বিশ্বকাপে ৭ মহিলা সহকারী রেফারি!
খেলা চলছে। স্পার্টা প্রাগু বনাম জাব্রোজোভকা ব্রনোর। আচমকাই গোলমাল। ক্ষিপ্ত স্পার্টার দুই ফুটবলার। লুকাস ভাচা আর টমাস কৌবেক। কারণ? অফসাইড দিতে দেরি করেছেন সহকারী রেফারি। মেজাজ গরম হতেই পারে। তা বলে আঙুল তুলে বলতে হবে, ‘গো ব্যাক টু কিচেন’! ছবি তুলে ক্যাপশন দিতে হবে, ‘টু দ্য কুকার!’ রেফারি+কিচেন, সম্পর্কটা কীসের? আদৌ কি দুইয়ে সম্পর্ক আছে? আছে। যিনি সেদিন ম্যাচে সহকারী রেফারির দায়িত্ব পালন করছিলেন, তিনি মহিলা। পুরুষদের ফুটবলে মহিলা রেফারি উপস্থিতিটা একেবারেই বেমানান মনে করেছিলেন ওই দুই ফুটবলার। কিন্তু স্পার্টা তথা চেক প্রজাতন্ত্রের এই দুই আন্তর্জাতিক ফুটবলারকে এমন বেআক্কেলে মন্তব্যের খেসারত দিতে হয় বেশ ভালই। ক্ষমা চাওয়া, জরিমানার পর্ব তো ছিলই, সেই সঙ্গে তাঁদের মহিলা ফুটবলারদের সঙ্গে অনুশীলন করার নির্দেশ দেয় ক্লাব!
কিন্তু এমন শাস্তির পরও কি ভাবনার স্রোত বদলায়? বিশ্বের নানা প্রান্তেই ‘গো ব্যাক টু কিচেন’, শব্দগুলো ধ্বনি–প্রতিধ্বনি হয়ে ফেরে মহিলা ফুটবল রেফারিদের জীবনে! যুব বিশ্বকাপের আসরে এবার সাতজন মহিলা সহকারী রেফারি থাকবেন। এই প্রথম পুরুষদের বিশ্বকাপে মহিলা রেফারিদের দেখা যাবে। এঁরা হলেন রি হ্যাং ওক, গ্ল্যাডিস লেংউই, ক্যাটরিনা মঞ্জুল, এস্থার স্টাউবলি, ক্যারল অ্যানি শেনার্ড, অ্যানা–মেরি কেইঘলে, ক্লদিয়া আম্পায়ারেজ। না, এই তালিকায় কোনও ভারতীয় নেই। কিন্তু ঐতিহাসিক এই সিদ্ধান্তের সাক্ষী থাকবে তো দেশ। আর সেটাই তৃপ্তি দিচ্ছে কলকাতা ময়দানের দুই রেফারি মণিকা জানা আর কণিকা বর্মনকে। প্রথমজন ফিফা রেফারির স্বীকৃতি পেয়েছেন ইতিমধ্যেই। মণিকা জানালেন, ‘বিশ্বকাপে মহিলা রেফারি! দারুণ খবর। আসলে ফিটনেস আর পারফরমেন্সের ওপর নির্ভর করে অ্যাসাইনমেন্টগুলো। এখন মেয়েরা আর পিছিয়ে নেই। ছেলেরা যে টাইমিংয়ে ফিটনেস টেস্ট দেয়, মেয়েরাও সেটা দিচ্ছে। তাই দায়িত্ব দিতে আপত্তি হওয়ার কিছু নেই। এ কারণেই মেয়ে রেফারির সংখ্যা বাড়ছে।’ কাজ করার সময় তাঁকে কখনও শুনতে হয়েছে টিটকিরি? মণিকা জানালেন, ‘কলকাতা ময়দানে এমন ঘটনা আকছাড় হয়। খেলায় একদল হারবেই। আর যে দল হারছে, তাদের কাছ থেকে রেফারিরা ভাল প্রতিক্রিয়া পায় না। আর সেটা পুরুষ বা মহিলা রেফারি যেই হোক না কেন। তবে মেয়ে রেফারি হলে শুনতে হয়, ‘ধ্যত, মেয়েরা আবার রেফারি হয় নাকি? যা বাড়ি যা। বাড়ি গিয়ে রান্না কর।’ এমন কথা আমিও শুনেছি ময়দানে দাঁড়িয়েই।’ ম্যাচ শুরুর আগে একজন মহিলা রেফারির মাথায় কি ঘুরতে থাকে? মণিকার কথায়, ‘আমরা তখন নিজেদের রেফারি টিম নিয়ে ভাবি। নিজেদের কাজটা ঠিক মতো করাই লক্ষ্য থাকে।’ আর মাঠে যখন প্লেয়াররা উত্তেজিত হয়ে ওঠে, কী করেন? মণিকা জানালেন, ‘প্লেয়াররা উত্তেজিত হতেই পারে। আমার কাজ নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকা। নিয়ম যেটা সেটাই করা। কারও চাপে মাথা নোয়ানো নয়।’ বিদ্রুপ যখন উড়ে আসে, তখন কণিকা বর্মন সেই ঝড় সামলান কীভাবে? মহিলা এই রেফারির কথায়, ‘বিদ্রুপ ব্যাপারটা নতুন নয়। কাজ করলেই লোক খুঁত খুঁজবে। কটাক্ষ করবে। এটা জীবনের অঙ্গ। ময়দানে এই ধরনের বিদ্রুপ শুনতে হয়। আমি কাজে বিশ্বাসী। কাজ করে লোকের মুখ বন্ধ করিয়ে দিতে ভালবাসি। মুখে কিছু বলার কি আছে?’ দু’বছর মাঝে ময়দান থেকে দূরে থাকতে হয়েছিল তাঁকে। শারীরিক ও ব্যক্তিগত সমস্যায়। কিন্তু আবার এই বছর ফিরেছেন ময়দানে। বিশ্বকাপে সাত মহিলা সহকারী রেফারি দায়িত্ব পালন করবেন, এটা মহিলা রেফারিদের ক্ষেত্রে কতটা বদল আনবে? কণিকা বললেন, ‘ভারত বিশ্বকাপের আসর বসেছে। আর সেই বিশ্বকাপে সাত মহিলা সহকারী রেফারি! অত্যন্ত গর্বের ব্যাপার। ভারতের মহিলা রেফারি এই তালিকায় না থাকলেও, ভবিষ্যতে থাকবে এই বিশ্বাস আছে।’ যদি নিজে এই সুযোগ পেতেন? মণিকার কথায়, ‘প্রত্যেক রেফারিই স্বপ্ন দেখে আন্তর্জাতিক মঞ্চে ম্যাচ পরিচালনার। আমিও দেখি। সুযোগটা পেলে ভাল তো লাগতই। তার চেয়েও বেশি হত গর্ব। এখনও হয়ত সুযোগ আসেনি। কে বলতে পারে ভবিষ্যতে আসবে না?’ সত্যিই তো। সময় কখন কোন মোড় নেয় কে বলতে পারে!