ভ্রমণনিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পর ট্রাম্প ক্রমাগত হেরেই যাচ্ছেন। মার্কিন আপিল আদালতের নবম সার্কিট হাওয়াই জেলা আদালতের রায় প্রায় পুরোটাই বহাল রেখেছেন। এর মধ্য দিয়ে আপিল আদালত ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফা ভ্রমণনিষেধাজ্ঞায় আঘাত হানলেন। আমেরিকান সিভিল লিবার্টিস ইউনিয়নের মুখপাত্র আমাকে বলেছেন, ‘দুটি আপিল আদালত মুসলমানদের ভ্রমণনিষেধাজ্ঞার বিষয়টি আমলে নিয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে তাকে বেআইনি হিসেবে বিধান দিয়েছেন। যদিও আপিল আদালতের চতুর্থ ও নবম সার্কিট ভিন্ন যুক্তি দিয়েছেন, উভয় আদালতই এ ব্যাপারে পরিষ্কার, এ ধরনের নিষেধাজ্ঞার যৌক্তিকতা নেই।’
নবম সার্কিট তো আরও একবার ট্রাম্পের এই দাবি নাকচ করেছেন যে নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠীর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ক্ষেত্রে তাঁর হাতে প্রায় অসীম ক্ষমতা রয়েছে। ব্যাপারটা হচ্ছে, অভিবাসনের ব্যাপারে প্রেসিডেন্টের একক ক্ষমতা নেই। তাঁর কর্তৃত্ব নানা রকম আইনি ও সাংবিধানিক বিধিনিষেধের নিগড়ে বাঁধা। আমাদের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, নির্বাহী আদেশ জারি করতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট কংগ্রেস কর্তৃক প্রদত্ত ক্ষমতার বেশি ব্যবহার করেছেন। ছয়টি দেশের ১৮ কোটির বেশি মানুষ ও শরণার্থীর আগমন নিষিদ্ধ এবং ২০১৭ সালে ১ লাখ ১০ হাজার শরণার্থীর জায়গায় ৫০ হাজার নেওয়ার ঘোষণা—এসব করতে গিয়ে ট্রাম্প নিজের ক্ষমতা ব্যবহারের প্রয়োজনীয় পূর্বশর্ত পূরণ করেননি। এই মানুষেরা যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকলে তা ‘দেশটির স্বার্থের জন্য হানিকর’ হবে, এটা বলার আগে প্রেসিডেন্টকে তথ্যপ্রমাণ জড়ো করতে হবে।
এ ছাড়া ট্রাম্পের এই আদেশ ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্টের পরিপন্থী। কারণ এতে বলা হয়েছে, জাতীয়তাভিত্তিক বিভাজন করা যাবে না, আর শরণার্থীদের প্রবেশ সীমিত করতে হলে প্রেসিডেন্টকে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। আইনের এই বিধানের বলে আমরা জেলা আদালতের আদেশ অনেকাংশে সমর্থন করি।
মনে হচ্ছে, মামলা চলাকালে প্রশাসন এটা শিখতে পারেনি, আদালত এমন যুক্তি সমর্থন করেন না যে প্রশাসনের কাজ পর্যালোচনা করা যাবে না। আদালত প্রশাসনকে নির্দেশনা দিয়েছেন, ‘প্রেসিডেন্টের অভিবাসন ও জাতীয় নিরাপত্তা নীতিবিষয়ক বিবেচনার প্রতি আমরা যত শ্রদ্ধাই দেখাই না কেন, তার মানে এই নয় যে, আমরা মোটেও এই নীতি পর্যালোচনা করতে পারব না...আমরা বিচারিক ভূমিকা ত্যাগ করিনি। এ ক্ষেত্রে “আইন কী জিনিস”, সেটা বলার ব্যাপারে আমাদের বাধ্যবাধকতা আছে (মারবুরি বনাম ম্যাডিসন, ৫ ইউ.এস.১৩৭, ১৭৭(১৮০৩)।’ তাহলে সরকার কেন গোঁ ধরে বসে থাকে, এই আইনি বিতর্কে আদালতের স্থান নেই।
সুনির্দিষ্ট আইনি পরিপ্রেক্ষিতে আদালত দেখেছেন, প্রেসিডেন্ট এমন কিছু পাননি যে বলা যায়, ‘কোনো এক বিদেশি গোষ্ঠীর আগমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের জন্য হানিকর।’ প্রশাসনের এই নিপীড়নমূলক কাজের ন্যূনতম ভিত্তি না থাকায় আদালত তাকে ভর্ৎসনা করেছেন: ‘২(সি) নম্বর ধারায় প্রথম যে তিনটি কারণ বর্ণিত হয়েছে, আমরা তা প্রত্যাখ্যান করি। কারণ এটা বিদ্যমান প্রক্রিয়া পর্যালোচনায় সরকারের সক্ষমতা সংরক্ষণ ও যথাযথ ভেটিং-প্রক্রিয়া নিশ্চিতকরণের সঙ্গে সম্পর্কিত। এমন তথ্য নেই যে বিদ্যমান ভেটিং কার্যক্রম অপর্যাপ্ত। আবার এমন তথ্যও নেই যে উন্নত ভেটিং-প্রক্রিয়া না থাকলে জাতীয় স্বার্থের হানি ঘটবে। এসব চিহ্নিত কারণের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, এই ছয়টি দেশের নাগরিকেরা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করলে আমাদের জাতীয় স্বার্থের হানি ঘটবে।’ মনে হয়, সরকারি আইনজীবীরা সংশ্লিষ্ট তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের চেষ্টা করেননি। কারণ, এই বিশুদ্ধ রাজনৈতিক পদক্ষেপের প্রমাণ নেই।
জাতীয় নিরাপত্তার যুক্তির জায়গা থেকে আদালত একই ভাবে খুঁজে পেয়েছেন, এই ছয়টি দেশের নাগরিকদের কেন যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে দেওয়া হবে না, তার সপক্ষে সরকার তেমন কোনো যুক্তি দেয়নি। সংক্ষেপে বললে, সরকারের নির্বাহী আদেশে এমন যুক্তি দেওয়া হয়নি যে কেন বিদ্যমান প্রটোকলের অধীনে এই ছয়টি দেশের নাগরিকেরা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের জন্য হানিকর হবেন।
এ ছাড়া ১৯৬৫ সালের এক আইনে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা সীমিত করা হয়েছে। এই আইনে বলা হয়েছে, ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্য করা যাবে না। নিষেধাজ্ঞার সমর্থকদের যুক্তি হচ্ছে, অভিবাসনের ওপর প্রেসিডেন্টের যে সামগ্রিক কর্তৃত্ব রয়েছে, এই আইনে তা খর্ব করা হয়নি। কিন্তু আদালত এর সঙ্গে একমত হননি।
আদালতের অনুসন্ধান হচ্ছে, প্রশাসন আইনি শর্ত পূরণ করেনি। ফলে এই নিষেধাজ্ঞার সাংবিধানিক দুর্বলতার দিকে নজর দেওয়ার কিছু নেই।
সরকারের তরফে একমাত্র জয় হচ্ছে, আদালত এই স্বীকৃতি দিয়েছেন যে সরকার আন্তসংস্থা ভেটিং পর্যালোচনা করতে পারবে। আর সুনির্দিষ্টভাবে প্রেসিডেন্টের কাজে যে নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে, তার প্রয়োজনীয়তা নেই।
সরকারের আইনজীবীরা কেন সরকারকে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে বোধগম্য অবস্থান নিতে তাড়া দিচ্ছেন না, সেটা আমাদের বোধগম্য নয়। অর্থাৎ কেন এই ছয়টি দেশের নাগরিকদের ভ্রমণনিষেধাজ্ঞা জরুরি বা কেন সব শরণার্থীর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হবে? জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের সাবেক মুখপাত্র ম্যাথু মিলার বলেছেন, ‘প্রেসিডেন্টের পরাজয়ের সামগ্রিক পরিণতি দেখে আমি স্তম্ভিত। তিনি আইনি ও সাংবিধানিক কারণে হেরে গেছেন।’
কেউ হয়তো ভাবতে পারেন, প্রশাসন প্রয়োজনীয় সাক্ষ্যপ্রমাণ জোগাড় করতে অক্ষম, অথবা তারা অলস। আমরা ভিন্ন এক তত্ত্ব পছন্দ করি: এই আদেশগুলোর নিরাপত্তা বা অন্যান্য যৌক্তিকতা নেই; বরং এগুলো কিছু সংস্কারে স্থূলভাবে সুড়সুড়ি দেওয়া, যার কোনো প্রামাণিক ও যৌক্তিক ভিত্তি নেই। পৃথিবীর কোনো আইনজীবী আদালতে তা প্রমাণ করতে পারবেন না।