Sponsor



Slider

বিশ্ব

জাতীয়

মেহেরপুর জেলা


গাংনী উপজেলা

মুজিবনগর উপজেলা

ফিচার

খেলা

মেহেরপুর সদর উপজেলা

ছবি

ফেসবুকে মুজিবনগর খবর

» » প্রেমিক উত্তম





 প্রেমিক উত্তম

ঊনসত্তর সাল।

মানে, ঘোর নকশাল আমল।

প্রেসিডেন্স কলেজ লাইব্রেরির পাশের কিউবিক্‌লে আমরা, এমএ ছাত্রছাত্রীরা, অপেক্ষায় ছিলাম প্রফেসর তারক সেনের ক্লাসের।

হঠাৎ করে তিনটি মেয়ের মধ্যে কথা উঠল উত্তমকুমারকে নিয়ে।

এই তিন আধুনিকা এবং ইংরেজি সাহিত্যমত্তা মেয়েরা যে বাংলা ছবি দেখে তা জেনেই অবাক হচ্ছিলাম।

তাও ব্রান্ডো, বার্টন, ও’টুল হলে কথা ছিল। একেবারে উত্তমকুমার, এবং মেয়েদের কাছে ওঁর আকর্ষণ।

আমি সাবেক মধ্য কলকাতার ছেলে, লাইনে দাঁড়িয়ে উত্তম-সুচিত্রা দেখেছি। আমার তো কৌতূহল হবেই। দিব্যি কান খাড়া করেছি।

কিন্তু যা শুনলাম, তা স্নায়ু বেয়ে ঠেকল গিয়ে ব্রহ্মতালুতে।

ওদের একজন এক্সপার্ট কমেন্ট দেবার ছিরিতে বলল, ‘‘আসলে কী জানিস, উত্তমের যেটা আছে তা হল SA!’’

SA? ক’টা বাঙালি তখন জানে এই সদ্যসৃষ্ট বোলচালটা, যার অর্থ ‘সেক্স অ্যাপিল’?
‘শখের চোর’ ছবিতে

আর উত্তমকুমারের এসএ-টা কীসে, তা তো আমাদের মতো ছোকরাদের মাথাতেই আসেনি তদ্দিনে।

আমাদের ধারণা ছিল কায়দা করে কামু-কাফকা করলেই মেয়েরা প’টে যামিনী রায়ের পটের মতো স্থির।

আর গালিবের মতো কে আর বোঝাচ্ছে তখন যে, হাজারো বেদনা আছে ভালবাসা ছাড়াও?

স্রেফ প্রেমের বুলি আউড়েই যে উত্তমকুমার প্রেমিক উত্তমকুমার হননি, এটা বুঝতে ছেলেদের বেশি সময় লেগেছে।

আমরা মজেছিলাম ওঁর চুলের ইউ ছাঁটে। স্লো-মোশনে ঘাড় ঘুরিয়ে ওঁর ‘আমায় কিছু বললেন?’ সংলাপে, ডোরা কাটা হাফ শার্ট ও ধুতি কিংবা ধুতি-পাঞ্জাবির সুভদ্র পোশাকে, অথবা ওঁর অত তৈরি অভিনয় ও টাইমিং-এ।

কিন্তু ওঁর হাসি-বুলি-চাহনি, রাগ-অভিমান-নখরা, ক্যামেরার লেন্সকে নায়িকার চোখ হিসেবে চর্চা, আর প্রেমের সংলাপ এমন বাস্তবতা ও রিরংসায় বলতে পারা যে তা পর্দা পেরিয়ে হলের মেয়েদের আক্রমণ করে— এ সব সেই ‘শাপমোচন’, ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘সবার উপরে’, ‘সাগরিকা’-র সময় থেকেই বাঙালি মেয়েদের কাবু করে দিয়েছিল।

সেক্স অ্যাপিল কী, মাথামুণ্ডু না জেনেও তারা এক অপরূপ যৌনতায় লিপ্ত হয়েছিল উত্তমের সঙ্গে!

বিবাহিত মহিলার মধ্যেও ওঁর সঙ্গে এক অদৃশ্য, নিঝঝুম, অন্তরঙ্গ, পবিত্র পরকীয়া!

মহিলাদের এই শেষের ব্যাপারটার আমি এক জীবন্ত সাক্ষী। বাঙালি বাড়ির কোনও মেয়েই যখন চাকরি করে না, তখন ওদের দুপুরের সঙ্গী ম্যাটিনি শো-এর একজনই ম্যাটিনি আইডল— উত্তম। যাঁর ছবির ম্যাটিনি শো-এর অ্যাডভান্স টিকিট কেটে আনা ছিল আমাদের মতো বাড়ন্ত ছেলেদের পকেট মানির সুযোগ।

উত্তমের ছবির ফার্স্ট উইকের টিকিট হাতে পেলে মেয়ে-বউদের কী যে হত! কী শাড়ি, কী ব্লাউজ, কী ফ্রক, কী রুজ— এই নিয়েই চুল ছেঁড়াছেঁড়ি, হুড়ুমদুড়ুম চলল দু’দিন, যেন স্বয়ং উত্তমের সঙ্গেই ডেটে যাওয়া হবে।

ছবি দেখে বেরোবার মুখে তাদের কিনতেই হবে ছবির ছ’আনা দামের গানের বই। যা বাড়ি এনে সন্ধ্যা কী গীতার গানগুলো মক্‌শো করতে হবে গোধূলি বেলায় ছাদে বা দুপুরে চান-ঘরে গাওয়ার জন্য।

এই সব গান তাদের বর বা বাবারা শুনতে পেতেন না। সন্ধেকালে তাঁদের জন্য বরাদ্দ ছিল হার্মোনিয়াম বাজিয়ে ‘জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণাধারায় এসো’ কিংবা ‘অরুণকান্তি কে গো যোগী ভিখারী’, যা শুনে তাঁদের কর্তারা বা বাড়ির মাথারা ‘বেড়ে হচ্ছে’ ‘বেড়ে হচ্ছে’ করে যেতেন।

বাঙালি মেয়েদের সঙ্গে উত্তমের এই পরকীয়াকে বাঙালি ছেলেরা বিশেষ পাত্তা দেয়নি গোড়ায়। তার প্রথম কারণ ওই লোকটার সঙ্গে লেগে পারা যাবে না। দ্বিতীয় কারণ ছেলেরাও একটা সময় পটতে শুরু করল।

ছেলেদের উত্তমে পটার এক এপিডেমিক ছড়ায় সাতান্ন-আটান্ন সাল থেকে। ইউ ছাঁট, হাফ হাতা তো ছিলই, ক্রমে যোগ হাতাওয়ালা বোতাম দেওয়া শঙ্খপদ্ম গেঞ্জি, কোহিনূর পাঞ্জাবি, বাহারি স্যান্ডেল, ঠোঁটে সিগারেট ঝুলিয়ে কথা বলা এবং রিং করে ধোঁয়া ছাড়া।

তাতে করে সব পাড়াতেই প্রায় এক-আধ ডজন উত্তম পয়দা হয়ে যায়!

পাড়ার উত্তমদের প্রতি অবশ্য কোনওই প্রশ্রয় ছিল না পাড়ার সুচিত্রাদের।

কারণ উত্তম উত্তমই, যাঁর চলা, বলা, হাসা, কাঁদা, গান করা, সব মিলিয়েই একটা কমপ্লিট প্যাকেজ।

কে আর জানতে চাইছে যে, ওঁর লিপের গানগুলো সব হেমন্ত মুখুজ্জের?

যে-জন্য আমাদের পাড়ার উত্তমরা সন্ধেবেলায় বান্ধবী নিয়ে পার্কে বসলে হেমন্তকণ্ঠী বন্ধু জয়ন্তকে অদূরে ছপ্পরে বসিয়ে রাখত। টাইম টু টাইম প্লে-ব্যাক করে ওদের ডায়ালগ আর মুড জমিয়ে দেবে বলে।

বিনিময়ে নেপথ্য শিল্পীর প্রাপ্য ছিল কয়েক কাপ চা ও চিনেবাদাম।

এত শত দেখেশুনেও কেন যে এক সহপাঠিনীর মুখে উত্তমের SA-র কথা শুনে চমকে ছিলাম, তা আজও মাথায় খেলে না।

যে-উত্তম এত সরাসরি মেয়েদের বুকে বেজে ওঠেন, ধাক্কা দেন, তিনি আমাদের এত ভুলিয়ে ভালিয়েও শেষ অবধি বাসা বাঁধেন কেন মগজে?

আমরা ভুলি ওঁর ট্যালেন্টে, চেহারায়। শ্মশ্রুগুম্ফহীন, সারা শরীরে প্রায় লোমহীন, সুপ্রসাধিত যে-উত্তমকে আজকের বর্ণনায় বলে হবে ‘মেট্রোসেক্সুয়াল’।

মেয়েরা কিন্তু ওই চেহারায়ও অতীত এক সত্তাকে খুঁজে নেয়। যিনি ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’-এ চাকর সাজুন, চাই ‘লাল পাথর’ বা ‘স্ত্রী’ ছবিতে হিংস্র স্বামী— শেষ অবধি যাঁর কামের কামড়, চোখের আগুন, রাগের চাবুক তাদের রাগমোচন ঘটায়।

‘সেক্স অ্যাপিল’ ব্যাপারটার ভাব সম্প্রসারণ করলে কত কী  আসবে জানি না (স্বয়ং ফ্রয়েডও জানতেন কি?), তবে কিছু মুখচ্ছবি আসবে নিশ্চয়ই— রুডলফ্ ভালেন্টিনা, মার্লন ব্রান্ডো, রিচার্ড বার্টন, হয়তো পিটার ও’টুল, হয়তো মার্চেলো মাস্ত্রোইয়ানি, অবশ্যই আমাদের দেশের উদয়শঙ্কর, রাজেশ খন্না। এবং হ্যাঁ, অতি অবশ্য, জনৈক অরুণ চট্টোপাধ্যায়, যিনি অবলীলায় হারিয়ে আছেন এক ভাবমূর্তির আড়ালে, যাকে লোকে ডাকে উত্তমকুমার।



উত্তমকুমারের ছবির তালিকায় চোখ বুলোলে আরেকটা ব্যাপার ঝকঝকে পরিষ্কার হয়ে যায়।

কত বিচিত্র সামাজিক ভূমিকায় তিনি নেমেছেন। এবং চরিত্রগুলোকে বাঁচিয়ে তুলেছেন। এই সব মিলিয়ে তিনি নিজেও এক সোশ্যাল প্যাকেজ। টমাস মোর-কে নিয়ে রবার্ট বোল্ট-এর নাটকের নাম ধার করে বলতে ‘আ ম্যান ফর অল সিজনস’, রোদ জলে সমান কাজের।

তেরো থেকে তিরাশি বাঙালি মেয়েরা এই মানুষের টানে না পড়ে পারে?

‘লাইমলাইট’ ছবিটা প্রথম দেখে (যদিও এতে চ্যাপলিন তাঁর বিখ্যাত ভবঘুরে চরিত্রে নন) আমি ও ক’জন বন্ধু এক প্রবল প্রশ্নে এসে ঠেকেছিলাম, তা হল, দুনিয়ার সব বয়েসি মেয়েরা চার্লির ওই ট্র্যাম্প চরিত্রে পটে কেন?

সেই কোন সুদূর কাল থেকে আজ অবধি!

উত্তরটা পেতেও খুব দেরি হয়নি। যা হল: চরিত্রে যতই বিচিত্র হোক সেকালে ও একালে, মেয়েরা তো মেয়েই।

আর চার্লির ট্র্যাম্প হল, এক কথায়, এভরিম্যান। অর্থাৎ আমরা সবাই। যার হাসি-কান্না, জয়-পরাজয়, ক্ষুধা-তৃষ্ণা, দুষ্টুমি-ভালমানুষিতা, উদ্বেগ-নিরুদ্বেগ, সততা-ভণ্ডামি, পিরিত-নওছল্লা, লভ্ এবং ফ্লার্ট, সমস্ত পুরুষচরিত্র থেকে কাচিয়ে বার করা।

আমরা সবাই যা ছিলাম, আছি, হব। মেয়েরা যার মধ্যে তার সঠিক সঙ্গীটিকে অচিরে শনাক্ত করে।

উত্তমকুমার অবশ্যই ট্র্যাম্প বা এভরিম্যান নন। কিন্তু এপার বাংলা ওপার মিলিয়ে ওঁর একটা অপূর্ব ঐতিহাসিক-ভৌগোলিক পরিচয় আছে।

দেশভাগ থেকে নকশাল আন্দোলনের সময়কাল অবধি ধরলে উত্তমই সব বাঙালি।

ধনী, দরিদ্র, সরল, জটিল, ভাল, মন্দ, দূরের, কাছের, জয়ী, পরাস্ত, নায়ক, ভিলেন।

বাংলার মেয়েরা যেন ক্যালাইডোস্কোপ বা জাদুনল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ওঁর মধ্যে এই রং, ওই রং, সেই রং মিলিয়ে নিজের প্রিয় পুরুষটিকে গড়ে নিতে পারে।

উত্তমকুমার প্যাকেজটাকে সম্পূর্ণ করেছে ওঁর স্ক্রিন ইমেজ এবং ব্যক্তিগত জীবন।

পর্দায় তো বটেই, পর্দার বাইরেও এত মহিলাসঙ্গ সত্ত্বেও জীবনের শেষ অবধি স্ত্রী গৌরী দেবী ও ভবানীপুরের সংসারের প্রতি ওঁর আনুগত্য মেয়েদের অবাক করত।

শুধুই কি সংসার?
ময়রা স্ট্রিটে  সরস্বতী পুজোয় সুপ্রিয়াদেবীর  পাশে

পুরনো পাড়া, বন্ধুবান্ধব, আড্ডা, খাওয়াদাওয়া সব কিছুই শেষ অবধি ট্যাঁকে আঁটা।

যদি ভেতো বাঙালি বলেন তো তাই বলুন, চাইলে শেষ কলকেতে বাঙালি, কিন্তু না মেনে উপায় নেই যে উত্তমের এই বাবুমূর্তিটাই রবিঠাকুর, নেতাজির পর এক প্রধান বাঙালি ভাবমূর্তি। যাঁর ছবিতে বাঙালি মেয়েরা মালা পরায় না ঠিকই, কিন্তু মনে মনে পরায়।

উত্তমের ব্যক্তিত্বের যে-দিকটা মেয়েদের খুব টেনেছে সে-সময় তা হল ওঁর দিলখোলা, হাতখোলা স্বভাব। বাঙালি মেয়েরা চিরকালই কৃপণ পুরুষ অপছন্দ করে।

তখন উত্তমের স্বভাবের এই দিকটা জেনে মেয়েমহলে রীতিমতো তুফান বইত।

সুপ্রিয়ার সঙ্গে নায়কের বাসা বাঁধাতে যে-মেয়েরা এক সময় খাপ্পা হয়েছিল, তারাও নকল যুক্তিতে বলা ধরল, ‘‘তা যাক, দিলখোলা পুরুষ একটু কাছাখোলা, লাগামছাড়াও হয়।’’

ষাটের দশকের মেয়ে, মাসিদের এই কথার অদ্ভুত প্রতিধ্বনি শোনা গেল নায়কের মৃত্যুর ক’দিন পর আনন্দবাজারের তখনকার নামী সাংবাদিক সুদেব রায়চৌধুরীর এক মন্তব্যে।

পত্রিকার চিঠিপত্রের দপ্তর সামলাচ্ছিলাম আমি। উত্তমকুমারকে নিয়ে রোজ-রোজ আসা হাজার-হাজার চিঠির পাহাড়ে চাপা পড়েছিলাম পারতপক্ষে।

আমার সেই দশা দেখে সুদেববাবু ঘরের অন্য টেবিলে বসা শ্রীপান্থকে বললেন, ‘‘উত্তমকে নিয়ে লোকের এই পাগলামিটা কেন বলুন তো?’’

শ্রীপান্থ শুধোলেন, ‘‘কী মনে হয়?’’

সুদেব বললেন, ‘‘স্পট! চরিত্রের একটা স্পট।’’

শ্রীপান্থ ঠাট্টার সুরে বললেন, ‘‘সে তো বাঘের গায়ে অনেক স্পট থাকে।’’

সুদেব মাথা নাড়লেন, ‘‘ও স্পটে হবে না। নারীঘটিত হতে হবে। তবেই না আর সব মেয়েরা পাগল হবে। মেয়ে দেখিয়ে মেয়ে টানতে হবে।’’

সুদেববাবু যে খুব ভুল বলেছিলেন তা নয়। কারণ ওই চিঠির আয়লা ঝড়ে কত যে মহিলার চিঠি ছিল গোনা সম্ভব ছিল না।

তার কি‌ছু কিছু তো খোলা প্রেমপত্র, আর তার মধ্যে একটি পড়ে আমি ও শ্রীপান্থ দু’জনাই স্তম্ভিত।

কারণ চিঠিটি শেষ হয়েছে এমন একটি বাক্যে: ‘উত্তমের মৃত্যুতে আমি বিধবা হলাম।’



মেয়েরা কী ভাবে উত্তমকে দেখে তার এক নিপুণ পর্যবেক্ষণ আছে আলোক-চিত্রশিল্পী নিমাই ঘোষের এক মন্তব্যে।

বলেছিলেন, ‘‘জানেন তো, ক্যামেরার লেন্স ওঁর কাছে যেন আয়না। যে-কোনও আলোয়, যে-কোনও অ্যাঙ্গেলে, যে কোনও পরিস্থিতিতে এত সুন্দর ফুটে উঠতেন যা কহতব্য নয়। আর যদি হাসলেন তো নতুন একটা আলো খেলে গেল।’’

নিমাইবাবু সত্যজিৎ রায়ের লাখ খানেক ছবি তুলেছেন বলে ওঁর কথাটার একটা অন্য মূল্য আছে।

সত্যজিৎ জানতেন নিমাই ঘুরে ঘুরে ওঁর ছবি নিচ্ছেন, কিন্তু উনি ডুবে নিজের কাজে বা চিন্তাভাবনায়।

উত্তমকুমারও ব্যস্ত নিজের কাজে ও মুডে। কিন্তু মনের কোণে চিন্তাটা আছে যে ওঁর প্রেয়সী, ক্যামেরার লেন্স ওঁকে ফলো করে যাচ্ছে।

তাই হঠাৎ-হঠাৎ ক্যামেরার প্রতি ঘুরে এক ভুবনমোহিনী হাসি বা চিত্তহরা চাহনি।

অর্থাৎ ফোটোগ্রাফার নন, দৃশ্যের ডিসাইসিভ মোমেন্ট (অঁরি কার্তিয়ের ব্রেসঁ-র এই অপূর্ব কয়েনিংটার বাংলা করেছিলাম ‘উত্তম মুহূর্ত’) নির্ধারণ করছেন ছবির সাবজেক্ট উত্তমকুমারই!
সে দিন  দু’জনে



উত্তমকুমার ও ওঁর গানের গলা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মধ্যে সম্পর্কে ভাঙন ধরেছিল।

শেষ দিকে হব-হব করেও সেটা ঠিক করতে পারেনি।

হেমন্তদা আমাকে বলেছিলেন, ‘‘উত্তম চলে যেতে আমার গানের মুখটাই চলে গেল।’’

বাঙালি মেয়েরা এই মুখের প্রেমে বারবার টিকিট কেটে সিনেমা দেখেছে।

তার পর কলের গান, রেকর্ড প্লেয়ার কী রেডিয়োর সামনে সুচিত্রা, কাবেরী বা অরুন্ধতীর ভঙ্গি নকল করে বসে হেমন্ত, থুড়ি, উত্তম শুনেছে।

এ রকম একজন সাবেক-স্টাইল উত্তমগতপ্রাণা মহিলা ‘নায়ক’ দেখে এসে তাঁর পরিচিতের কাছে অনুযোগ করেছিলেন, ‘‘জানিস তো, ছবিটা দারুণ। কিন্তু হেমন্ত বা সন্ধ্যার গলায় একটাও গান নেই।’’

বহু দিন পর আমার কাছে বৃত্তান্তটা শুনে খুব হেসেছিলেন হেমন্ত।

আসলে বাঙালি মেয়েদের কাছে একটা সময় উত্তম বলতে মানে দাঁড়িয়েছিল, ‘কী গো, কেমন আছ?’- চাহনি (সাহেবরা একটু অসভ্য করে বলে কাম হিদর লুক), মজা করে বুক ঠুকে সরস কথা বলা। পুরুষত্ব জাহির করা কণ্ঠস্বর এবং আশ্চর্য গান লিপিং। তা সে হেমন্ত, মান্না, শ্যামল বা কিশোর যাঁরই গান হোক।



তরুণকুমার এক দিন গাড়িতে লম্বা রাস্তা যেতে যেতে বলছিলেন, ‘‘দাদার গানের লিপিং কী করে তৈরি হত জানেন, যে-গান পর্দায় গাইবে সেই গান চানের সময় শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে গেয়ে গেয়ে। হয়তো কোনও কাজের কথা বলতে ডাকলাম, ‘দাদা, শুনছ?’ কে শুনবে? সে গেয়েই যাচ্ছে।’’

উত্তমকুমার সুপ্রিয়াকে নিয়ে ময়রা স্ট্রিটে গিয়ে উঠতে যেমন ওঁর বঙ্গজোড়া অনুরাগিণীদের মধ্যে একটা চাঞ্চল্য ছাড়িয়েছিল, তেমনি আরেক বার এক ঝড় ওঠে আনন্দলোক-কে দেওয়া ওঁর এক সাক্ষাৎকারে।

সে-সময় ভারতীয় সিনেমায় চুম্বন দেখানো যাবে কি যাবে না, এই নিয়ে বিতর্ক চলছিল।

উত্তমকে জিজ্ঞেস করাতে উনি বলেছিলেন, ‘‘আমার কোনও আপত্তি নেই। তবে চুমুর আগে অভিনত্রীর দাঁতের মেডিকাল সার্টিফিকেট চাইব।’’

এ কথায় ওঁর নায়িকাদের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল জানি না, তবে মধ্যবিত্ত পাড়ার বাঙালি সুন্দরীদের মধ্যে কী আহ্লাদ।

আমার এক বন্ধুর বাড়িতে এ রকম একজনকে বলতে শুনলাম, ‘‘বেশ করেছে, চেয়েছে! আমাদের উত্তম যাকে-তাকে চুমু খাবে নাকি?’’

এই মেয়েটি, বলে রাখি, বেশ সুন্দরীই, এবং তনুজার মতো ওর সুন্দর দাঁতের পাটি বেশ ঝলমল করত।

ওর কথা শুনে উপস্থিত একজনকে বলতেই হল, ‘‘তা তুই কেন তোর দাঁতের সার্টিফিকেট পাঠিয়ে দিচ্ছিস না উত্তমকে?’’

তাতে কী সুন্দর ন্যাকা, আদুরে কণ্ঠ সে বলেছিল, ‘‘সে দেবার জন্য তো কত মেয়েই আছে সারা দেশে!’’

আজ মনে হয়, সত্তর দশকের সমস্ত বাঙালি মেয়ের মনের কথাটাই বলেছিল ও।

কে জানে, হয়তো আজকেরও!

হতাশারও এত মধুর সুর আগে বা পরে শুনিনি বিশেষ।

আমরা, পুরুষরা, শুধু আড়ে থেকে বলতে পারি, ‘‘গুরু! গুরু!’’


















«
Next
Newer Post
»
Previous
Older Post

No comments:

Leave a Reply