রাজকাহিনী-তেও বিদ্যাকে চেয়েছিলাম
‘রাজকাহিনী’ ছবিতে বেগমজানের ভূমিকায় আমার প্রথম পছন্দ ছিল বিদ্যা বালন। আসলে যখন এই ছবির স্ক্রিপ্ট লেখা হয়, তখন ঠিক ছিল হিন্দি ও বাংলা ভাষায় তৈরি হবে এই ছবি। সেই সময়ে হিন্দি ও বাংলা দুই ক্ষেত্রেই প্রধান ভূমিকায় আমি ভেবেছিলাম বিদ্যা বালনের নাম। কিন্তু সেই সময়ে বিদ্যা ডেট দিতে পারেননি। পরে শুধু বাংলাতেই তৈরি হয় ‘রাজকাহিনী’ এবং সেখানে বিদ্যার বিকল্প হিসেবে চূড়ান্ত হন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, বললেন সৃজিত মুখোপাধ্যায়। বললেন, ‘রাজকাহিনী যাঁরা দেখেছেন প্রত্যেকেই লক্ষ্য করবেন বেগমজানের কস্টিউমটা ছিল উত্তর ভারতীয়র মতো। এই চরিত্রের মুখেও বসানো ছিল ভাঙা বাংলা। তার কারণও সেটাই।’ তারপরেই হাসতে হাসতে বলে উঠলেন, ‘এই যে কথাগুলো বললাম, তা খবরের কাগজে প্রকাশিত হলেই জানি ঋতুর (ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত) একটা অভিমানে ভরা ফোন আসবে। ঋতুও কিন্তু এই চরিত্রটায় ফাটিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু বিদ্যা— বিদ্যাই।’ বললেন, ‘আসলে বিদ্যার মুখের মধ্যে একটা সারপ্রাইজিং কিছু আছে। ওর গলার স্বর আর শরীরীভাষাও অসাধারণ। সত্যি কথা বলতে কী এই ধরনের একটা কঠিন চরিত্রের অভিনেত্রীর কথা ভাবতে গেলে প্রথমেই মনে আসে বিদ্যার কথা। মনে আসে রানী মুখার্জির কথাও। তবে সবসময়েই বিদ্যা আমার ফার্স্ট চয়েস।’
এই কথারই সুর ধরে বিদ্যাও জানালেন, ‘সৃজিতের তরফ থেকে অনেক আগেই প্রস্তাব এসেছিল ‘রাজকাহিনী’ ছবিতে বেগমজানের ভূমিকায় অভিনয় করার। কিন্তু সেই সময়ে একটা বাজে পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম। প্রচণ্ড শরীর খারাপ। একের পর এক ছবির প্রস্তাব ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছি। সেইভাবেই ছেড়ে দিতে হয়েছিল ‘রাজকাহিনী’–র প্রস্তাবও। পরে যখন ‘বেগমজান’-এর জন্য ফের সৃজিতের প্রস্তাব এল তখন আর রাজি হতে দেরি করিনি। এরকম একটা ছবির অংশ হতে পেরে আমি গর্বিত।’
প্রসঙ্গ সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের প্রথম হিন্দি ছবি ‘বেগমজান’। মহেশ ভাট ও মুকেশ ভাটের প্রযোজনায় এখন এই ছবির শুটিং চলছে বাংলা ও ঝাড়খণ্ডের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে। দুমকা থেকে কিছুটা দূরে পাতজোর গ্রামে। খুব ভোরেই অভিনয় শিল্পীরা বোলপুর থেকে চলে যাচ্ছেন শুটিং লোকেশনে, তারপর সারা দিন ধরে, কখনও দিন ও রাত ধরে চলছে শুটিং। বিদ্যা জানালেন, ‘খোলা জায়গায় সেট তৈরি করে শুটিং হবে জেনে প্রথমটা খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু এখানে এসে দেখলাম বেশ মজাই লাগছে। চারিদিকের দৃশ্য বেশ মনোরম। গরমটা বেশ আছে, মাঝে মাঝে বৃষ্টিও আসছে। তবে তার মধ্যেই অত্যন্ত ডিসিপ্লিনডভাবে শুটিং চালিয়ে যাচ্ছে সৃজিত ও তার টিম। এরকম একটা শুটিং ইউনিট এর আগে দেখিনি। এত দ্রুত শুটিং চালিয়ে যাওয়া বোধহয় শুধু এদের পক্ষেই সম্ভব।’ আবার সৃজিত বললেন, ‘বেশ কঠিন পরিস্থিতিতেই শুটিং চালাতে হচ্ছে। প্রথম বাধা আবহাওয়া। যখন–তখন বৃষ্টি নামা। কয়েকদিন আগেই প্রচণ্ড ঝড়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল প্রায় ৯০০০ বর্গফুট জুড়ে তৈরি কোঠাবাড়ির সেট। কোনওরকমে তা সারিয়ে শুটিং শুরু করতে হয়েছে। যখন বৃষ্টি আসছে, তখন চটজলদি সেই বৃষ্টিকেই কাজে লাগিয়ে অন্য কোনও দৃশ্যের শুটিং করে নিতে হচ্ছে। সময় নষ্ট হলে বাড়তি সময় শুটিং করে মেক আপ করতে হচ্ছে। কারণ ছবির বাজেট অত্যন্ত কম। অন্তত হিন্দি ছবির তুলনায়। এই বাজেটের চোখ রাঙানিটা আমার ছবিতে সবসময়েই থেকে গেল।’
শুধু বিদ্যাই নন, এই ছবিতে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অভিনয় করছেন নাসিরুদ্দিন শাহর মতো অভিনেতা। কেমন লাগছে তাঁর সঙ্গে শুটিং করতে? ‘নাসিরসাবের মতো একজন অভিনেতাকে পরিচালক হিসেবে নির্দেশ দেওয়া খুব কঠিন। কলজের জোর লাগে। ভয়টা সরাতে প্রথম দিনেই ওঁর সঙ্গে শুটিং ফেলেছিলাম। ওঁকে আলাদা করে কোনও ডিরেকশন দিইনি। আর ওঁর মতো একজন অভিনেতার অভিনয় সম্পর্কে কিছু বলা ধৃষ্টতা।’
২০১৫-তে মুক্তি পেয়েছিল সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ছবি ‘রাজকাহিনী’। দেশভাগের পরিপ্রেক্ষিতে এক কোঠাবাড়িতে আশ্রয় নেওয়া ১১ মহিলার জীবন ও সেই জীবনে তখনকার সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতির প্রভাব নিয়ে এই ছবি। ছবিতে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। সেই ছবিকেই এবার হিন্দিতে ‘বেগমজান’ নামে আনতে চলেছেন সৃজিত। তবে সৃজিত বললেন, ‘এই ছবি কিন্তু ‘রাজকাহিনী’–র রিমেক নয়। যখন মুম্বইতে আসি, সঞ্জয় লীলা বনশালি আমাকে বলেছিলেন, নিজের ছবির রিমেক কীভাবে করবে তুমি? আমি তো ‘বাজিরাও মস্তানি’–র রিমেক করার কথা কখনও কল্পনাতেও আনতে পারি না। ওঁকে যা বলেছিলাম, এখনও তাই বলছি। ‘বেগমজান’ সম্পূর্ণ নতুন ছবি। হয়ত কস্টিউমটা একই থাকছে, গল্পটা একই থাকছে কিন্তু পরিস্থিতিটা পাল্টাচ্ছে। আগে ছিল দুই বাংলার সীমানা ভাগের গল্প আর এখন তা হয়েছে দুই পাঞ্জাবের সীমানা ভাগের গল্প।’ বললেন, ‘এই ছবিতে কাশ্মীরি, গুজরাটি, পাঞ্জাবি, গাড়োয়ালি, নেপালি— সব জাতের চরিত্র এসে হাজির হচ্ছে। কোঠাবাড়ির বাসিন্দা মহিলাদের পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। যেটা বাংলা ছবিতে ছিল না। পাশাপাশি বাংলায় বলা লর্ড মাউন্টব্যাটনের অংশটুকু থাকছে না। যাবতীয় রাজনৈতিক কচকচানি ও তত্ত্ব কথা বাদ দেওয়া হচ্ছে। ছবির বদলে সেটা আসবে ভয়েস ওভারে।’
এই প্রথম সৃজিতের পরিচালনায় কাজ করছেন বিদ্যা বালন। কেমন লাগছে? ‘এক একজন এক একরকম। প্রদীপদা (সরকার) ছিলেন প্রচণ্ড খুঁতখুঁতে। এক একটা শট বারবার নিতেন। সুজয় (ঘোষ) একটু পাগলাটে। যখন–তখন শট ডিভিশন বদলে দেয়, শুটিং সিকোয়েন্স বদলে দেয়। ওর সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে কাজ করতে হয়। ঋভু (দাশগুপ্ত) আবার প্রচণ্ড ঠান্ডা মাথার। আর সৃজিত অত্যন্ত ফোকাসড। ঠিক কোন জিনিসটা চায় ও পরিষ্কারভাবে জানে। আর প্রচণ্ড ডিসিপ্লিনড। ওর পুরো টিমটাও তাই। এত দ্রুত শুটিং করে ফেলতে আর কাউকেও দেখিনি।’
আর সৃজিত? তিনি কী বলছেন অভিনেত্রী বিদ্যা সম্পর্কে? এর আগে ‘রাজকাহিনী’ ছবির শুটিংয়ের সময় সৃজিতের বকাবকির হাত থেকে রেহাই পাননি প্রায় কোনও অভিনেতা-অভিনেত্রীই। সৃজিত নিজের মুখেই বলেছিলেন সে কথা। এবার কিন্তু সৃজিত চুপ। বললেন, ‘আশ্চর্য রকম হোমটাস্ক বিদ্যার। চরিত্রটা বারবার পড়ে ও আগে একটা ছবি তৈরি করে নেয়। তারপর আমার সঙ্গে বসে আলোচনা করে ওর তৈরি ছবির ঝাপসা দিকগুলো পরিষ্কার করে নেয়। তারপর যখন সেটে আসে, একদম তৈরি। একটা শট একবারের বেশি নিতে হয় না।’
অন্যদিকে বিদ্যা জানালেন, ‘সৃজিত আমার প্রিয় পরিচালকদের অন্যতম। আমার লক্ষ্যই হল, একের পর এক দেশের সেরা পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করে নেওয়া। সত্যি কথা বলতে কী, ‘বেগমজান’ নিয়ে কথা বলার আগেই আমি ‘রাজকাহিনী’ দেখে নিয়েছিলাম। ঋতু (ঋতুপর্ণা), যিশু (সেনগুপ্ত), রজতাভ দত্ত, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, আবির চট্টোপাধ্যায় প্রত্যেকেই সুপার্ব। তবে এ ছাড়াও সৃজিতের ‘অটোগ্রাফ’ আর ‘জাতিস্মর’ দেখেছি। খুব ভাল লেগেছিল। তখন থেকেই সৃজিতের পরিচালনায় কাজ করার ইচ্ছে ছিল।’
আগেই বলা হয়েছে নিজের ‘রাজকাহিনী’ ছবিকেই নতুন করে তৈরি করছেন সৃজিত, হিন্দিতে যার নাম ‘বেগমজান’। বাংলায় যে চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, সেই চরিত্রেই এবার অভিনয় করছেন বিদ্যা বালন। সৃজিত জানিয়েছেন, এই চরিত্রে অভিনয়ের জন্য অনেকখানি মেদ ঝরিয়েছেন বিদ্যা। মেক আপেও তাঁর চেহারার অনেকটাই পরিবর্তন করা হবে। এ ছাড়াও প্রিয়াঙ্কা সরকার অভিনীত চরিত্রে অভিনয় করছেন রবিজা চৌহান, সোহিনী সরকার অভিনীত চরিত্রে অভিনয় করছেন ঋদ্ধিমা তেওয়ারি, সায়নী ঘোষ অভিনীত চরিত্রে আছেন ফ্লোরা সাইনি, সুদীপ্তা চক্রবর্তী অভিনীত চরিত্রে প্রিয়াঙ্কা শেঠিয়া, ঋদ্ধিমা ঘোষ অভিনীত চরিত্রে আছেন ‘কাঞ্চি’ ছবির নায়িকা মিষ্টি, লিলি চক্রবর্তী অভিনীত চরিত্রে আছেন ইলা অরুণ, জয়া আহসান অভিনীত চরিত্রে গওহর খান, পার্নো মিত্র অভিনীত চরিত্রে আছেন পল্লবী সারদা, আর আছেন পুনম রাজপুত। এ তো গেল মহিলা ব্রিগেডের কথা। পুরুষ ব্রিগেডে রজতাভ দত্ত অভিনীত ‘নবাব’-এর ভূমিকায় এবার আছেন নাসিরুদ্দিন শাহ, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় অভিনীত চরিত্রে আছেন আশিস বিদ্যার্থী, কৌশিক সেন অভিনীত চরিত্রে আছেন রজিত কাপুর, কাঞ্চন মল্লিক অভিনীত চরিত্রে রাজেশ শর্মা, যিশু অভিনীত চরিত্রে চাঙ্কি পান্ডে এবং আবির চট্টোপাধ্যায় অভিনীত চরিত্রে আছেন বিবেক মুশরান।
এই ছবি সম্পর্কে বলতে গিয়েই আরও একটা কথা জানিয়েছেন সৃজিত। বললেন, তাঁর আগামী ‘কাকাবাবু’ ছবি ‘পাহাড়চূড়ায় আতঙ্ক’ তৈরি হবে ৩ ডি–তে। এই ছবির শুটিং করতে করতেই সেই কাজও এগিয়ে রাখছেন তিনি। জানিয়েছেন, এই ‘কাকাবাবু’–ই হবে প্রথম বাংলা ৩ ডি ছবি। আগামী বছর মে মাসেই সুইৎজারল্যান্ডের আল্পস পাহাড়ে শুরু হয়ে যাবে এই ‘কাকাবাবু’ ছবির শুটিং।
No comments: