৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায়, এতে খালেদা জিয়ার সাজা হলে এবং তিনি নির্বাচনে ‘অযোগ্য’ হলে দলের অবস্থান কী হবে; তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বৈঠকে সার্বিক বিষয়ে দলের কর্মপরিকল্পনা ও জাতীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিস্তারিত তুলে ধরবেন খালেদা জিয়া। রায়কে কেন্দ্র করে সরকারকে কোনো আলটিমেটাম বা হুশিয়ারি দেবেন না তিনি। সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নিতে সরকারকে আবারও সমঝোতার আহ্বান জানাতে পারেন। বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রেখে একতরফা নির্বাচন থেকে সরে আসার আহ্বান জানাবেন। দলের ঐক্যের দিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবেন তিনি। মামলা, হামলা ও জুলুম-নির্যাতনের মধ্যেও দলের প্রতি আনুগত্য থাকায় তৃণমূলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাবেন খালেদা জিয়া। আন্দোলন ও নির্বাচনের প্রস্তুতির পাশাপাশি যে কোনো পরিস্থিতিতে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানাবেন তিনি। এছাড়া বৈঠকে তৃণমূল নেতারাও তাদের মতামত তুলে ধরবেন। প্রায় সবারই মত, চেয়ারপারসনকে ছাড়া বিএনপির কোনো নির্বাচনে যাওয়া ঠিক হবে না।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, নির্বাচনের এ বছরে চলমান রাজনৈতিক জটিল পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে আমাদের দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির এ সভা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ সভাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ। এ সভা থেকে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দেশবাসীর উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেবেন।
তিনি আরও বলেন, এ সভায় দেশের চলমান রাজনীতি ও আগামী নির্বাচন নিয়ে কী করণীয় সে সম্পর্কে তৃণমূলসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের মতামত শুনবেন চেয়ারপারসন।
আজ সকালে হোটেল লা মেরিডিয়ানে নির্বাহী কমিটির এ বর্ধিত সভা হবে। প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও ইতিমধ্যে বৈঠকের সার্বিক প্রস্তুতি শেষ করেছে দলটি। বিএনপির দফতর সূত্রে জানা গেছে, নির্বাহী কমিটির বৈঠকে দলের ৭০০ নেতা উপস্থিত থাকবেন। এর মধ্যে নির্বাহী কমিটির সদস্য ৫০২ জন। এছাড়া স্থায়ী কমিটির সদস্য, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও জেলা সভাপতিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। ইতিমধ্যে তাদের আমন্ত্রণপত্র বিতরণ করা হয়েছে।
দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, নির্বাহী কমিটির সভার সব প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। সকাল ১০টা থেকে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হবে। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। সকাল সাড়ে ৮টা থেকে সভাস্থলে নির্বাহী কমিটির কর্মকর্তা ও সদস্যদের রেজিস্ট্রেশন শুরু হবে বলেও জানান তিনি।
দলীয় সূত্র জানিয়েছে, নির্বাহী কমিটির সভায় দল পরিচালনার ব্যাপারে কোনো দিকনির্দেশনা থাকছে না বিএনপি চেয়ারপারসনের বক্তব্যে। দলটি মনে করছে, এখনও রায় ঘোষণা করা হয়নি। রায়ে দলীয় প্রধান খালাস পেতে পারেন। তাই আগেভাগেই দল পরিচালনা নিয়ে আগাম বক্তব্য দলের জন্য ক্ষতিকর হবে, সরকার সেই সুযোগ নিতে পারে।
দলের যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, নির্বাহী কমিটির সভায় দল পরিচালনার ব্যাপারে কোনো দিকনির্দেশনা থাকছে না। তিনি প্রত্যাশা করেন, মিথ্যা মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালাস পাবেন। এ মুহূর্তে দল পরিচালনার ব্যাপারে আগাম চিন্তা অভ্যন্তরীণ সমস্যার খোরাক জোগাবে, সেই ভুল বিএনপি করবে না। দলের বিপদ হলে সে ক্ষেত্রে দলের গঠনতন্ত্রে বিএনপি চেয়ারপারসনকে ক্ষমতা দেয়া রয়েছে, তিনি দল পরিচালনার ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন।
দলের গঠনতন্ত্রের ৭-এর খ ধারার ৩ উপধারায় চেয়ারপারসনের কর্তব্য, ক্ষমতা ও দায়িত্বের কথা বলা আছে। জাতীয় নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে এ কমিটির কর্মকর্তাদের দায়-দায়িত্ব, ক্ষমতা ও কর্তব্য নিরূপণ করবেন।
তিনি আরও বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তৃণমূল নেতাদের বক্তব্য শুনবেন। হয়তো সেখানে নেতারা বলতে পারেন, বিএনপিকে নির্বাচনে যেতে বাধা সৃষ্টি করতেই সরকার ষড়যন্ত্র করছে। সে ক্ষেত্রে খালেদা জিয়া শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনের ব্যাপারে এবং দলের ঐক্য ধরে রাখার ব্যাপারে নেতাদের দিকনির্দেশনা দেবেন।
জানা গেছে, যে কোনো পরিস্থিতিতে দলের ঐক্যের দিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। রায় নেতিবাচক হলেও কোনো ধরনের সহিংসতা নয়, ঐক্যবদ্ধ ও শান্তিপূর্ণভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলায় নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দেবেন তিনি। সরকার বিশেষ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে বিএনপিকে ফাঁদে ফেলতে পারে সেদিকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেবেন তিনি।
সূত্র জানায়, নির্বাহী কমিটির বৈঠকে দলের গঠনতন্ত্র নিয়েও আলোচনা হবে। গঠনতন্ত্রের ৭ ধারা কেন বাতিল করা হয়েছে তার যৌক্তিক কারণও তৃণমূলের কাছে তুলে ধরা হতে পারে। গঠনতন্ত্রের ওই ধারাকে পুঁজি করে তৃতীয় কোনো পক্ষ দলে ভাঙন বা বিভেদ সৃষ্টি করতে পারে সেজন্যই এ ধারা বাতিল করা হয়েছে।
জানা গেছে, রায় প্রসঙ্গেও কথা বলবেন খালেদা জিয়া। মিথ্যা মামলায় তাকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে সরকার ষড়যন্ত্র করছে এমন অভিযোগ করে তিনি বলতে পারেন, ন্যায়বিচার হলে তিনি বেকসুর খালাস পাবেন।
তৃণমূলের উদ্দেশে চেয়ারপারসন বলবেন, অতীতে যে কোনো পরিস্থিতিতে আপনারা ঐক্যবদ্ধ ছিলেন। তৃণমূলই বিএনপির প্রাণ। আশা করি ভবিষ্যতেও ঐক্যবদ্ধ থেকে যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করবেন। বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে যেসব নেতাকর্মী নিহত ও আহত হয়েছেন তাদের পাশে থাকার ঘোষণার পাশাপাশি যারা কারাগারে আছেন কিংবা যাদের নামে মামলা রয়েছে তাদের সর্বোচ্চ আইনি সহায়তা দেয়া হবে বলে আশ্বাস দেবেন তিনি। এ ব্যাপারে দলীয় আইনজীবীদের সমন্বয়ে গঠিত লিগ্যাল এইডকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে বলবেন।
তৃণমূল নেতারাও তাদের মতামত তুলে ধরবেন। আগামী নির্বাচন ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে তারা পরামর্শ দেবেন। তৃণমূলের একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, খালেদা জিয়াকে ছাড়া বিএনপির নির্বাচনে যাওয়া উচিত হবে না এবং সে নির্বাচন প্রতিহত করা উচিত হবে বলে তারা মত দেবেন। আগামী নির্বাচনে মনোনয়নের বিষয়টিও কেউ কেউ আলোচনায় আনতে পারেন। বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে যারা রাজপথে ছিলেন তাদের মধ্য থেকেই যেন মনোনয়ন দেয়া হয় এমন পরামর্শ দেবেন তারা। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় তৃণমূল ঐক্যবদ্ধ ও প্রস্তুত আছে বলেও চেয়ারপারসনকে আশ্বস্ত করার পাশাপাশি উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দলের মধ্যে যাতে কেউ বিভেদ বা দল ভাঙার ষড়যন্ত্র করতে না পারে সে ব্যাপারে হাইকমান্ডকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেবেন তারা। এ ধরনের কাজে যাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে তাদের দল থেকে আজীবন বহিষ্কারের দাবি জানাতে পারেন কেউ কেউ।
বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বাবুল যুগান্তরকে বলেন, বর্তমান বাস্তবতায় আজকের বৈঠক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপির আগামী দিনের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে চেয়ারপারসন নেতাদের একটা ধারণা দিতে পারেন। মাঠের নেতাদের মনোভাব সম্পর্কে জানার পর হাইকমান্ড সার্বিক বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবেন।
জাতীয় নির্বাহী কমিটি গঠনের ২ বছর পর আজকের এ বৈঠকে ৫০২ সদস্য ছাড়াও বিভিন্ন জেলা শাখা ও সহযোগী সংগঠনগুলোর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক উপস্থিত থাকবেন। শুক্রবার নয়াপল্টনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিকাল ৫টা পর্যন্ত নির্বাহী কমিটির ৪০০ সদস্য ইতিমধ্যে তাদের পরিচয়ধারী কার্ড সংগ্রহ করেছেন। এ ব্যাপারে দলের সহ-দফতর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু যুগান্তরকে বলেন, দলের কার্যালয়ে পরিচয়পত্র সংগ্রহ করতে এসেও অনেকেই গ্রেফতার হয়েছেন। এজন্য যারা এখনও সংগ্রহ করেনি তারা নির্বাহী কমিটির সভা শুরুর আগে হোটেল লা মেরিডিয়ান থেকেও পরিচয়পত্র সংগ্রহ করতে পারবেন।
বৈঠকের শুরুতেই শোক প্রস্তাব উত্থাপন ও পরে দলের সাংগঠনিক রিপোর্ট জানাবেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সাংগঠনিক রিপোর্ট শেষে উদ্বোধনী বক্তব্য রাখবেন দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। পরের সেশনে নির্বাহী কমিটির সদস্যদের নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করবেন খালেদা জিয়া।
No comments: