সন্ত্রাসী চাঁদাবাজ মেহেরপুরে বন্দুকযুদ্ধে ৪ জন নিহত অজানা কাহি
ষ্টাফ রিপোটার// মেহেরপুরে পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে ৪ জন নিহত হয়েছে। সোমবার রাত আড়াইটার দিকে সদর উপজেলার নুরপুর মোড়ে এ ঘটনা ঘটে। নিহত ৪ জন এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী বলে জানা গেছে। নিহতরা হচ্ছে- সদর উপজেলার পিরোজপুর ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামের ভাদু মালিতার ছেলে সাদ্দাম হোসেন (২৫) ও একই গ্রামের রশোময় কর্মকারের ছেলে রমেশ কর্মকার (২৪), পার্শ্ববর্তী টুঙ্গি গ্রামের মনিরুল ইসলামের ছেলে সোহাগ হোসেন (২৫) এবং পিরোজপুর গ্রামের কালাম হোসেন খাঁর ছেলে কামরুজ্জামান কানন খাঁ (২৫)। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন সহকারি পুলিশ সুপার আহসান হাবীবসহ ৬ পুলিশ সদস্য। ঘটনাস্থল থেকে ১টি রিভালবার, ১টি কাটারাইফেল, ১১টি হাতবোমা, ২টি ছোরা ও ২টি রামদা উদ্ধার করেছে পুলিশ। অপরদিকে ঘটনাস্থল থেকে গ্রেফতার একজন জোড়া হত্যা মামলার বিষয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। বন্দুক যুদ্ধে নিহত ৪ জন গত ৫ মার্চ রাতে সোনাপুর গ্রামের দুই ব্যবসায়ীকে অপহরণ পুর্বক হত্যকা-ের ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে জানায় পুলিশ।
মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালের জরুরী বিভাগের চিকিৎসক আবু এহসান রাজু জানান, রাত পৌনে ৪ টার দিকে গুলিবিদ্ধ ৪ জনকে হাসপাতালে নিয়ে আসে পুলিশ। হাসপাতালে আসার আগেই তাদের মৃত্যু হয়।
মঙ্গলবার বেলা ১১ টার দিকে মেহেরপুরের পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান তার কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, সোমবার সকালে ঢাকা থেকে ৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়। সোনাপুর গ্রামের জোড়া হত্যাকা-ের বিষয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তার প্রাথমিক স্বীকারোক্তি দিয়ে অস্ত্র ও বোমার সন্ধান দেয়। সে অনুযায়ী সোমবার দিনগত গভীর রাতে মেহেরপুর-মহাজনপুর সড়কের পাশে সদর উপজেলার নূরপুর গ্রামের মোড় এলাকার জনৈক আকামতের লিচু বাগানের কাছে তাদের নিয়ে অস্ত্র উদ্ধারে যায় পুলিশ। এসময় তাদের অজ্ঞাত সহযোগীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ করে। আত্মরক্ষার্থে পুলিশ পাল্টা গুলি বর্ষণ করলে বন্দুকযুদ্ধ শুরু হয়। পুলিশ সন্ত্রাসীদের প্রতি ২৫ রাউন্ড শর্টগানের কাতৃুজ ও ১৭ রাইন্ড চাইনিজ রাইফেলের গুলি বর্ষণ করে। ১৫-১৬ মিনিট চলে উভয় পক্ষের মধ্যে গোলা-গুলি। সন্ত্রাসীদের গুলির জবাব দিতে যখন পুলিশ ব্যস্ত তখন ওই চারজন পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু অজ্ঞাত ওই সন্ত্রাসীদের ছোড়া গুলিতে তারা গুলিবিদ্ধ হয়। ঘটনাস্থলে পিরোজপুর, নূরপুর গ্রামসহ আশে-পাশের লোকজন ছুটে এলে তাদের সামনে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ১টি রিভালবার, ১টি কাটারাইফেল, ১১টি হাতবোমা, ২টি ছোরা ও ২টি রামদা উদ্ধার করে। আহতদের উদ্ধার করে মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা ৪ সন্ত্রাসীকে মৃত ঘোষণা করে।
এদিকে ঘটনাস্থল থেকে অস্ত্র ও বোমা উদ্ধারের পাশাপাশি আহত পুলিশ সদস্যদের হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয। নিহত ৪ জন এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী গ্রুপের অন্যতম সদস্য উল্লেখ করে পুলিশ সুপার আরো বলেন, তাদের নামে বিভিন্ন থানায় সন্ত্রাসী, ডাকাতি ও বোমা বিষ্ফোরণের কয়েকটি মামলাসহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। তারা চিহ্নিত চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ মুখ খোলেনি।
এদিকে স্থানীয়রা জানিয়েছেন, তাদের পতনের মধ্য দিয়ে এলাকায় স্বস্তি ফিরে এসেছে। তাদের মৃত্যুর খবরে এলাকাবাসী রাস্তায় নেমে আসে; আনন্দ মিছিল করে এবং একে অপরের মুখে মিষ্টি তুলে দেয়।
স্থানীয়রা আরো জানান, নিহত সাদ্দাম হোসেন সোনাপুর গ্রামের ভাদু মালিতার ২ ছেলের মধ্যে বড় ছেলে। প্রায় ৪ বছর ধরে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সাথে জড়িত। সে চুয়াডাঙ্গাতে বিয়ে করে এবং এক মেয়ে সন্তানের জনক। বিকেল ৫ টায় দিকে তার লাশ গ্রামে পৌঁছে এবং ঈদগাহ মাঠে নামাজে জানাজা শেষে গ্রাম্য কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হয়েছে। রমেশ কর্মকার একই গ্রামের রশোময় কর্মকারের এক ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে বড়। সে ছিলো অবিবাহিত। ছোটকাল থেকে সে সন্ত্রাসীদের সাথে উঠাবসা করতে করতে আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেনি। এদিন সন্ধ্যার পরে তার মরদেহ পার্শ্ববর্তী যাদুখালী সংলগ্ন ভৈরব নদের শ্মশানে হিন্দুধর্ম মতে পুতে ফেলা হয়। সোহাগ হোসেন পার্শ্ববর্তী টুঙ্গি গ্রামের মনিরুল ইসলামের ৩ ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে বড়। সে ছিল অবিবাহিত। এদিন বাদ মাগরিব নামাজে জানাজা শেষে টুঙ্গি গ্রাম্য করবস্থানে তার লাশ দাফন করা হয়। কামরুজ্জামান কানন খাঁ পিরোজপুর গ্রামের কালাম হোসেন খাঁর এক ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে বড়। প্রথম বউ ঘরে রেখে দ্বিতীয় বিয়ে করে মেহেরপুর সদর উপজেলার বারাদী চৌগাছা গ্রামে। এতে প্রথম বউ তাকে ছেড়ে চলে যায়। সে এলাকায় বোমা কারিগর হিসেবে এলাকায় বিশেষভাবে পরিচিত। এদিন পিরোজপুর মাদ্রাসা প্রাঙ্গনে নামাজে জানাজা শেষে গ্রাম্য কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হয়। স্থানীয় আরো জানায়, নিহতদের প্রতি মানুষের এত বেশি ঘৃনা ছিলো যে তাদের দাফন অনুষ্ঠানে খুবই সীমিত লোকের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে।
চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার নতিপোতার ব্যবসায়ী মামুন জানান, নিহত সন্ত্রাসী চাঁদাবাজরা তাকেও তুলে নিয়ে গিয়েছিলো এবং ৫ লাখ টাকা মুক্তিপন নিয়ে ছেড়ে দেয়। চুয়াডাঙ্গার কুলপালা গ্রামে বোমা মেরে এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছিল নিহত ওই সন্ত্রাসীরা।
এদিকে সোনাপুর গ্রামের ব্যবসায়ী আব্দুল মজিদ ও আসাদুল ইসলাম হত্যাকা-ের ঘটনার রহস্য উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ। পথের কাঁটা পরিস্কার করতেই চিহ্নিত কয়েকজন সন্ত্রাসী তাদের গলাকেটে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছে আজিজুল ইসলাম (২৫) নামের এক চিহ্নিত সন্ত্রাসী। পুলিশের হাতে গ্রেফতারের পর মঙ্গলবার বিকেলে মেহেরপুর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে।
মেহেরপুর সদর থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইকবাল বাহার চৌধুরী জানান, সোমবার বেলা ১১টার দিকে রাজধানী ঢাকায় বিশেষ অভিযানে সোনাপুর গ্রামের খোকন মিয়ার ছেলে আজিজুল হকসহ ৫ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। জোড়া খুনের ঘটনায় সন্দিগ্ধ হিসেবে তাদের গ্রেফতার করা হয়। পুলিশের কাছে তারা হত্যকা-ের বিষয়ে স্বীকারোক্তি দেয়। তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে অস্ত্র-বোমা উদ্ধার করতে গিয়ে বন্দুকযুদ্ধে সাদ্দামসহ ৪ জন নিহত হয়। এ ঘটনায় বেঁচে যায় আজিজুল। মঙ্গলবার পুলিশ তাকে মেহেরপুর আদালতে সোপর্দ করে। জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হাদিউজ্জামান ১৬৪ ধারায় তার জবানবন্দি গ্রহণ করেন।
জবানবন্দির উদ্ধৃতি দিয়ে ওসি আরো জানান, আজিজুল ও তার সহযোগী বন্দুকযুদ্ধে নিহত ৪ জন এবং আরো ৫ জন ওই হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত। নিহত সাদ্দাম হোসেন সদর, মুজিবনগর ও দামুড়হুদা উপজেলার কিছু অংশে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। চাঁদাবাজি, বোমাবাজি, ডাকাতি ও হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত ছিল ওই গ্রুপ। তাদের ভয়ে এলাকার সাধারণ মানুষ এতটাই ভীত ছিল যে, পুলিশের কাছে মুখ খুলতে সাহস করেনি। কিন্তু মজিদ ও আসাদুল চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কথা বলতেন। তাদের চাঁদা আদায়ের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় ওই দুইজন। তাই পথের কাঁটা পরিস্কার করতেই পুর্ব পরিকল্পিতভাবে তাদের দু’জনকে অপহরণ পুর্বক হত্যা করে সাদ্দাম বাহিনী। এদিকে আজিজুলকে জোড়া হত্যা মামলার আসামি হিসেবে জেল হাজতে প্রেরণের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। আদালতের নির্দেশে তাকে গতকালই জেলা কারাগারে প্রেরণ করেছে পুলিশ।
উল্লেখ্য, গত ৫ মার্চ রাত ১০টার দিকে সোনাপুর গ্রামের ব্যবসায়ী আব্দুল মজিদ ও আসাদুল ইসলামকে গ্রামের একটি চায়ের দোকান থেকে অপহরণ করে সন্ত্রাসীরা। দাবিকৃত ১০ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ না পেয়ে তাদেরকে গলাকেটে হত্যা করে তারা। পরের দিন বেলা ১১ টার দিকে কাঁঠালপোতা গ্রামের একটি তামাক ক্ষেত থেকে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়।
