বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রেসিডেন্ট রবার্ট জেলিককে ‘অপদার্থ’ ও ‘অসম্ভব বাজে লোক’ বলেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তোলার প্রসঙ্গ ধরে তিনি এ কথা বলেন।
সোমবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আয়োজিত ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘ভ্যাট সম্মাননা সনদ’ দেওয়ার সময় এ কথা বলেন অর্থমন্ত্রী।
২০১১ সালে পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে সরকারের টানাপড়েনের সময় বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ছিলেন জেলিক। পরের বছর তার চাকরি শেষ হওয়ার ঠিক আগে বাংলাদেশের সঙ্গে ঋণচুক্তি বাতিল করে যান তিনি।
মুহিত বলেন, সেই অপদার্থটা (রবার্ট জেলিক) তার চাকরির শেষ দিন বাংলাদেশ সম্পর্কে অভিযোগ করল যে, আমরা কোনো একটি কনসালটেন্টকে নিয়োগ করার জন্য চক্রান্ত করছি। ঘুষ নেওয়ার চক্রান্ত করছি। এই বলে পদ্মা সেতুর ঋণ বাতিল করে দিল। চাকরির শেষ দিনে শেষ মুহূর্তে এ কাজটা করল!
সেই সময় আমরা বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা করার অনেক চেষ্টা করেছি উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংককে সন্তুষ্ট করার জন্য আমরা অনেক কিছু করেছি। তার কারণ বিশ্বব্যাংক আমাদের সবচেয়ে বড় দাতা সংস্থা।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী প্রথম দিনই বলেছিলেন যে আমাদের এই ঋণের দরকার নেই। তখন আমি বললাম যে, না এই অভিযোগটা যে ভুল, সেটা প্রমাণ করতে চাই। সেই ঘুষের জন্য ষড়যন্ত্রের অভিযোগের যুদ্ধ আমরা অনেক দিন চালিয়ে গেলাম।
বিশ্বব্যাংক একটি তালিকা পাঠিয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, আরও বহু লোকের নাম ছিল। সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক নেই এ রকমও অনেকের নাম ছিল।
জটিলতা পেরিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ এগিয়ে যাওয়ায় সন্তুষ্টিও প্রকাশ করেন মুহিত।
তিনি বলেন, খুশির খবর হলো সেই পদ্মা সেতু আমাদের নিজেদের অর্থায়নে বাস্তবায়ন হচ্ছে। আমার ধারণা, আগামী ২০১৯ সালের জুনের মধ্যে আপনারা পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে পদ্মা অতিক্রম করতে পারবেন।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ১২০ কোটি ডলার ঋণ দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিল বিশ্বব্যাংক। কিন্তু দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তোলার পর তাদের সঙ্গে টানাপড়েন দেখা দেয়; একপর্যায়ে বিশ্বব্যাংকের ঋণ না নিয়েই এই প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করে সরকার
২০১৯ সালের জুন মাস থেকে পদ্মা সেতুতে যান চলাচল শুরু হবে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। তবে সেই সঙ্গে তিনি একথাও বলেন, ‘এর আগে মার্চ মাস থেকেই যান চলাচল শুরু হতে পারে।’
সোমবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় রাজস্ব ভবনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আয়োজিত ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে সর্বোচ্চ ভ্যাট প্রদানকারী দশ প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাট সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
এনবিআর চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভূইয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান ও সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন বক্তব্য রাখেন।
অর্থমন্ত্রী বলেন,‘নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু বাস্তবায়ন হচ্ছে। আমার ধারণা আগামী মার্চ মাসেই পদ্মা সেতু দিয়ে যান চলাচল করতে পারবে, তবে মার্চ মাসের ব্যাপারে আমরা বেশি আশাবাদী হচ্ছি। ডেফিনেটলি জুন মাসে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে যান চলাচল শুরু হবে।আমাদের ওবায়দুল কাদের সাহেব চেয়েছিলেন ডিসেম্বরের মধ্যে।কিন্তু সেটা সম্ভব হবে না,কারণ এখনো সব স্প্যান বসেনি।’
পদ্মা সেতুতে ঋণ বাতিল করায় বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিকের সমালোচনা করে মুহিত বলেন,‘দূর্ণীতির অভিযোগ তুলে কোন অনুমোদন ছাড়াই পদ্মা সেতুতে ঋণ বাতিল করা হয়।আমরা সেই সময় বিশ্বব্যাংকের সাথে সমঝোতা করার অনেক চেষ্টা করেছি।কারণ বিশ্বব্যাংক আমাদের বড় উন্নয়ন সহযোগি। তবে দূর্ণীতির অভিযোগ তুলে অসম্মান করায় আমরা পরে তাদের ঋণ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই এবং নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন হচ্ছে।’
তিনি জানান, বৈদেশিক সাহায্য আগে আমরা জাতীয় আয়ের ৯-১০ শতাংশ পেলেও বর্তমানে ১ দশমিক ৩ থেকে ১ দশমিক ৪ শতাংশ পাই।এখনো যথেষ্ট বৈদেশিক সহায়তা পেয়ে থাকি।
মুহিত বলেন,‘এক সময় কথায় ছিল যে কর দিও না।একবার যদি করজালে পড় তাহলে সারাজীবন হয়রানি ভোগ করতে হবে।এখন এ ধারণা কারোর মধ্যে নেই।কর কর্মকর্তারা করদাতাদের সম্মান এবং সাহায্য করেন।’তবে এত কিছু করার পরও আমাদের রাজস্ব আহরণ অনেক কম বলে তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন,বাজেটের আকার বাড়লেও জাতীয় আয়ের অনুপাত হিসেবে আমরা যে কর দেই, সেটা এখনো সারাবিশ্বের ন্যুনতম পর্যায়ে আছে।আমরা ১০ থেকে ১১ শতাংশ কর দেই। খুব কম দেশে এই হার ১৪ থেকে ১৫ শতাংশের নিচে আছে।সেখানে আমাদের কিছু উদ্যোগ নিতে হবে এবং আমরা নিচ্ছি। আয়করে করদাতাদের সংখ্যা ব্যাপক হারে বেড়েছে।তিনবছর আগে ১৪ লাখ ছিল।এখন ৩৩ লাখ।এটা সুসংবাদ।
ভ্যাট সম্পর্কেসরকারের জ্যেষ্ঠ এই মন্ত্রী বলেন,ভ্যাটে আমরা কিছু সংস্কার প্রবর্তন করতে চেয়েছিলাম।ব্যবসায়ীদের কাছে তা গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী দুই বছরের জন্য স্থগিত করে দিয়েছেন।আমরা চেষ্টা করছি এই সময়ের মধ্যে কিভাবে ভ্যাটকে কাস্টমারবান্ধব করা যায়।এনবিআরের সেই চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
অর্থমন্ত্রী বলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কয়েক বছর ধরে যারা বেশি কর দেন, তাদেরকে স্বীকৃতি প্রদান করছে।এতে তারা সমাজে একটু সম্মান পান এবং তাদের দেখে অন্যরা উদ্বুদ্ধ হন বলে তিনি মন্তব্য করেন।
অনুষ্ঠানে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে ২০১৭ সালের ঢাকা সিটি করপোরেশনের সর্বোচ্চ আয়কর প্রদানকারী এবং ঢাকা জেলার কর বাহাদুর পরিবারের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হওয়ায় সম্মাননা সনদ এবং ক্রেস্ট তুলে দেন অর্থমন্ত্রী।
সর্বোচ্চ আয়কর প্রদানকারী এবং কর বাহাদুর পরিবারের স্বীকৃতি লাভ করায় এনবিআরকে ধন্যবাদ জানান সৈয়দ আবুল হোসেন।
তিনি বলেন,যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত সে জাতি তত বেশি উন্নত। যে জাতি যত বেশি কর প্রদান করেন,সে জাতি তত বেশি সভ্য,সেই জাতি তত বেশি দেশের সেবা করে থাকে।কর যারা দেয় তারা স্বচ্ছ থাকে।ঢাকা সিটি করপোরেশনের মধ্যে সর্বোচ্চ কর দেওয়ার মাধ্যমে আমি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার প্রমাণ রেখেছি।
প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান বলেন,কর বাহাদুরের পরিবর্তে যদি কর রতœ বা কর সেবক স্বীকৃতি দেয়া যায়, তাহলে খুবই ভালো হয়।
অনুষ্ঠানে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় অংশগ্রহণকারী দশ প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ ভ্যাট করায় ভ্যাট সম্মাননা সনদ ও পুরস্কার প্রদান করা হয়।এই দশ প্রতিষ্ঠান হলো-ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড,র্যাংগস ইলেকট্রনিক্স লিমিটেড, হাতিল কমপ্লেক্স লিমিটেড,সিপি বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড,আরএফএল প্লাস্টিক লিমিটেড, বাটারফ্লাই মার্কেটিং লিমিটেড,ডিউরেবল প্লাস্টিক লিমিটেড,আকতার ম্যাট্রাস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড,রংপুর মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও এগ্রিকালচারাল মার্কোটিং কোম্পানি লিমিটেড। অর্থমন্ত্রী এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের হাতে সম্মাননা সনদ ও ক্রেস্ট তুলে দেন।
No comments: