ডেন্টাল ক্যারিজ- সহজভাবে সহজ কথা
১. দাঁতে বা দাঁতের ফাঁকে খাবার জমতে পারে এমন জায়গা।
২. ক্যারিজ তৈরিকারী জীবাণু।
৩. রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেট বা চিনিজাতীয় খাবার
৪. বেশিদিন ধরে যদি উপরের তিনটা কারণ একইসঙ্গে চলতে থাকে।
আমাদের দাঁতে অনেক খাঁজ (Pits and Fissure) আছে, যেগুলোতে বেশি ক্যারিজ হয়। ক্যারিজ বেশি হয় দুই দাঁতের মাঝে। তবে সত্যি কথা হচ্ছে ডেন্টাল ক্যারিজ দাঁতের যে কোনো জায়গায় হতে পারে। ক্যারিজ বা দন্তক্ষয়ের শুরুতে তেমন কোনো লক্ষণ বোঝা যায় না। তবে গর্ত আস্তে আস্তে বড় হলে দাঁতে শিরশির করা, কিছু খেলে গর্তে ঢুকে যাওয়া ইত্যাদি হতে পারে।
একসময় দাঁতের গর্ত আরও বড় হয়। আর তা মজ্জার কাছাকাছি চলে যায়। ফলে মাঝেমধ্যে ব্যথা অনুভূত হতে পারে। তবে এই ব্যথাটা থেমে থেমে হয়। কান, মাথা ও চোখসহ ব্যথা করতে পারে। ডেন্টাল ক্যারিজের এই পর্যায় পর্যন্ত সাধারণ ফিলিং করেই ক্যারিজের পরিসমাপ্তি টানা যায়। এতে খরচও কম লাগে, সময়ও কম নষ্ট হয়। আর রোগীর কষ্টও কম হয়।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোগী এই সময় ব্যথানাশক ওষুধ খেয়ে কিছুদিন নিশ্চিন্তে জীবনযাপন করতে থাকেন। এরপরই শুরু হয় প্রচণ্ড ব্যথা। কোনো একদিন রাতে, যখন বাইরে গিয়ে ওষুধ কেনা প্রায় অসম্ভব তখনই এটা শুরু হয়। পরদিন সকালে ওষুধ খাওয়ার পর ব্যথা কমে। আর ঠিক বিকেলে আবার ব্যথা শুরু হয়। তখনই বেশিরভাগ রোগীর বোধোদয় হয়। তারা ডেন্টিস্টের কাছে যান। তবে অনেকেরই বোধোদয় হয় না। কেউ কেউ এই অবস্থায়ও অ্যান্টিবায়োটিক আর ব্যথার ওষুধ একসঙ্গে চালাতে থাকেন।
ইতিমধ্যে দাঁতের যতটুকু ক্ষতি হয়, সেখান থেকে দাঁতটি জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব না। তবে মৃতভাবে সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়। অর্থাৎ এই সময় রুট ক্যানেল চিকিৎসার মাধ্যমে রোগ উপশম করা যায়। যারা এই অবস্থাতেও ডাক্তারের কাছে যান না, তারা মাঝেমধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক আর ব্যথানাশক ওষুধ খান। এতে তীব্র ব্যথার অনুভূতি একসময় কমে গেলেও ডেন্টাল ক্যারিজ কিন্তু থেমে থাকে না। কিছুদিনের মধ্যে জীবাণুর সংক্রামণে দাঁতের মজ্জা পুরোপুরি পচে যায়। পচা অংশগুলো দাঁতের গোড়া দিয়ে হাঁড়ের মধ্যে চলে যায়। সেখানে পুঁজ তৈরি করে। এই অবস্থায় যে ব্যথাটা হয় তা কোনো ওষুধেই কমে না।
দেখা গেছে রোগীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই অবস্থাতেই ডেন্টিস্টের কাছে আসেন। এ ক্ষেত্রে অনেকের দাঁত রুট ক্যানেল চিকিৎসার মাধ্যমে সারিয়ে তোলা যায়। আর অনেকের দাঁত ফেলে দিতে হয়।
কেউ কেউ আছেন এই অবস্থাতেও ব্যথা সহ্য করতে থাকেন। ডেন্টিস্টের কাছে না আসার জন্য মনস্থির করেন। তাদের দাঁত আস্তে আস্তে মাড়ির সঙ্গে মিশে যায়। এ সময় মাঝেমধ্যে ব্যাথা হয়। তখন তারা আবার ফার্মেসি থেকে অ্যান্টিবায়োটিক খান।
এই পর্যায় থেকে দুই রকম ব্যাপার ঘটতে পারে:
১. ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সেলুলাইটিস, লাডউইগ্স অ্যান্জাইনা ইত্যাদি। লাডউইগ্স অ্যান্জাইনা হলে পুঁজ জমে রোগীর গলা ফুলে যায়। চিকিৎসা না করালে রোগী নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করতে পারে।
২. সিস্ট, টিউমার ও ক্যান্সার হয়ে যেতে পারে।
সামান্য দাঁতের ব্যথা থেকে কত কিছু হতে পারে। তাই দাঁত ব্যথা হলে সামান্য দেরি না করে তাড়াতাড়ি চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
অন্তত ৬ মাস পর পর দন্ত চিকিৎসকের কাছে গিয়ে দাঁত পরীক্ষা করানো উচিত। তাহলে দাঁতে যদি সামান্য কোনো সমস্যাও থাকে, সেগুলো নিমিষেই দূর করা সম্ভব হয়। আর ভবিষ্যতে দাঁতের বড় রকমের সমস্যায় পড়তে হয় না।
বাচ্চাদের ডেন্টাল ক্যারিজ
ডেন্টাল ক্যারিজ (দাঁতের ক্ষয় রোগ) খুব সাধারণ একটি সমস্যা যা যে কোনো বয়সেই হতে পারে। ছোট বাচ্চাদের ডেন্টাল ক্যারিজ সাধারণত ২-৫ বছর বয়সে দেখা যায়। কারণ এই বয়সে বাচ্চারা চকলেট, মিষ্টি, চিপস ইত্যাদি খাবার বেশি খায় কিন্তু এগুলো খাওয়ার পর দাঁত পরিষ্কার করে না। বাচ্চাদের মাঝে সবসময়ই দাঁত না মাজার একটি প্রবণতা দেখা যায়। যার ফলে তারা নিজেরাও ব্রাশ করেনা, বাবা-মাকেও করতে দিতে চায় না।
২-৫ বছর বয়সী বাচ্চাদের দাঁতের ক্যারিজ হওয়ার আরও বড় একটা কারণ হচ্ছে এ বয়সে অনেক বাচ্চা ঘুমের মধ্যে ফিডার খায়। আবার অনেক বাবা মা আছেন যারা বাচ্চাকে ঘুমের মধ্যে ফিডার খাওয়াতে পছন্দ করেন কারণ জেগে থাকলে বাচ্চা খেতে চায় না। এই ঘুমের মধ্যে খাবার খাওয়ার অভ্যাস বাচ্চাদের ডেন্টাল ক্যারিজ হওয়ার সম্ভাবনা ৯০শতাংশ বাড়িয়ে দেয়।
বাচ্চাদের ডেন্টাল ক্যারিজ অনেক বাবা মা গুরুত্ব দেন না, তারা মনে করেন এই দাঁত তো দুধ দাঁত; কিছুদিন পর পড়ে যাবে, এর পর আবার নতুন দাঁত উঠবে। কিন্ত এই দুধ দাঁতের যদি ঠিক মত যত্ন না নেওয়া হয়, সমস্যা হলে চিকিৎসা না করা হয়, তাহলে ভবিষ্যতে তার যে স্থায়ী দাঁত উঠবে তার অনেক সমস্যা হতে পারে। যেমন, কারো দুধ দাঁত ক্যারিজ থাকায় সময়ের আগেই পড়ে গেলে বা ফেলে দেয়া হলে স্থায়ী দাঁত আঁকাবাঁকা বা উঁচু নিচু হতে পারে, যা ভবিষ্যতে আরও অনেক সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
রোগ তো রোগই তা যে বয়সেই হোক না কেন। যে কোন রোগের ক্ষেত্রে যত তাড়াতাড়ি চিকিৎসা করা যায়, তত দ্রুত রোগ ভাল হয়। তাই বাচ্চাদের ডেন্টাল ক্যারিজ নিয়ে উদাসীন না থেকে অবশ্যই তাদের ক্যারিজের দ্রুত চিকিৎসা করা উচিৎ, যাতে ভবিষ্যতে তাদের দাঁতের সমস্যা কম হয়।
দুর্ঘটনা বা আঘাতে দাঁত পড়ে গেলে করণীয় কি?
যে কোন দুর্ঘটনায় আপনার দাঁত পড়ে গেলে এরকম চিন্তার কোন কারণ নেই যে "হায়! আমি একটা দাঁত হারালাম।" কেননা, সেই দাঁত খুব সহজেই আপনার মুখে পুন:স্থাপন করা যেতে পারে। আপনাকে শুধু কিছু কথা জেনে রাখতে হবে :-
১.দাঁত যেখানে পড়বে সেখান থেকে তুলে এনে ট্যাপকল বা পানির নিচে এনে দাঁতের উপরে থাকা আলগা ময়লা গুলো ধুয়ে ফেলতে হবে।
২.কিন্তু সাবধান। দাঁতের গোড়ার জায়গা স্পর্শ করা যাবে না। কারণ দাঁতের গোড়ায় কিছু বিশেষ ধরনের লিগামেন্ট থাকে যেগুলোকে পেরিওডন্টাল লিগামেন্ট বলে - এই লিগামেন্ট গুলো দাঁতকে তার কোটরে ধরে রাখতে সাহায্য করে, গোড়া এগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হলে দাঁতকে তার কোটওে পুনঃস্থাপিত করা সম্ভব নয়।
৩.এবার দাঁতকে দুধ অথবা স্যালাইন পানি অথবা ডাবের পানির মধ্যে করে অবশ্যই প্রথম ১ ঘন্টার মধ্যে নিকটস্থ ডেন্টিষ্ট এর শরণাপন্ন হতে হবে। এই সময়ের মধ্যে আনতে পারলে চিকিৎসা সফল হওয়ার নিশ্চয়তা অনেক গুন বেড়ে যায়।
৪.তবে প্রথম ১ ঘন্টার মধ্যে ডাক্তারের কাছে না পৌঁছাতে পারলেও চিকিৎসা আছে, ডাক্তারকে দাঁত পড়ে যাওয়ার সঠিক সময় সম্পর্কে অবহিত করতে হবে।
৫.ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী দাঁত পুনঃস্থাপনের দুই সপ্তাহের মধ্যে রুট ক্যানেল ট্রিটমেন্ট করে নিতে হবে। তবে ১০ - ১২ বছরের বচ্চাদেও ক্ষেত্রে এই ট্রিটমেন্ট না করলেও চলে, কারণ তাদের দাঁতগুলো গোড়া থেকে প্রচুর পরিমানে রক্ত সরবরাহ পায়, বড়দের ক্ষেত্রে সেটা বন্ধ হয়ে যায়।
উপরোক্ত নিয়মগুলো মনে রাখতে পারলে দুর্ঘটনায় আপনার পড়ে যাওয়া দাঁতটি আপনার মুখে পুনঃস্থাপিত হতে পাওে নির্বিঘ্নে; সেই দাঁত আপনার জন্য কাজ করে যাবে আরও বহুদিন।
শিশুর দাঁতের যত্ন
এক. কখন থেকে যত্ন নেওয়ার শুরু
দাঁত না ওঠার অর্থ এই নয় যে এগুলো ওখানে নেই। গর্ভকালীন দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক সময়ে দাঁত গঠিত হতে শুরু করে। জন্মের সময়ে শিশুর মাড়িতে ২০ প্রাইমারি দন্ত থাকে তার অনেকগুলো চোয়ালে পরিপূর্ণভাবে গজিয়ে যায়। সুতরাং প্রথম দন্ত কৌমুদী প্রস্ফুটনের আগে শিশুর দাঁতের পরিচর্যা করা উত্তম।
শিশুকে খাওয়ানোর পরে পরিচ্ছন্ন জলে পাতলা কাপড় ভিজিয়ে দাঁতের মাড়ি পরিষ্কার করা যায়। এতে ব্যাকটেরিয়া ওখানে জমাট বাঁধতে পারে না। আর যখনই কয়েকটা দাঁত মুকুলিত হবে তখনই দিনশেষে নরম টুথব্রাশ কিংবা গজ পিস দিয়ে তা পরিষ্কার রাখা যায়।
দুই. ফ্লুরাইড এবং জল
শিশুর দাঁতের সুস্বাস্থ্য রক্ষায় শুধু দৈনিক দাঁত ব্রাশ করাটাই যথেষ্ট। শিশুকে যে জলপান করানো হয় সে জলে যদি স্বাভাবিক মাত্রায় ফ্লুরাইড থাকে তবে তা শিশু দন্ত বিকাশে এবং দাঁতে ক্ষয়রোগ রোধে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।
তিন. শিশুর দাঁত বনাম জুস পান
যেন ‘জুস-ই জীবন’ অনেক বাচ্চার মধ্যে এরূপ তাড়না দেখা যায়। অনেক মা-বাবা, অভিভাবক এ নিয়ে তেমন গা করেন না। ফ্রুট জুইসের সুগার দাঁতের এনামেল খেয়ে নেয়, বিশেষত যেসব শিশু সারা দিন বা ঘুমোতে যাওয়ার আগে বোতলে, কাপে নিরবধি জুস পান করে চলেছে। গবেষণার তথ্য—শিশুর দাঁতে কেরিজ তৈরি হয় তখন যখন বেশি সময় ধরে জুস দাঁতের চারপাশে প্রবাহিত হয়। দুধভর্তি ফিডার ধরিয়ে যেসব মা বাচ্চাকে ঘুমিয়ে দেন সে ক্ষেত্রে এমন ফলাফল ঘটে।
সে কারণে শিশু বয়সে জুস ড্রিংকস ও অন্যান্য সুগার পানীয় নিয়ন্ত্রণে রেখে খাওয়ানো উচিত। কখনো বোতল বা ফিডার মুখে দিয়ে শিশুকে ঘুম পাড়ানোর কৌশল অবলম্বন না করা।
তৃতীয়ত শিশুর সঠিক দাঁতের যত্নে প্রথম বছর পুরোলে দন্তবিশেষজ্ঞের পরামর্শ চেয়ে নেওয়া।
No comments: