অগ্নিগর্ভ কাশ্মির: সহিংসতায় নিহত ২৩, চাপের মুখে মোদি সরকার
ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মিরে সহিংস ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ২৩ জনে পৌঁছেছে। পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ থাকায় আজও (সোমবার) রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে কারফিউ অব্যাহত এবং মোবাইল ইন্টারনেটে নিষেধাজ্ঞা চালু রয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার রোববার রাজ্যটিতে নতুন করে প্রায় ২ হাজার অতিরিক্ত নিরাপত্তা বাহিনী পাঠিয়েছে।
রাজ্যে গত শুক্রবার সন্ধ্যায় নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে গেরিলাদের সংঘর্ষে স্থানীয় হিজবুল মুজাহিদীন কমান্ডার বুরহান ওয়ানি নিহত হওয়ার পর থেকে পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে। বুরহান নিহত হওয়ার প্রতিবাদে রাজ্যে হাজার হাজার ক্ষুব্ধ জনতা গত ৩ দিন ধরে সড়কে নেমে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। পুলিশের গুলিতে ক্রমশ বেড়ে চলেছে মৃত্যু মিছিল। ইট-পাথর হাতে নিয়েই তারা সশস্ত্র নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিচ্ছে।
অন্যদিকে, বিক্ষোভকারীদের পাথরের আঘাতে প্রায় শ’খানেক পুলিশ এবং সিআরপিএফ জওয়ান আহত হয়েছেন। এ পর্যন্ত তিনটি থানায় আগুন ধরানোর ঘটনা ঘটেছে। আগুন লাগানো হয়েছে তিনটি প্রশাসনিক দপ্তর ও পিডিপি’র এক বিধায়কের বাড়িতে। বিজেপি’র একটি দপ্তরেও হামলা হয়েছে।
রোববার অনন্তনাগ জেলায় উত্তেজিত জনতা বিতস্তা নদীতে পুলিশের একটি মোবাইল বাঙ্কার গাড়ি ঠেলে ফেলে দিলে ফিরোজ আহমেদ নামে পুলিশের এক চালকের মৃত্যু হয়। পুলওয়ামা জেলায় অন্য একটি ঘটনায় এর আগে পুলিশের এক হেড কনস্টেবলকে লক্ষ্য করে বিক্ষোভকারীরা গুলি চালালে ওই পুলিশকর্মীর দুই পায়ে গুলি লাগে।
কাশ্মিরি নেতাদের বনধের ডাকে সমগ্র কাশ্মির উপত্যাকার জনজীবন স্তব্ধ হয়ে গেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে কারফিউ জারি করেও ঠেকানো যাচ্ছে না প্রতিবাদকারীদের। হুররিয়াত নেতাদের গৃহবন্দী করে রেখে পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাবে বলে সরকারপক্ষ মনে করলেও তাদের সেই কৌশল কার্যত চরমভাবে ফ্লপ হয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং গতকাল রোববার পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতির সঙ্গে প্রায় ৩০ মিনিট ধরে কথা বলে রাজ্য সরকারকে সব রকমের সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন।
কেন্দ্রীয় সরকার রোববার নতুন করে প্রায় ২ হাজার অতিরিক্ত নিরাপত্তা বাহিনী রাজ্যটিতে পাঠানোয় পরিস্থিতি যে মোটেই শান্ত হয়নি তা স্পষ্ট হয়েছে। তাছাড়া রাজ্যের কোনো স্থান থেকে কারফিউ শিথিল করা বা প্রত্যাহার করে নেয়ার খবরও পাওয়া যায়নি।
পিডিপি-বিজেপি নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকার যে চলতি সহিংসতা নিয়ে অনেকটাই হতাশ হয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী নঈম আখতারের কথায়। তিনি সরকারের পক্ষ থেকে রাজ্যে শান্তি ফেরাতে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি কার্যত এতদিনের ‘অচ্ছুৎ’ হুররিয়াত কনফারেন্সের উদ্দেশ্যেও আবেদন জানিয়েছেন। নঈম আখতার বলেন, আমরা ওদের প্রতি আবেদন জানাচ্ছি। ওরা যদি চায় রাজ্যে শান্তি ফিরুক ও প্রাণহানি ঠেকাতে সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে সেগুলো সফল হোক, তাহলে ওদের সমর্থনও লাগবে আমাদের।
হুররিয়াত কনফারেন্সের একাংশের প্রধান সাইয়্যেদ আলী শাহ গিলানি অবশ্য ‘মানুষ হত্যা’র জন্য মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি এবং আরএসএসকে দায়ী করেছেন।
আলী শাহ গিলানিসহ কাশ্মিরি নেতারা
অন্যদিকে, কাশ্মিরে চলমান সহিংসতা নিয়ে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে অস্বস্তি বেড়েছে কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের। আগামী ৪ অগস্ট ইসলামাবাদে সার্কভুক্ত দেশগুলোর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক হওয়ার কথা। সেখানে সন্ত্রাস প্রশ্নে বিশেষ করে ভারত এবং বাংলাদেশ পাকিস্তানকে চেপে ধরতে চাইলেও তা ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা তেমন নেই। কাশ্মিরের বর্তমান পরিস্থিতির কথা তুলে ধরে পাকিস্তান সেই চাপের মোকাবিলা করার চেষ্টা করবে বলে কেন্দ্রীয় মোদি সরকারের আশঙ্কা।
পাকিস্তান সরকারের বর্তমান মনোভাবে সেদেশে অনুষ্ঠিত হতে চলা সার্ক ভুক্ত বৈঠকে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের যোগ দিতে বিজেপি এবং আরএসএসের একাংশ আপত্তি তুলতে পারে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থানে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা প্রক্রিয়ায় প্রভাব পড়তে পারে বলে নয়াদিল্লি মনে করছে।
কাশ্মির পরিস্থিতির কারণে প্রধানমন্ত্রী মোদি অভ্যন্তরীণ চাপের মুখেও পড়তে পারেন বলে সরকারের একাংশের আশঙ্কা। প্রশ্ন উঠতে পারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পাকিস্তান নীতি নিয়েও।
প্রসঙ্গত, রোববার পাক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বুরহান ওয়ানি ও অন্য নির্দোষ কাশ্মিরিদের হত্যাকে নিন্দনীয় এবং দুঃখজনক বলে মন্তব্য করা হয়েছে। এভাবে কাশ্মিরিদের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে বলে ওই বিবৃতিতে অভিযোগ করা হয়েছে। ‘জম্মু-কাশ্মিরের মানুষ নিজেদের ভবিষ্যৎ নিজেরাই স্থির করবেন। সেই অধিকারের দাবিকে কেউ কেড়ে নিতে পারে না। জম্মু-কাশ্মির সমস্যার সমাধান কেবল জাতিসংঘের মাধ্যমে নিরপেক্ষ জনমত সংগ্রহের মাধ্যমে হতে পারে’ বলেও পাকিস্তানের পক্ষ থেকে পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। কাশ্মিরি নেতাদের গ্রেফতারে উদ্বেগ প্রকাশ করে দেশটির পক্ষ থেকে জাতিসংঘের নিয়ম অনুযায়ী মানবাধিকার পালন করার কথাও বলা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী এম ভেঙ্কাইয়া নাইডু অবশ্য পাকিস্তানকে কিছুটা হুঁশিয়ারি দেয়ার ঢংয়ে বলেছেন, ভারত পাকিস্তানের সাথে একসঙ্গে কাজ করতে চায় এবং বন্ধুত্ব রাখতে চায়। কিন্তু পাকিস্তান যদি এ ধরণের কাজ অব্যাহত রাখে তাহলে ভারতকে নিজেদের নীতি সম্পর্কে চিন্তা করতে হবে। পাকিস্তানের এ ধরণের কৌশল ছেড়ে দেয়া উচিত। নাইডু জোর দিয়ে বলেন, কাশ্মির ভারতের এক অভিন্ন অংশ এবং এই ইস্যুতে কোনো প্রকার সংলাপ বা আলোচনার কোনো প্রশ্নই নেই। তিনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কাশ্মিরে নিহত হিজবুল কমান্ডার বুরহান ওয়ানির সমর্থকদের উসকানি দেয়ার অভিযোগ করেছেন।
এভাবে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে পাল্টাপাল্টি মন্তব্য এবং সরকারের অভ্যন্তরে নানা আশঙ্কার জল্পনা শুরু হওয়ায় কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার চাপের মুখে পড়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। আর কয়েকদিন পরেই সংসদের বর্ষাকালীন অধিবেশন শুরু হতে যাচ্ছে। কাশ্মির পরিস্থিতির উন্নতি না হলে কেন্দ্রীয় সরকার সংসদেও বিরোধীদের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
No comments: