বাংলাদেশ ও ভুটানের মধ্যে ৫টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর
বাংলাদেশ ও ভুটান ৫টি দলিল স্বাক্ষর করেছে। এরমধ্যে ৩টি সমঝোতা স্মারক এবং দুটি চুক্তি রয়েছে। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদারের অংশ হিসেবে কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সংস্কৃতি বিষয়ক এসব চুক্তি ও স্মারক স্বাক্ষর হয়।
রয়াল ব্যাংকুয়েট হলে আজ ভুটানের প্রধানমন্ত্রী তেসারিং তোবগের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পরে তাঁদের উপস্থিতিতে এই দ্বিপাক্ষিক চুক্তি ও স্মারকগুলো স্বাক্ষরিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমানে অটিজম এবং নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিসর্ডার সম্পর্কিত একটি সম্মেলনে যোগ দিতে তিনদিনের সরকারি সফরে ভুটানে অবস্থান করছেন।
বাংলাদেশের পক্ষে সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব সুরাইয়া বেগম, পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ডিজি মনোয়ার হোসেন। অন্যদিকে ভুটান সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাগণ চুক্তি ও স্মারকে স্বাক্ষর করেন।
বিবিআইএন প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পাদনে ভুটানের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহবান
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল (বিবিআইএন) এর মধ্যে সম্পাদিত মোটর যান চুক্তির অনুস্বাক্ষর প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করার জন্য ভুটানের প্রতি আহবান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, এই চুক্তি সম্পাদনের উদ্যোগ ভুটানের জলবায়ু সংক্রান্ত সমস্যার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সন্ধ্যায় জিয়ালিয়ং তোসখাঙ্গ এর রয়্যাল ব্যাংকুয়েট হলে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী দাসো থেসারিং তোবগে’র সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে একথা বলেন।
বৈঠকের পর পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন।
প্রধানমন্ত্রীর আহবানের প্রেক্ষিতে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী তোবগে বলেন, তাঁর দেশও বিবিআইএন প্রক্রিয়ার সঙ্গে একাত্ম এবং এই বিবিআইএন যোগাযোগ কার্যকরভাবে সম্পন্ন হলে তা কিভাবে জলবায়ু সমস্যার সমাধানে কার্যকরি হয় তারই প্রতীক্ষায় রয়েছেন।
তিনি বলেন, ভুটান বিবিআইএন’র বিষয়টি এর চেতনা থেকেই দেখছে এবং এটি সম্পন্ন হলে কিভাবে জলবায়ু সমস্যার মোকাবেলা করা যায় তারই প্রতীক্ষায় রয়েছে।
পর্যটন বিষয়ে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী থেসারিং তোবগে বলেন, কিভাবে বাংলাদেশের কক্সবাজার এবং কুয়াকাটাকে কেন্দ্র করে একটি পর্যটন করিডোর প্রতিষ্ঠা করা যায় যাতে করে এর সম্ভবনাগুলোকে আরো কাজে লাগানো সম্ভব হয় সেজন্য ভুটান বাংলাদেশে একটি প্রতিনিধি দল পাঠাতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় তাঁর সরকারের উদ্যোগে ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণার প্রসংগ উল্লেখ করে এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলের স্বীকৃতির জন্য ভুটানের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন।
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, দুই দেশের মধ্যে কৃষি, দ্বৈতকর প্রত্যাহার, সাংস্কৃতিক সহযোগিতা এবং অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল সম্পর্কিত যে সব চুক্তি এবং সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে সেগুলো দুই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। এতে করে দুই দেশের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বন্ধন আরো সুদৃঢ় হবে।
তিনি বলেন, ভুটান ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের পর থেকেই এ দুই দেশের মধ্যে বিশেষ সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে।
এই সম্পর্ককে আরো শক্ত ভীতের ওপর দাঁড় করানোর বিষয়ে শহীদুল হক বলেন, ভুটান ইতোমধ্যেই রাজধানী থিম্পুতে বাংলাদেশের নিজস্ব দূতাবাস ভবন গড়ে তোলার জন্য বাংলাদেশকে জমিও দিয়েছে।
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, দুই দেশের যোগাযোগ খাতকে আরো শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণের বিষয়টি দুইনেতার দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে আলোচিত হয়।
পাশাপাশি, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী জলবিদ্যুৎ বিনিময়ের ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, ‘এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে জলবিদ্যুৎ এই অঞ্চলের জন্য গেম চেঞ্জার হিসেবে বিবেচিত হবে।’
তিনি বলেন, ‘ভুটানে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হবে এবং সেই বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে তিনটি দেশেই যাবে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সময় বাংলাদেশ ভুটানের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি দূর করে দুই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে সমতা আনয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
ভুটানের প্রধানমন্ত্রী ভুটানে বাংলাদেশ থেকে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ প্রত্যাশা করে বলেন, বাংলাদেশের সফটওয়্যার কোম্পানী ইতোমধ্যেই ভুটানে কাজ করছে এবং তাদের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতাও বেশ ভালো।
এ সময় বুড়িমারী স্থল বন্দরের অভ্যন্তরীন কাষ্টমস হাউজে বিলম্বের বিষয়ে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবেন বলে জানান।
ভুটানের ৪র্থ রাজার জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে একটি স্বাস্থ্য বিষয়ক ট্রাস্ট ফান্ড করার বিষয়েও প্রধানমন্ত্রী তোবগে বাংলাদেশের সাহায্য এবং সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন।
শেখ হাসিনা ভুটানকে এ বিষয়ে সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করেন।
বাংলাদেশের চিকিৎসকদের ভুটানে কাজের সুযোগ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী তোবগে বলেন, ভুটানে কর্মরত একজন বিদেশী চিকিৎসক দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহ ব্যতিরেকেই প্রতিমাসে প্রায় ৩ হাজার ডলার করে আয় করতে সক্ষম হন।
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘যদি বাংলাদেশের চিকিৎসকদের কেউ আগ্রহী হন তবে ভুটানে তাঁদের কাজের সুযোগ রয়েছে।’
ভুটানের প্রধানমন্ত্রী এ সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে জানান, তাঁদের ১২৩ জন মেডিকেল স্টুডেন্ট বাংলাদেশে পড়াশোনা করছে। যাদের অধিকাংশই পুরো বৃত্তি বা উপবৃত্তির আওতায় পড়াশোনা করছে। ভুটানের শিক্ষার্থীদের জন্য এই সুবিধা আরো বাড়ানো হতে পারে বলেও তিনি জানান।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় রংপুর মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করতে ইচ্ছুক ভুটানের শিক্ষার্থীদের জন্য বা অন্য মেডিকেলেও পড়তে ইচ্ছুকদের জন্য বিশেষ সীটসহ বরাদ্দ রাখা হতে পারে বলেও জানান।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় অটিজম বিষয়ে আন্তর্জাতিক সেমিনার আয়োজন করায় ভুটানের প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান।
ভূটানের প্রধানমন্ত্রী এ সময় বাংলাদেশ ও ভুটানের মধ্যে সাংস্কৃতিক চুক্তিটি নবায়নে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ‘এর মাধ্যমেই ভুটান এবং বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বিনিময় উত্তোরোত্তর বৃদ্ধি পাবে।
বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ, ভুটান এবং ভারতের মধ্যে ফাইবার অপটিক কানেক্টিভিটির বিষয়টি উত্থাপন করলে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে তিনটি দেশের মধ্যে আলাপ-আলোচনার প্রস্তাব করেন।
বৈঠকে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী ভুটান, বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে সাব রিজিওনাল ওয়াটার ম্যানেজমেন্টের বিষয়টিও উত্থাপন করেন।
বিমসটেক বিষয়ে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখানে আঞ্চলিক সহযোগিতার অমিত সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা বিমসটেক’কে সমর্থন করি এবং এর মাধ্যমে আঞ্চলিক সহযোহিতার ক্ষেত্রকে আরো শক্তিশালী করা সম্ভব।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় ভুটানের ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য চট্টগ্রাম এবং মংলা বন্দর এবং সৈয়দপুর বিমানবন্দর ব্যবহার করতে দেয়ার তাঁর প্রস্তাব পুনর্ব্যক্ত করেন।
পরে প্রধানমন্ত্রী রয়্যাল ব্যাংকুয়েট হলে তাঁর সম্মানে ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ভোজ সভায় যোগ দেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অটিজম এবং নিউরোডেভেলপমেন্টাল ডিসর্ডার বিয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে তিনদিনের সরকারি সফরে বর্তমানে ভুটানে অবস্থান করছেন।