রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চুক্তি সই
রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নকশা
পরিবেশবাদীদের সমালোচনা সত্ত্বেও ২০০ কোটি ডলার অর্থায়নে রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের চুক্তিতে আনুষ্ঠানিকভাবে সই করেছে বাংলাদেশ ও ভারত। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে এই চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রতিনিধিরা।
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ করতে ভারত হেভি ইলেকট্রিক্যালস লিমিটেড (ভেল) এবং বাংলাদেশ ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফপিলি) এর মধ্যে চুক্তিটি সম্পাদিত হয়। বিআইএফপিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক উজ্জ্বল কান্তি ভট্টাচার্য এবং বিএইচইএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রেম পাল যাদব চু্ক্তিতে সই করেন।
চুক্তি সই অনুষ্ঠানে জানানো হয়, ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার এই কেন্দ্র নির্মাণে প্রয়োজনীয় ১ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার অর্থায়ন করবে ভারতীয় এক্সিম ব্যাংক। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হবে।
পরে বিআইএফপিসিএলের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, “বাংলাদেশে বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ বিপিডিবি এবং ভারতের এনটিপিসি’র সমান অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে বিআইএফপিসিএল কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত হয়। মৈত্রী সুপার থারমাল পাওয়ার প্রজেক্ট বিআইএফপিসিএলের প্রথম প্রকল্প, যা সরকারের অগ্রাধিকার হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।”
চুক্তি সই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই ইলাহী চৌধুরী বলেন, “রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিবেশের ওপর কোনরকম বিরূপ প্রভাব ফেলবে না। এটা এমনভাবে করব, পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যুৎকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলব।”
অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেন, “ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্বের সব থেকে বড় প্রকল্প এই রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। প্রকল্প ব্যয় দুই বিলিয়ন ডলারের ওপরে। ভারত থেকে ৫০০ মেগাওয়াট এবং পরবর্তীতে আরও ১০০ মেগাওয়াট এবং বন্ধুত্বের স্বাক্ষর হিসেবে আরও বিদ্যুৎ পেতে যাচ্ছি। এই বিদ্যুতের প্রকল্প দুই দেশের বন্ধুত্বকে আরও গাঢ় করবে। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর দূরদৃষ্টি দুই দেশেরই উন্নতি কেবল নয়, তাদের দূরদৃষ্টির কারণে সার্কভুক্ত দেশগুলোরও উন্নতি হচ্ছে।”
বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বলেন, “বাংলাদেশের উন্নয়নে ভারত আগের মতোই অংশীদার থাকবে। কোনো কিছুই দুই দেশের এই উন্নয়ন পদক্ষেপগুলোকে দমিয়ে রাখতে পারবে না।”
চুক্তি স্বাক্ষর শেষে ভারতের বিদ্যুৎ সচিব প্রদীপ কুমার পূজারি বলেন, “দু’দেশের মধ্যে বিদ্যুৎ বিনিময় আগেই শুরু হয়েছে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিনিয়োগের মাধ্যমে দু’দেশের সম্পর্ক আরও জোরদার হবে। আন্তর্জাতিক মানের এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে নির্ধারিত সময়েই বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে।”
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সচিব মনোয়ার ইসলাম বলেন, ‘বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে সবরকম নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ হলে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না।’
এর আগে তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য-সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেছিলেন, ‘রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হলে সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাবে। ধ্বংস হবে সুন্দরবনের বহু লালিত জীববৈচিত্র্যও।’
১৫ জানুয়ারি সাতক্ষীরা জেলা পুরাতন আইনজীবী ভবন মিলনায়তনে আয়োজিত এক সমাবেশে আনু মুহাম্মদ এ কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, ‘সুন্দরবনের সন্নিকটে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাস্তবায়িত হলে সুন্দরবন ধ্বংস করতে তিন মাসই যথেষ্ট। বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুর পর প্রতিদিন শতাধিক জাহাজ আসবে সুন্দরবন হয়ে। যদি কোনো দুর্ঘটনা নাও ঘটে তারপরও ধ্বংস হবে সুন্দরবন।সরকার বারবার বলছে এর বাতাস সুন্দরবনের দিকে যাবে না। কিন্তু এটি মিথ্যাচার। কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত লোকজন ছাড়া দেশের বেশির ভাগ মানুষ এর পক্ষে নয়।’
বাংলাদেশ ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফপিলি) ১৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক মৈত্রী সুপার থারমাল পাওয়ার নামের এই কেন্দ্র স্থাপন করবে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে এই চুক্তি হওয়ার কথা ছিল। দরপত্র মূল্যায়ন শেষে জানুয়ারি মাসে ভারতের কোম্পানি ভেলকে অনুমোদন দিয়ে ছিল বাংলাদেশ-ভারত ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি (বিআইএফপিসিএল), বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি), ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার করপোরেশন (এনটিপিসি) এর স্ব স্ব বোর্ড।
তিন বোর্ডের অনুমোদন পাওয়ার পর গত ৩০ জানুয়ারি ভেলকে চিঠি দিয়ে চুক্তি করতে বলা হয়েছিল। শর্ত অনুযায়ী, চিঠি পাওয়ার ২৮ দিনের মধ্যে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ভেলকে বিআইএফপিসিএল এর সঙ্গে চুক্তি করার কথা। কিন্তু পরে এই সময় বাড়ানো হয়।
গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে তিনটি কোম্পানি দরপ্রস্তাব জমা দেয়। এরমধ্যে যৌথভাবে জাপানের মারুবিনি করপোরেশন ও ভারতের লারসেন এন্ড টুব্রো লিমিটেড এবং চীনের হারবিন ইলেকট্রিক ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি লি, ফ্রান্সের এএলএসটিওএম ও চীনের ইটিইআরএন। এছাড়া ভারতীয় কোম্পানি ভারত হেভি ইলেক্ট্রিক্যালস্ লিমিটেড (ভেল) এককভাবে দরপ্রস্তাব জমা দেয়। দরপ্রস্তাবের সাথেই কোম্পানিগুলো কেন্দ্র স্থাপনের বিনিয়োগ কারা করবে তার নিশ্চয়তা নিয়ে এসেছিল।
চূড়ান্ত চুক্তি করার তিনমাসের মধ্যে অর্থনৈতিক চুক্তি করতে হবে। অথনৈতিক চুক্তির ৪১ মাসের মধ্যে প্রথম ইউনিট এবং ৪৬ মাসের মধ্যে দ্বিতীয় ইউনিট উৎপাদনে আনতে হবে। এই হিসেবে কেন্দ্র স্থাপন শেষ হবে ২০১৯ সালের শেষে।
রামপাল কেন্দ্রের ৭০ শতাংশ অর্থ ঋণ নেয়া হবে। এই ঋণ দেবে ভারতের এক্সিম ব্যাংক। বাকি ৩০ শতাংশ পিডিবি ও এনটিপিসি যৌথভাবে বিনিয়োগ করবে।
সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই কেন্দ্র স্থাপনে আনুমানিক খরচ ধরা হয়েছে ২০১ কোটি ৪৫ লাখ ৬০ হাজার ডলার। এর ১৫ শতাংশ হিসাবে ৩০ কোটি ২১ লাখ ৮৪ হাজার ডলার দিতে হবে পিডিবিকে।#
No comments: