দিল্লির বাঙালি পাড়ার পুজোয় বিরিয়ানি চিকেন কাবাব নিষিদ্ধ
ভারতের রাজধানী দিল্লিতে দুর্গাপুজোর সময় আমিষ খাওয়া নিয়ে আপত্তি ওঠার জেরে পূর্ব দিল্লির একটি পুরনো বারোয়ারি পুজোর প্রাঙ্গণে বিরিয়ানি-চিকেন রোল-কাবাব বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এই সব খাওয়াদাওয়াকে অনেক বাঙালিই দুর্গাপুজোর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে মনে করেন - কিন্তু এই সময়ই আবার উত্তর ও পশ্চিম ভারতে হিন্দুরা অনেকে 'নবরাত্রি' উদযাপন করেন, যাতে আমিষ খাওয়াদাওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
আমিষ-নিরামিষকে ঘিরে এই সংঘাতের জেরে ভারতে অনেক বাঙালিকেই দুর্গাপুজোর সময় তাদের প্রিয় আমিষ পদগুলো বর্জন করতে হতে পারে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
পূর্ব দিল্লির পূর্বাচল সমিতিতে দুর্গাপুজো হচ্ছে গত সাতাশ বছর ধরে - আর সেই পুজোর প্রতি বছর চত্বরে কাবাব-বিরিয়ানি খেতেও ভিড় জমান বহু লোকজন।
পুজো কমিটির সচিব অশোক সামন্ত অবশ্য সাফাই দিচ্ছেন, পুজোতে চিরকালই তারা নিরামিষপন্থী।
"আমরা চিরকাল পুজোর ভোগে সবকটা দিনেই সম্পূর্ণ নিরামিষ খাইয়ে এসেছি - এই যেমন আজও সবাইকে খিচুড়ি খাওয়ালাম। আর পশুবলিও তো সরকারি নিষেধাজ্ঞার জন্য কবে থেকেই বন্ধ। কিন্তু আমাদের পুজোর বাইরের স্টলে কী বিক্রি হবে, সেটা তো তাদের ব্যাপার, তাদের ওপর তো আমাদের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই!", বলছিলেন তিনি।
তবে ফুড হিস্টোরিয়ান অধ্যাপক পুষ্পেশ পন্থ বিবিসিকে বলছিলেন, দুর্গাপুজোয় আমিষের চল ছিল আবহমান কাল থেকেই।
তার বক্তব্য, "যবে থেকে আর্যসমাজী ঘরানার পাঞ্জাবি শরণার্থীরা বিজেপিতে প্রভাব বিস্তার করেছে - তখন থেকেই এই নিরামিষ খাবার চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। হিন্দু কিন্তু কখনওই নিরামিষাশীদের ধর্ম ছিল না - এটা জৈনধর্ম নয় - ভারতে ক্ষত্রিয়-রাজপুত-বৈশ্য-শূদ্ররা এবং অনেক ব্রাহ্মণও চিরকাল মাংস খেতেন।"
কিন্তু পুজোতে হিন্দু বাঙালির মাছ-মাংসের এই সব এলাহি আয়োজন বন্ধ করার জন্য উত্তর ভারতে গত কয়েক বছর ধরেই চাপ বাড়ছে - বলছিলেন দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কের পুরনো বাসিন্দা হিমাদ্রি দত্ত।
তার কথায়, "এই জিনিসটা একেবারে নতুন। আমরা এই সেদিনও বলাবলি করছিলাম, যেভাবে ভারতে মাংসের বিরুদ্ধে প্রচার চলছে তাতে এই সব লোকজন বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল বলে। উত্তর ভারতে আসলে বাঙালিদের খাওয়াদাওয়া নিয়ে চাপে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে।"
এতদিন এই সব চাপ উপেক্ষা করেই অবশ্য দিল্লিতে বাঙালিরা পুজো প্যান্ডেলে গিয়ে চুটিয়ে আমিষ খেয়েছেন, বলছিলেন তিনি।
"চল্লিশ বছর ধরে দেখছি, আমাদের চিত্তরঞ্জন পার্কের সব পুজোতে কাবাব-বিরিয়ানির দোকানের সামনে লম্বা লাইন। ফিশ কাটলেট, ফিশ ফ্রাই তো খুব জনপ্রিয়। আর শহরের তিন-চারটে পুরনো পুজোর একটা, কাশ্মীরি গেটের পুজোয় তো মানুষ দূরদূরান্ত থেকেও শুধু বিরিয়ানি খেতে যায়। প্রতিমা দেখার চেয়েও কাশ্মীরি গেটের পুজোয় মাটন বিরিয়ানি খাওয়াটা বেশি জরুরি", হাসতে হাসতে বলছিলেন হিমাদ্রি দত্ত।
"আসলে এই খাওয়া-দাওয়া, গানবাজনা, সাহিত্য-সংস্কৃতি বাঙালির ধর্মপালনের সঙ্গেও চিরকালই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত", যোগ করেন তিনি।
আরও পড়ুন: একটি ভ্রমণ কাহিনী ও রোহিঙ্গা আদি নিবাস বিতর্ক
দিল্লির পুজোয় এবার বিরিয়ানি, কাবাব নিষিদ্ধ
কিন্তু সেই খানাপিনার সংস্কৃতির ওপর এখন নবরাত্রির দাবি চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে - যার মূল কথা হল মাছ-মাংস বর্জন।
বিবিসি হিন্দির নীতিন শ্রীবাস্তবের কথায়, "এই সময়টায় আমিষের ওপর কড়াকড়ি ক্রমশ বাড়ছে। নবরাত্রিতে দোকানে প্রকাশ্যে আমিষ বিক্রি করা হচ্ছে না, উত্তর আর পশ্চিম ভারতে খবরের কাগজে পাতা-জোড়া নিরামিষ পদের বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে - রেস্তোরাঁগুলো পরিষ্কার বলছে এই সময় আমিষ পদ সার্ভ করা হবে না। এ অদ্ভুত জিনিস আগে কখনও দেখিনি।"
আর সেই নবরাত্রি আর দুর্গাপুজো যেহেতু একই সময়ে - ফলে পুজো উদযাপন করা দিল্লির বাঙালিকে অগত্যা এখন নিরামিষেই পেটপুজো সারার কথা ভাবতে হচ্ছে।