গ্রিন টির চমকপ্রদ স্বাস্থ্য উপকারিতা
আজকাল চা পান করাটা আমাদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় হয়ে দাড়িয়েছে। সে রং চা, দুধ চা বা সবুজ চা হোক না কেনই। জীবনের কর্ম ব্যস্ততায় এক কাপ চা যেন প্রশান্তি এনে দেয়। চা পান কমবেশি আমরা সবাই করে থাকি। কিন্তু চা এর উপকারিতা সম্পর্কে কমই জানি আমরা। আজ সবুজ চা বা গ্রিন টি এর কিছু উপকারিতা সম্পর্কে বলব। স্বাদের জন্যে নয়। গ্রিন টি স্বাস্থ্যের জন্যেও ভালো এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। তাই, সবুজ চা সম্পর্কে আপনাদেরকে ধারণা দিতেই আজ এই আয়োজন। চলুন তবে জেনে নিন গ্রিন টি বা সবুজ চা-এর চমকপ্রদ উপকারিতাগুলো সম্পর্কে।
গ্রিন টি বলতে আমরা অনেকে এর সবুজ রংকে বুঝি। কিন্তু আসলেই তা নয়। সাধারণ চায়ের ক্ষেত্রে যেমন অনেক প্রক্রিয়াজাত করে একেক দানাদার আকার দেওয়া হয়, তবে গ্রিন টির ক্ষেত্রে বেশিরভাগই তা করা হয় না। এটি প্রক্রিয়াজাতকরণের ধরন সাধারণ চায়ের চেয়ে আলাদা। অনেক ক্ষেত্রে ছোট ছোট আস্ত পাতাই থেকে যায়।
জাপান এবং চীনের মতো পৃথিবীর অন্য দেশেও স্বাস্থ্যগত সুবিধার কথা বিবেচনা করে ধীরে ধীরে গ্রিন টি’র জনপ্রিয়তা বাড়ছে। অন্য চায়ের চেয়ে গ্রিন টি দ্রুত সংরক্ষণ করা যায়। গ্রিন টি’র প্রক্রিয়াজাতকরণের এই পার্থক্যের জন্যই এটি সর্বোচ্চ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ধরে রাখতে পারে। গ্রিন টি’তে পলিফেনল নামে এক ধরনের উপাদান আছে যা ওজন কমাতে সাহায্য করে এবং স্বাস্থ্যগতভাবে উপকারী। তবে, এ ধরনের চা’তে যে ক্যাফেইন আছে তা অধিকাংশ গ্রিন টি ব্র্যান্ডে উল্লেখ নেই। এটা অবশ্যই খেয়াল রাখার বিষয়। কেউ যদি অসতর্কতাবশত রাতে গ্রিন টি পান করে ফেলে তবে তার শান্তির ও আরামদায়ক ঘুম উড়ে যেতে পারে নিমেষেই।
কেন গ্রিন টি উপকারী?
গ্রিন টি’র উপকারিতা অনেক। এটা ওজন কমাতে সাহায্য করে, ক্যান্সার প্রতিরোধ করে, গলার সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে, মস্তিষ্ককে উদ্দীপ্ত করে। এমনকি কেউ যদি ধূমপান ছাড়তে চান, তবে তা ছাড়তেও গ্রিন টি সাহায্য করবে। সব কিছু ছাপিয়ে গ্রিন টি বার্ধক্য এবং কপালের বলিরেখা থেকে ত্বককে রক্ষা করবে।
কীভাবে গ্রিন টি তৈরি করবেন?
পানির সঠিক তাপমাত্রা এককাপ পারফেক্ট গ্রিন টি তৈরি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পানি যদি বেশি গরম হয় তবে এর স্বাদ তেতো হয়ে যাবে, সাথে এটি তার সুবাস হারাবে। অর্থা চা তার স্বাদ ও গন্ধ হারাবে। কাজেই চা তৈরির সবচেয়ে উপযুক্ত তাপমাত্রা হচ্ছে ৭৫-৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যদি টি ব্যাগ ব্যবহার করেন তবে এটা ২-৩ মিনিট ফুটিয়ে নেবেন। চা পাতার জন্য তা আরেকটু বেশি সময় নেবে, ৩-৪ মিনিট।
চা নির্বাচনে
অনেকেই শুধু ভালো চা নির্বাচনের অভাবে গ্রিন টির স্বাদ সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণা পোষণ করে থাকেন। গ্রিন টি’প্রেমীদের জন্য বহুল প্রচলিত কিছু ভারতীয় ব্র্যান্ডের গ্রিন টি’র পরিচয় এবং স্বাদ সম্পর্কে কিছু তথ্য তুলে ধরেছে এনডিটিভি। আশা করা যাচ্ছে আশপাশের দোকানগুলোতেই এ ব্র্যান্ডের চা পাওয়া যাবে।
ব্র্যান্ড
টেটলি, অর্গানিক ইন্ডিয়ান, ইকো ভ্যালি, গায়া, তাজমহল এবং মিত্তাল এই ব্র্যান্ডের গ্রিন টি আপনি সহজেই আপনার বাড়ির পাশের মেগাশপেই পেয়ে যেতে পারেন। ব্র্যান্ডের ভিন্নতা অনুযায়ী এর গন্ধেরও তারতম্য হতে পারে।
কতগুলো সাধারণ প্রশ্নের উত্তরেই আপনি চায়ের ধরণ বুঝে যেতে পারেন। যেমন-
গন্ধটা কি মৌলিক এবং মৃদু নাকি মাত্রারিক্ত ছিল?
চা কি কষটে নাকি তিক্ত স্বাদের?
চায়ের গন্ধটা কি আমাদের আরও কিছুক্ষণ কাপের সঙ্গে থাকতে উদ্ধুদ্ধ করে নাকি আমাদের মুখ ফিরে আসে!
পেয় না উপভোগ্য!
চা কি আপনাকে যথেষ্ট আমন্ত্রণ জানিয়েছিলো?
যদি এ প্রশ্নের উত্তর ইতিবাচক হয় তবে আপনি বুঝবেন আপনি আপনার পছন্দের জিনিসটা ঠিক ঠিক বেছে নিতে পেরেছেন। আর যদি নেতিবাচক হয় তবে বুঝবেন ঠিক এই ফ্লেভারটি আপনার উপযোগী নয়।
গ্রিন টি এর স্বাস্থ্য উপকারিতা
ওজন কমাতে
সবুজ চা বিপাক বৃদ্ধি করে। গ্রীন টি পলিফেনল শরীরের ফ্যাট অক্সিডেশন প্রক্রিয়াকে আরও কার্যকর করে খাবার থেকে ক্যালরি তৈরি প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে। ফলে দেহে অতিরিক্ত চর্বি জমতে পারে না। একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, এটি এক দিনে ৭০ কালরি পর্যন্ত ফ্যাট বার্ন করে। তার মানে নিয়মিত গ্রীন টি পানের মাধ্যমে বছরে ৭ পাওন্ড পর্যন্ত ওজন কমানো সম্ভব।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে
সবুজ চা রক্তের গ্লুকোজ এর মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। খাওয়ার পরে রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়ে, যা প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে গ্রিণ টি। তাই গ্রীন টি ডায়াবেটিস নিয়ন্তনে অনেক সহায়ক।
ফারটিলাইজার হিসেবে
গ্রিন টি অনেক উপকারি। এই সবুজ চায়ের পাতা পানিতে কয়েকদিন ভিজিয়ে রেখে তারপর ছেঁকে গাছের গোড়ায় সেই পানি দিলে তা ফারটিলাইজার হিসেবে কাজ করে।
হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, গ্রিন টি শরীরের প্রতিটি শিরায় কাজ করে। ফলে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক থাকে। তাই কোনো কারণে রক্ত চাপে পরিবর্তন হলেও কোন ধরনের ক্ষতি করে না। তাছাড়া গ্রীন টি রক্ত জমাট বাধতে দেয় না। ফলে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভবনা অনেক কমে যায়।
খাদ্যনালীর ক্যান্সার রোধে
গ্রিন টি খাদ্যনালীর ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। এছাড়াও ভালো কোষগুলোর কোনো ক্ষতি না করে সার্বিকভাবে ক্যান্সারের কোষ নির্মূল করে। গ্রীন টিতে থাকা অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ভিটামিন সি এর চাইতে ১০০ গুন ও ভিটামিন ই এর চাইতে ২৪ গুন ভালো। গ্রীন টি বিশেষ ভাবে ত্বকের ও খাদ্যনালীর ক্যান্সারের চিকিৎসা ও প্রতিরোধে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও এটি ত্বকে বলিরেখা পড়াকে রোধ করে।
কোলেস্টেরল বাড়াতে
গ্রিন টি শরীরের ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাস করতে সাহায্য করে। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় উপকারী কোলেস্টেরলের পরিমাণও বাড়াতে সাহায্য করে।
রোগ প্রতিরোধ করতে
গ্রিন টি দেহের জন্য অনেক উপকারি। এটি দেহের সকল রোগ প্রতিরোধে সহায়ক। সবুজ চা দেহকোষকে ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করে, ফলে বাড়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা।
দাঁত ভালো রাখতে
গ্রিন টি’র ‘ক্যাটেকাইন’ নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট মুখের ভিতরের বিভিন্ন ব্যকটেরিয়া ও ভাইরাস ধ্বংস করে। যা গলার ইনফেকশনসহ দাঁতের বিভিন্ন সমস্যা কমিয়ে আনে। এছাড়াও এটি ওরাল ব্যাক্টেরিয়া ধ্বংস করে ডেন্টাল ক্যাভিটিস প্রতিরোধ করে। গ্রীন টি মাউথওয়াশ হিসেবে খুব ভালো কাজ করে। এতে আছে অ্যান্টিব্যাক্টেরিয়াল প্রপার্টিস এবং কোনো এলকোহল নেই। যা নিয়মিত মাউথওয়াশে থাকতে পারে। নিয়মিত গ্রীন টি পান মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
রক্ত চাপ কমাতে
গ্রীন টি রক্তচাপের ঝুকি কম করতে অনেক সহায়ক। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নিয়মিত গ্রিন টি পান করলে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমে যাবে। সুতরাং উচ্চ রক্ত চাপের ক্ষেত্রে গ্রিন টি অনেক উপকারি।
স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিতে
গ্রীন টি স্মৃতি শক্তির উন্নতি ঘটাতে সহায়ক। গ্রীন টি শরীরের বিভিন্ন অংশকে ভেতর থেকে সতেজ করে তোলে এবং সেই সাথে স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিতেও সাহায্য করে। যদিও স্মৃতি বিনষ্টকারী রোগ আলঝেইমার্স এর কোন চিকিৎসা নেই, কিন্তু এটি আলঝেইমার্স এর জন্য দায়ী এসিটাইলকোলিন এর মাত্রা নিয়ন্ত্রন করে অবস্থার কিছুটা উন্নয়ন ঘটাতে পারে।
ডিপ্রেশন দূর করতে
প্রকৃতিকভাবেই ‘থিয়ানিন’ নামের অ্যামাইনো এসিড চা পাতায় পাওয়া যায়। এই উপাদান দুশ্চিন্তা ও হতাশা কমাতে সাহায্য করে। তাই নিয়মিত গ্রিন টি পান করলে টেনশন থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।
অ্যান্টি-ভাইরাল এবং ব্যাকটেরিয়া বিরোধী
সবুজ চায়ের ফলে ইনফ্লুয়েঞ্জা থেকে ক্যান্সার পর্যন্ত সব রকমের রোগের প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। এটা ক্যানসারের ধ্বংসাত্মক সেলকে ধ্বংস করে। চায়ের ক্যাটেকাইন উপাদান অ্যান্টি ভাইরাল ও অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল হিসেবে বেশ উপকারি। গবেষণায় দেখা গেছে অনেক রোগ বিস্তারেও বাধা দেয় গ্রিন টি।
ত্বকের যত্নে
গ্রীন টি তে রয়েছে এক ধরনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা বার্ধক্যের গতিকে ধীর করে এবং আয়ু বাড়াযতে সাহায্য করে। চোখের ফোলা ভাব এবং চোখের নীচের ডার্ক সার্কেল কমাতে ব্যবহার করা গ্রীন টি এর দুটি ব্যাগ ২ ঘন্টা ফ্রীজ এ রেখে, ঠান্ডা করে চোখ বন্ধ করে এর উপর ১০ মিনিট রাখতে হবে। তাছাড়া এটি ত্বকের রোদে পোড়াভাব কমাতে ও ব্ল্যাক হেডস দূর করতে সাহায্য করে। গ্রীন টি খুব ভালো টোনার হিসেবে কাজ করে। মেডিকেল গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, গ্রীন টি ব্রণের সমস্যা ট্রিটমেন্টের জন্য খুবই উপকারি। এটি ত্বকে কোন রকম ইরিটেশন বা ড্রাইনেস তৈরী করা ছাড়াই ব্রণ নির্মূল করে থাকে।
গ্রীন টি কে মজাদার করে তোলার কিছু উপায়
অনেকে গ্রীন টি খেতে পারেন না, তার অন্যতম কারণ এর স্বাদ। তাই যারা একেবারেই গ্রীন টি খেতে পারেন না তাঁদের জন্য রয়েছে কিছু টিপস যা স্বাদের সাথে স্বাস্থ্য ভালো রাখতেও সাহায্য করবে।
যারা ফ্রুট স্মুদি কিংবা জুস খেতে ভালোবাসেন তারা এর সাথে দুই টেবিল চামচ গ্রীন টি পাউডার মিশিয়ে নিতে পারেন। প্রতিদিন সকালের নাস্তায় এটি খেলে উপকার পাওয়া যাবে।
বাসায় গ্রীল কিংবা বারবিকিউ করা হলে মাংসের জন্য তৈরি মশলার সাথে গ্রীন টি পাউডার মিশিয়ে দিলে। এটি মাংসের স্বাদে ভিন্নতা তো আনবেই স্বাস্থ্য ভালো রাখতেও দারুণ ভূমিকা রাখবে।
পুডিং খেতে অনেকেই পছন্দ করেন। পুডিং বানানোর সময় কিংবা কেক এর বেকিং এর সময় অল্প একটু গ্রীন টি পাউডার যোগ করে ভিন্ন ধরনের এক স্বাদ উপভোগ করতে পারবেন।
সবশেষে মজার এক রেসিপি দিয়ে শেষ করি। আপনি যদি আইসক্রীম বানাতে এবং খেতে ভালোবাসেন তবে বিভিন্ন ফ্লেভার এর সাথে গ্রীন টি ফ্লেভারের আইসক্রীম বানিয়ে দেখবেন। স্বাদ, স্বাস্থ্য কোন ব্যাপারেই আর সমস্যা করবে না।
গ্রীন টি এর অপকারিতা
চা বা গ্রিন টি জাতীয় পানীয়ের অনেক উপকারিতা বিদ্যমান থাকলেও কিছু ক্ষেত্রে একটু মেনে চলতে হয়। যেমন চা হোক বা গ্রিন টি কোনটাই অতিরিক্ত পান করা ভাল না। আর খাবার খাওয়ার আগে বা পরে গ্রিন টি খাওয়া ঠিক নয়। এতে হজমের সমস্যা দেখা দেয়। আর ঘুমাতে যাওয়ার আগে তো গ্রিন টি একদমই খাওয়া ভাল না। এতে করে আরামের ঘুম হারাম হয়ে যাবে। সুতরাং দেখবেন চা বা গ্রিন টিতে যেমন স্বাস্থ্য উপকারিতা আছে, কিছু নিয়মও মেনে খাওয়া উচিত। তাহলে দেহের ক্ষেত্রে উপকার পাবেন।