হ্যাঁ, সমরেশ বসুর এই কথাটাই আমাদের নতুন ছবি ‘ক্ষত’-র অন্তরের বার্তা। এটাই ট্যাগলাইন হতে পারে। বললেন, ‘ক্ষত’-র জনপ্রিয় সাহিত্যিক ‘নির্বেদ লাহিড়ি’ প্রসেনজিৎ। এ সপ্তাহেই মুক্তি পাচ্ছে কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের প্রাপ্তবয়স্ক ও প্রাপ্তমনস্কদের ছবি ‘ক্ষত’, যেখানে প্রসেনজিতের জুটি পাওলি দাম ও রাইমা সেন।
অলোকপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
২০১৬ সালটা প্রসেনজিতের। তাই এ বছরে অনেকবার আমরা প্রথাগতভাবে প্রসেনজিতের মুখোমুখি। গৌতম ঘোষের ‘শঙ্খচিল’-এর রেশ কাটতে না কাটতে শিবপ্রসাদ-নন্দিতার ‘প্রাক্তন’ তো ৫০ দিন পেরিয়ে এখনও রমরম করে চলছে। বহু আলোচিত ‘মহানায়ক’ ধারাবাহিকে এখন টেলিভিশনে রোজ প্রসেনজিৎ। এরই মাঝখানে, এই শুক্রবার মুক্তি পেতে চলেছে কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘ক্ষত’, যা ইতিমধ্যেই পেয়ে গেছে আসন্ন বিতর্কিত ছবির তকমা। কেউ বলছেন ইরোটিক থ্রিলার। কেউ বলছেন কঠোরভাবে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য। পাওলি দাম ও রাইমা সেন এই ছবিতে প্রসেনজিতের দুই জুটি। ‘ক্ষত’ মুক্তির আগে আর একবার আমাদের মুখোমুখি প্রসেনজিৎ।
• ‘শঙ্খচিল’ বহু আলোচিত। ‘প্রাক্তন’ তো এখনও সিনেমাহলে। পুজোয় আসছে সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘জুলফিকার’। তারই মধ্যে টেলিভিশনে রোজ ‘মহানায়ক’। এবার আসছে ‘ক্ষত’। বছরটা তো প্রসেনজিতের। সেই সময়ের কথা মনে পড়ছে, যখন স্বপন সাহা, হরনাথ চক্রবর্তীদের ১১টা ছবিতে এক বছরে প্রসেনজিৎকে পাওয়া গেছে।
•• (হাসতে হাসতে) সত্যিই বছরটা আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে সেই সময় যে সব ছবি করেছি, এখন আমার ছবির ধাঁচ একেবারে পাল্টে গেছে। আমি এখন বছরে ১১টা ছবি করার কথা ভাবি না। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পরিচালক, অন্যরকম চিত্রনাট্য এখনও আমাকে দারুণভাবে উদ্দীপ্ত করে।
• সেই সময়ের হিরো প্রসেনজিতের থেকে আজকের অভিনেতা প্রসেনজিতের খিদেটা কি বেশি?
•• সিনেমার খিদে, অভিনয়ের খিদে আমার কখনও কমেনি। সেজন্য ১৮ ঘণ্টা পরিশ্রম করতেও আমার এতটুকু ক্লান্তি নেই। এ বছর যাদের ছবি মুক্তি পাচ্ছে, তারা প্রত্যেকেই গুরুত্বপূর্ণ এবং নিজেদের মতো। গৌতমদার ‘শঙ্খচিল’ তো অন্য গভীরতার। গৌতমদাকে নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। শিবু-নন্দিতাদি দর্শকের ‘পাল্স’ বোঝেন। ‘প্রাক্তন’ তো ৫০ দিন পেরিয়েও সমানতালে চলছে।
• ‘প্রাক্তন’-এর সাফল্যের পেছনে ১৪ বছর বাদে ফিরে আসা প্রসেনজিৎ, ঋতুপর্ণা জুটিও তো বিরাট ভূমিকা নিয়েছে?
•• অবশ্যই। আমাদের দুজনকে নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে কাজ করতে চাইছিলেন অনেক পরিচালকই। কিন্তু আমার বা ঋতুর জন্যে ঠিকঠাক চরিত্রটা দিতে পেরেছে শিবু-নন্দিতাদি। আমাদের জুটির ফিরে আসা নিয়ে মিডিয়ার শুভেচ্ছা তো ছিলই, কিন্তু আমি মুগ্ধ দর্শকদের ভালবাসায়। তাঁরা যেভাবে আমাদের ভালবাসার সঙ্গে অ্যাকসেপ্ট করেছেন, আমি কৃতজ্ঞ দর্শকদের কাছে।
• ‘শঙ্খচিল’-এ দায়িত্ববান পিতা, ‘প্রাক্তন’-এ পাল্টে যাওয়া অনুগত স্বামী। কিন্তু আসন্ন ‘ক্ষত’ নিয়ে তো ইতিমধ্যেই চারিদিকে শোরগোল। অনেকেই বলছেন, ইরোটিক থ্রিলার। এখানে কি প্রসেনজিৎ দায়িত্ববানের ইমেজ বদলে দায়িত্বহীন স্বামী?
•• প্রথমত বলি, কেউ ‘ক্ষত’কে ইরোটিক থ্রিলার বলতেই পারেন। আমি বলব, প্রাপ্তবয়স্ক ও প্রাপ্তমনস্কদের ছবি ‘ক্ষত’। এবং এটাও বলতে পারি, এমন অ্যাডাল্ট ছবি বাংলায় হয়নি। ‘বিচারক’ বা ‘বাঘবন্দী খেলা’র মতো অ্যাডাল্ট ছবি অবশ্য হয়েছে। উত্তমজেঠুর অসাধারণ অভিনয় ‘বাঘবন্দী খেলা’য়।
• প্রসেনজিৎকে এমন একটা অ্যাডাল্ট ছবিতে দেখে ‘শঙ্খচিল’ বা ’প্রাক্তন’-এর দর্শকরা আহত হবেন না তো?
••‘বাঘবন্দী খেলা’য় উত্তমকুমার ভিলেনের চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করার পরেও তাঁর ইমেজে তো দাগ লাগেনি। আমি মনে করি, আজকের বাংলা ছবির দর্শক অনেক পরিণত। কেন অ্যাডাল্ট ছবি আজকের দর্শকদের জন্যে তৈরি হবে না?
সময় তো অনেক পাল্টে গেছে। বিয়ে না করেও আজকের ছেলেমেয়েরা লিভ টুগেদার করছে, যা আগে আমরা ভাবতেও পারতাম না। বাংলা থিয়েটারে কিন্তু বহু বছর আগে ‘বারবধূ’ কিংবা ‘সম্রাট ও সুন্দরী’র মতো নাটক হয়েছে এবং দর্শকেরা দিনের পর দিন সেই নাটক দেখেছেন। ভালবেসেছেন। আমার ‘২২শে শ্রাবণ’ দেখার পরেও তো দর্শকরা ভালবেসেছেন আমাকে। কমলেশ্বর অত্যন্ত যত্ন করে পেইন্টিং-এর মতো তৈরি করেছে ‘ক্ষত’। প্রাপ্তবয়স্কদের ছবিতে যৌনতা থাকতেই পারে, কিন্তু কীভাবে সেটা রিপ্রেজেন্ট করা হচ্ছে, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।
• এখানে প্রসেনজিতের চরিত্র একজন লেখকের। নির্বেদ লাহিড়ি। এই নির্বেদ লাহিড়ির মধ্যে কি সমরেশ বসুর ছায়া আছে?
•• সেইভাবে বলব না। সমরেশ বসু বা বুদ্ধদেব গুহ নরনারীর সম্পর্ক নিয়ে অনেক অসাধারণ লেখা লিখেছেন। সেখানে যৌনতাও আছে। বাংলার পাঠক কিন্তু সেইসব লেখা সাদরে গ্রহণ করেছেন। তবে, নির্বেদ লাহিড়ির ব্যাপারে সমরেশ বসুর কথা আমার বহুবার মনে হয়েছে। ‘ক্ষত’ ছবিতে নির্বেদের লেখার ধরন পাল্টেছে সময়ের সঙ্গে। আমার একটা ডায়লগ আছে— আমি আজ যেটা লিখি, লোকে সেটা কাল করে। অর্থাৎ সময়ের থেকে অনেকটা এগিয়ে আছে নির্বেদ। তাই লোকে তাকে ভুল বোঝে। সম্পর্কের ক্ষেত্রেও সে নিজের ভেতরের ডাকেই সাড়া দেয়। তাই নিজের স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও সে অন্য এক নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়ায়, নিজের ভেতরের ডাকে, অন্তরের তাগিদে।
• এটা কি এক লেখকের দ্বৈত সত্তার উন্মোচন?
•• এটাই ঠিক কথা। দ্বৈত সত্তার উন্মোচন। দ্বৈত লেখক সত্তাও। সমরেশ বসুর মতো অসাধারণ লেখকেরও তো দ্বৈত সত্তা ছিল লেখক হিসেবে। একজন সমরেশ বসু, অন্যজন কালকূট। একদিকে তিনি কালকূট ছদ্মনামে লিখেছেন ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’, ‘কোথায় পাবো তারে’র মতো উপন্যাস, অন্যদিকে ‘প্রজাপতি’, ‘বিবর’-এর মতো উপন্যাস লিখেছেন সমরেশ বসু নামেই। সেই সময় ‘বিবর’, ‘প্রজাপতি’ নিয়ে অশ্লীলতার অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু সেই অভিযোগ তুলে থামানো যায়নি সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা ওই সব লেখাকে। পাঠক ঠিকই গ্রহণ করেছে ‘প্রজাপতি’কে, ‘বিবর’কে।
• মনে পড়ে যাচ্ছে, ‘বিবর’ উপন্যাসের উৎসর্গপত্রের জায়গায় সমরেশ বসু লিখেছিলেন ‘... আচ্ছা, আমরা যদি সবাই সত্যি কথা বলতে পারতাম...।’
•• অসাধারণ কথা। হ্যাঁ, সমরেশ বসুর এই কথাটাই আমাদের নতুন ছবি ‘ক্ষত’র অন্তরের বার্তা। এটাই ট্যাগলাইন হতে পারে ‘ক্ষত’র। আমরা তো সব সময় সত্যি কথা বলতে পারি না, সমাজের চাপে, সংস্কারের চাপে। বলতে পারি না ভালবাসার কথা। ‘ক্ষত’ সেই ভেতরের কথাকে উন্মোচন করেছে।
• এ ছবিতে নির্বেদ লাহিড়ি তথা প্রসেনজিতের দুই নারী— পাওলি দাম আর রাইমা সেন।
•• হ্যাঁ, রাইমা আমার স্ত্রীর ভূমিকায়। পাওলি আমার ভালবাসার মানুষ। পাওলি অর্থাৎ অন্তরাও কিন্তু বিবাহিতা। তবে, কমলেশ্বর চিত্রনাট্যকে এমনভাবে এগিয়ে নিয়ে গেছে, যে বিভ্রম হতে পারে অন্তরা (পাওলি) আসলে রক্তমাংসের, নাকি, নির্বেদ লাহিড়ির কল্পনা! এই ছবির গল্প কমলেশ্বর লিখেছিল বহুকাল আগে। ডাক্তারি ছেড়ে এসে এই গল্পটা নিয়েই প্রথম ছবি করতে চেয়েছিল কমলেশ্বর। তখন আমিই বারণ করেছিলাম। বলেছিলাম, আগে অন্য ছবি করো। তারপর ‘ক্ষত’। ‘মেঘে ঢাকা তারা’র মতো ম্যাচিওরড ছবি করার পর কমলেশ্বর যে ‘ক্ষত’ ছবি করার জন্যে যথার্থ পরিচালক, আজ আমার কোনও সন্দেহ নেই। আর, আমার আর পাওলির তথাকথিত ‘বোল্ড সিন’ নিয়ে যে সব আগাম কথাবার্তা হচ্ছে, ছবি দেখলে বোঝা যাবে সেই দৃশ্যগুলো পেইন্টিংয়ের মতো তৈরি করেছে কমলেশ্বর এবং সিনেমাটোগ্রাফার সৌমিক হালদার।
No comments: