গুণে ভরা ডেউয়া
আমাদের শরীর স্বাস্থ্য ভালো রাখতে পরিমিত পরিমাণে স্বাভাবিক খাবারের পাশাপাশি প্রতিদিন পরিমিত পরিমাণে ফলও খাওয়া দরকার।
ফল বললেই অনেকে বিদেশি দামি ফল যেমন- আপেল, কমলা, আঙুর ইত্যাদি বুঝে। এসব ফলে বেশি পরিমাণে ভিটামিন থাকে বলে মনে করে অনেকে। অথচ আমাদের দেশে ভিটামিনসমৃদ্ধ ফলের অভাব নেই।
এসবের দাম আপেল, কমলা, আঙুর, বেদানা ইত্যাদি ফলের চেয়ে কম।
এর মধ্যে কিছু কিছু ফল আছে যেগুলোর খুব একটা পরিচিতি না থাকলেও তাদের রয়েছে অসাধারণ ভেষজ পুষ্টিগুণ। শীতকালের চেয়ে গ্রীষ্মকালেই এসব ফল বেশি পাওয়া যায়। এ ফলের মধ্যে একটি হল ডেওয়া, ডেউফল বা ডেউয়া হল তাদের মধ্যে অন্যতম। প্রচলিত নাম ডেওয়া বৈজ্ঞানিক নাম Artrocurpus lakoocha (Moraceae) Monkey jack গ্রামের হাট-বাজারে বর্ষাকালে ডেউয়া ফল দেখতে পাওয়া যায়।
গ্রামাঞ্চলে এটি অত্যন্ত পরিচিত একটি ফল হলেও শহরাঞ্চলে এটি একটি অপ্রচলিত ফল। দিন দিন দেশে অপ্রচলিত ফলের চাহিদা বেড়েই চলেছে। কারণ মানুষ বুঝতে পেরেছে এসব ফলের পুষ্টি ও ভেষজ গুণের কথা। বিদেশেও এসব ফল রফতানি হচ্ছে।
কাঁঠাল ও ডেউয়া একই গুণের অন্তর্ভুক্ত। মার্চ মাসে ডেউয়ার প্রায় পাতাহীন ডালপালায় ফুল আসে আর আগস্ট মাসে ফল পাকে। অপুষ্প ফুলদণ্ড। কারণ ডেউয়ার ফুল দেখতে সাধারণ ফুলের মতো নয়, অনেকটা কাঁঠালের মোচার মতো। আসলে এই ছোট ছোট মোচা অনেক ফুলের সমষ্টি।
এ ফলের বাইরের অংশটি থাকে অসমান। কাঁচা অবস্থায় সবুজ এবং পাকলে হলুদ হয়।
কাঁঠালের মতো ছোট ছোট কোষ থাকে। পাকা ফলের কোষের রং হয় লালচে হলুদ বা লালচে কালো। এই ফল পুরোপুরি গোলাকার হয় না। ফলটির গা উঁচু-নিচু হয়। কাঁচা টক টক স্বাদ। কিন্তু পাকলে সেটা তখন অন্য স্বাদ।
সেটা টকও নয়, আবার মিষ্টিও নয়। ডেউয়ার আদি জন্মস্থান বঙ্গবর্ম এলাকা। বর্মায় এ ফলের নাম মাইয়াক লুয়াং। অঞ্চলভেদে এই ফল মানুষের কাছে বিভিন্ন নামে পরিচিত। ঢেউয়া, ডেলোমাদার, ডেউফল, ঢেউফল ইত্যাদিও বলা হয়ে থাকে।
এই ফলটি অনেক উপকারী। যা অনেকেরই অজানা।
ভিটামিন সি ও ক্যালসিয়ামের আঁধার বলা হয় ডেউয়া ফলকে। এগুলো ছাড়াও ডেউয়া ফলে রয়েছে অন্যান্য পুষ্টি উপাদান। ডেউয়া ফলের খাদ্যযোগ্য প্রতি ১০০ গ্রাম অংশে রয়েছে-
খনিজ- ০.৮ গ্রাম, খাদ্যশক্তি- ৬৬ কিলোক্যালরি, আমিষ- ০.৭ গ্রাম, শর্করা- ১৩.৩ গ্রাম, ক্যালসিয়াম- ৫০ মিলিগ্রাম, লৌহ- ০.৫ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি১- ০.০২ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি২- ০.১৫ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি- ১৩৫ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম- ৩৪৮.৩৩ মিলিগ্রাম।
দেখতে অদ্ভুত ও খেতে টক – মিষ্টি ডেউয়া ফল মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। পাশাপাশি এর রয়েছে বেশ কিছু ভেষজ গুণও। নিচে কয়েকটি উল্লেখ করা হল-
* কোনো কারণে বমি বমি ভাব অনুভব হলে তা খেলে দ্রুত সেরে যায়। অত্যাধিক তৃষ্ণা নিবারণে কাজ করে টক জাতীয় ফল ডেউয়া।
* ত্বকের খসখসে ভাব দূর হয়ে মসৃণ ভাব ফিরে আসে। অর্থাৎ শরীরের শুষ্কভাব দূর হয়।
* এ ফল খেলে স্মৃতিশক্তিও বাড়ে। * মরিচ, লবণ, চিনি দিয়ে ডেউয়ার ভর্তা খেলে সানস্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়।
* যারা মেদভুঁড়ি কমাতে চান তারা ডেউয়া ফলের রস এক থেকে দেড় চামচ ঠাণ্ডা পানিতে মিশিয়ে রোজ একবার করে এক মাস খেলে উপকার পাবেন। তবে ১২ মাস তো এ ফল পাওয়া যায় না, এ জন্য যখন পাওয়া যাবে তখন কেটে রোদে শুকিয়ে রাখতে পারেন।
* পেটে বায়ু জমলে পাকা ডেউয়ার রস দেড় চামচ আধা কাপ পানিতে মিশিয়ে অল্প চিনি দিয়ে প্রতিদিন একবার এক সপ্তাহ খেলে উপকার হবে।
* যাদের অসুস্থতার কারণে মুখে রুচি নেই তারা দু-তিন চামচ ডেউয়ার রস ও সঙ্গে একটু লবণ ও গোলমরিচের গুঁড়া মিশিয়ে দুপুরবেলা ভাত খাওয়ার আগে খেতে হবে। এক সপ্তাহ খেলেই মুখে রুচি আসবে।
* অনেকের বিভিন্ন প্রকার খাবার খেলেও পেট পরিষ্কার হয় না। অস্বস্তিতে ভোগেন। তারা কাঁচা ডেউয়া কেটে ৮-১০ গ্রামের মতো বেটে গরম পানিতে মিশিয়ে কিছুক্ষণ রেখে ওই পানি খেলে পেট পরিষ্কার হয়ে যাবে। যা সকালে বাসি পেটে খেতে হবে।
* যকৃতের নানা অসুখ নিরাময়ে সাহায্য করে ডেউয়া। * কোষ্ঠকাঠিন্য ও গ্যাসের কারণে পেটব্যথা কমাতে সহায়তা করে ফলটি।
* গাছের ছালের গুঁড়া ত্বকের রুক্ষতা দূর করে এবং ব্রণের দূষিত পুঁজ বের করে দেয়। *
ডেউয়ার ভিটামিন সি ত্বক, চুল, নখ, দাঁত ও মাঢ়ির নানা রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। * এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম যা দাঁত ও হাড়ের ক্ষয়রোগ প্রতিরোধ করে। * ডেউয়াতে বিদ্যমান পটাশিয়াম রক্ত চলাচলে সহায়তা করে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়।
ডেউয়ার ফল ও ছালে আরও কয়েকটা গুণ। লিভারজনিত রোগে বিশেষ উপকার পাওয়া যায়। ছালের গুঁড়া গায়ের চামড়ার রুক্ষতা দূর করে।
ইউনানী চিকিৎসায় ফলের বীজ শিশুদের বিরেচনার জন্য ব্যবহার করে থাকে। ফল ও গাছের রসকষে অনেক রাসায়নিক দ্রব্য আছে। যেমন : ট্যানিন, স্টেরোকিটোন ও আরটোস্?টিনোন।
তবে সাবধান কাঁচা ফল খেতে নেই। উল্লেখ আছে কাঁচা ফল ত্রিদোষজনক, পেটের বায়ু স্তম্ভিত হয়ে যায় এবং শুক্রনাশক।