ৩৪৫টি হলুদ কার্ডের টুর্নামেন্টগাথা না বললে অন্যায়ই করা হবে হলুদ কার্ডের প্রতি!
বিশ্বকাপ-১৯৭৮, বিশ্বকাপ-১৯৮২, বিশ্বকাপ-১৯৮৬, বিশ্বকাপ-১৯৯০, বিশ্বকাপ-১৯৯৪, বিশ্বকাপ-১৯৯৮, বিশ্বকাপ-২০০২
তবে রেকর্ডের চেয়ে বড় ঘা হয়ে আছে জিনেদিন জিদানের লাল কার্ডের ট্র্যাজেডি। যে কার্ডের পর মহানায়কের সঙ্গে ঝরে পড়েছিল ফরাসি সাম্রাজ্যও।
ওই বিশ্বকাপে রুশ রেফারি ভ্যালেন্টিন ইভানোভ ১৬ দলের নক আউট পর্বে শুধুমাত্র পর্তুগাল এবং নেদারল্যান্ডসের মধ্যকার খেলাতেই ১৬টি হলুদ এবং ৪টি লাল কার্ড দেখান, পরে ওই ম্যাচ ‘ব্যাটল অফ নুরেমবার্গ’ নামে পরিচিত পায়।
পর্তুগালের দুজন খেলোয়াড়কে যথাক্রমে কোয়ার্টার ফাইনাল এবং সেমিফাইনালে লাল কার্ড দেখানো হয়। ফিফা সভাপতি সেপ ব্লাটার তাতে ইঙ্গিত দেন যে তিনি নিয়ম-কানুনে কিছু পরিবর্তন আনতে পারেন, যেন পরবর্তী প্রতিযোগিতাগুলোতে কোনো খেলোয়াড়কে কার্ড দেখানোর পরও তার দল ফাইনালে পৌঁছালে যাতে ফাইনালে খেলতে পারেন সেই খেলোয়াড়।
প্রতিযোগিতায় ইংলিশ রেফারি গ্রাহাম পোল ভুলক্রমে ক্রোয়েশিয়ার ইয়োসিপ শিমুনিচকে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলায় তিনবার হলুদ কার্ড দেখান। সেটিও বিরল ঘটনাই।
প্রতিযোগিতায় হলুদ এবং লাল কার্ডের আধিক্য রেফারিদের আলোচনায় নিয়ে আসে। ফিফার সভাপতি এবং কর্মকর্তারা অনমনীয় নিয়ম তৈরির জন্য সমালোচনার মুখে পড়েন।
সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটে ফাইনালে। মাঠে জিদান এবং মাতেরাজ্জি পরস্পরের কাছাকাছি থাকাকালে মাতেরাজ্জি জিদানের জার্সি ধরে টান দেন। এরপর তারা নিজেদের মধ্যে বিবাদে জড়িয়ে যান। একটা সময় জিদান মাতেরাজ্জির কাছে থেকে চলে যেতেও শুরু করেন। কিন্তু হঠাৎ করেই জিদান থেমে যান এবং উল্টো দিকে ঘুরে মাতেরাজ্জির বুকে মাথা দিয়ে আঘাত করে মাটিতে ফেলে দেন। যা ঢুস কাণ্ড হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। তখন খেলা সাময়িকভাবে থেমে থাকার পরও, রেফারি ওরাসিও এলিজোন্দো ঘটনাটি দেখতে পাননি। ম্যাচ অফিসিয়ালদের প্রতিবেদন অনুসারে, চতুর্থ অফিসিয়াল লুইস মেদিনা কান্তালেহো হেডসেটের মাধ্যমে এলিজোন্দোকে ঘটনাটি সম্পর্কে অবহিত করেন।
সহকারীদের সাথে পরামর্শ করার পর, খেলার ১১০ মিনিটে রেফারি এলিজোন্দো জিদানকে লাল কার্ড দেখান। সেটি জিদানের ক্যারিয়ারের ১৪তম লালা কার্ড ছিল এবং তিনিও ক্যামেরুনের রিগোবের্ত সংয়ের মতো দুটি আলাদা বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতায় লাল কার্ড পাওয়া খেলোয়াড় হয়ে যান। জিজু বিশ্বকাপের ফাইনালে লাল কার্ড পাওয়া চতুর্থ খেলোয়াড় এবং অতিরিক্ত সময়ে লাল কার্ড পাওয়া প্রথম খেলোয়াড়। তাতে ক্ষতি ফ্রান্সেরই, ফাইনাল হাতছাড়া হয়ে যায়!
সেমিফাইনালে স্বাগতিক জার্মানিকে ২-০ গোলে হারিয়ে ফাইনালে উঠেছিল ইতালি। আর লুইস ফিগোর পর্তুগালকে ১-০তে হারিয়ে ফাইনাল নিশ্চিত করে ফ্রান্স। দুই পরাশক্তির ফাইনালটা হয় হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের।
অতিরিক্ত সময়েও ফল না হওয়ায় ম্যাচ গড়ায় পেনাল্টি শ্যুটআউটে। যেখানে ৫–৩ ব্যবধানে ফ্রান্সকে হারিয়ে নিজেদের চতুর্থ শিরোপা জেতে আজ্জুরিরা। ফ্রান্সের ডেভিড ত্রেজেগে, যিনি ইউরো ২০০০এর ফাইনালে ইতালির বিপক্ষে গোল্ডেন গোল করেছিলেন, তার স্পটকিকই ক্রসবারে প্রতিহত হয়। তাতে শিরোপাটা হাতছাড়া হয় ফরাসিদের।
২০০৬ বিশ্বকাপে সার্বিয়ার বিপক্ষে আর্জেন্টিনার সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপে অভিষেক হয়েছিল হালের ফুটবল গ্রেট লিওনেল মেসির।
২০০৬ বিশ্বকাপ ফিফা বিশ্বকাপের আঠারোতম আসর ছিল। ২০০৬ সালের ৯ জুন থেকে ৯ জুলাই পর্যন্ত প্রতিযোগিতাটি জার্মানিতে হয়। ২০০০ সালের জুলাই মাসে জার্মানি প্রতিযোগিতার আয়োজক হিসেবে নির্বাচিত হয়।
ছয়টি মহাদেশের ১৯৮টি জাতীয় ফুটবল দল প্রতিযোগিতার বাছাইপর্বে অংশ নেয়। বাছাইপর্ব শুরু হয় ২০০৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। আয়োজক জার্মানি ছাড়া আরো ৩১টি দল বাছাইপর্ব অতিক্রম করে চূড়ান্তপর্বে খেলা নিশ্চিত করে। পর্তুগালকে ৩–১ গোলে হারিয়ে আসরে তৃতীয় হয় স্বাগতিক জার্মানি।
ওই বিশ্বকাপ ছিল টেলিভিশনের ইতিহাসে সর্বোচ্চ দর্শকসমৃদ্ধ বিশ্বকাপের একটি। আনুমানিক ২৬.২৯ বিলিয়ন দর্শক প্রতিযোগিতাটি দেখেছেন। ফাইনাল খেলা দেখেছেন প্রায় ৭১৫.১ মিলিয়ন দর্শক। সংখ্যার বিচারে ২০০৬ বিশ্বকাপের অবস্থান চতুর্থ। এর আগের অবস্থানে রয়েছে ১৯৯৪, ২০০২ ও ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপ।
২০০৬ বিশ্বকাপের জন্য আয়োজক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০০০ সালের জুলাইয়ে সুইজারল্যান্ডের জুরিখে। এতে অংশ নেয় চারটি দেশ জার্মানি, সাউথ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড এবং মরক্কো। নির্বাচন অনুষ্ঠানের তিন দিন আগে ব্রাজিল তাদের প্রার্থীতা প্রত্যাহার করে। নির্বাচন হয় তিনটি পর্বের সমন্বয়ে। প্রতি পর্বে সবচেয়ে কম ভোট পাওয়া দেশ নির্বাচন থেকে বাদ পরে যায়। এতে বিজয়ী হয় জার্মানি।
আসরে আটটি দেশ প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। চেক রিপাবলিক এবং ইউক্রেন প্রথমবারের মতো স্বাধীনরাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বকাপে অংশ নেয়। এর আগে তারা যথাক্রমে চেকোস্লোভাকিয়া এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ হিসেবে বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছিল; সার্বিয়া ও মন্টেনেগ্রো অংশ নেয় ১৯৯৮ সালে যুগোস্লাভিয়ার অংশ হিসেবে।
অস্ট্রেলিয়া ১৯৭৪ সালের পর প্রথমবারের মতো সুযোগ পায় সেবার। বাছাইপর্বে ব্যর্থ হওয়া দলগুলোর মধ্য ২০০২ বিশ্বকাপের তৃতীয় স্থান অর্জনকারী তুরস্ক এবং ইউরো ২০০৪ বিজয়ী গ্রিস উল্লেখযোগ্য ছিল। বেলজিয়াম ১৯৭৮ সালের পর এবং ক্যামেরুন ১৯৮৬ সালের পর প্রথমবার বিশ্বকাপে অংশ নিতে ব্যর্থ হয় সেবার।
১৯৮২ বিশ্বকাপের পর প্রথমবারের মতো ছয়টি কনফেডারেশনের কোনো না কোনো দল বিশ্বকাপে অংশ নেয়। বিশ্বকাপের খেলার জন্য ফিফা নির্ধারিত কমপক্ষে ৪০,০০০ ধারণক্ষমতা সম্পন্ন স্টেডিয়ামের আধিক্যের কারণে, বিশ্বকাপ আয়োজনে ফিফার সন্তুষ্টি অর্জন করে জার্মানি।
বিশ্বকাপের খেলাগুলো আয়োজনের জন্য ১২টি স্টেডিয়ামকে নির্বাচিত করা হয়। যেহেতু ফিফা স্পন্সরশিপ নিষিদ্ধ করে, তাই প্রতিযোগিতার সময়, অনেকে স্টেডিয়ামের ক্ষেত্রেই ভিন্ন নাম ব্যবহার করা হয়।
No comments: