লিভার/যকৃৎ এর 12 টি ফিচপার সহ টিপস দেয়া হলো
লিভার সিরোসিস ক্যানসার নয়
লিভার সিরোসিস, আঁতকে ওঠার মতো একটি রোগের নাম। সিরোসিস শুনলেই যেন মনে আসে, এটি আরও ভয়াবহ রোগের নাম, ‘লিভার ক্যানসার’। সিরোসিস আর ক্যানসার সাধারণ মানুষের কাছে একটি অন্যটির সমার্থক। অথচ ব্যাপারটি কিন্তু ঠিক তা নয়।
সিরোসিস কী?
সিরোসিস লিভারের একটি ক্রনিক রোগ, যাতে লিভারের সাধারণ আর্কিটেকচার নষ্ট হয়ে যায়। ফলে লিভার হারায় তার স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা। অনেক ক্ষেত্রেই লিভার সিরোসিস থেকে লিভারে ক্যানসারও দেখা দিতে পারে। তবে এসব কোনো কিছুই হার্ট অ্যাটাক বা ব্রেন স্ট্রোকের মতো সহসা ঘটে না। সিরোসিসে আক্রান্ত রোগী বহু বছর পর্যন্ত কোনো রকম রোগের লক্ষণ ছাড়াই স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে। ব্যাপারটা অনেকটা এ রকম—ধরা যাক, আমাদের লিভারটা একটা আধুনিক অ্যাপার্টমেন্ট, যাতে সব আধুনিক সুযোগ-সুবিধাই বিদ্যমান। এই অ্যাপার্টমেন্টের একটি কল নষ্ট থাকতে পারে কিংবা নষ্ট থাকতে পারে পুরো পানির সাপ্লাই লাইন অথবা আরও বেশি কিছু। ঠিক একইভাবে সিরোসিসেও লিভারে সামান্য কোনো সমস্যা দেখা দিতে পারে, কিংবা সমস্যাটি হতে পারে অনেক বড় কিছু।
একটা পানির কল নষ্ট হলে যেমন অ্যাপার্টমেন্টের অধিবাসীদের কোনো সমস্যা হয় না, তেমনি কম্পেনসেটেড বা আর্লি সিরোসিসেও রোগাক্রান্ত ব্যক্তির কোনো অসুবিধা হয় না বললেই চলে। রোগের লক্ষণ আর কষ্টগুলো দেখা দেয় ডিকম্পেনসেটেড বা অ্যাডভান্সড সিরোসিসে, যখন ওই অ্যাপার্টমেন্টটির নষ্ট পানি সরবরাহ লাইনটির মতো লিভারেও বড় ধরনের গোলযোগ দেখা দেয়।
সিরোসিসের লক্ষণ কী?
আগেই যেমনটি বলেছি, কম্পেনসেটেড সিরোসিসে আক্রান্ত ব্যক্তির তেমন কোনো লক্ষণ থাকে না বললেই চলে। অনেক সময় রোগী দুর্বলতা, সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়া, দাঁতের মাঢ়ি বা নাক থেকে রক্ত পড়া, পেটের ডান পাশে ব্যথা, জ্বর জ্বর ভাব, ঘনঘন পেট খারাপ হওয়া ইত্যাদি সমস্যা অনুভব করতে পারে।
অ্যাডভান্সড সিরোসিসে চিত্রটি কিন্তু একদম বদলে যায়। এ সময় পায়ে-পেটে পানি আসে, জন্ডিস হয় এবং রোগী অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে। রক্তবমি ও পায়খানার সঙ্গে রক্ত যাওয়া, ফুসফুসে পানি আসা, কিডনি ফেইলিউর, শরীরের যেকোনো জায়গা থেকে আনকন্ট্রোলড ব্লিডিং ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। আর সবচেয়ে যা ভয়াবহ, তা হলো লিভারে দেখা দিতে পারে ক্যানসার।
সিরোসিস কেন হয়?
এ তালিকাটি অনেক বড় এবং দেশভেদে সিরোসিসের কারণগুলোও বিভিন্ন। ইউরোপ ও আমেরিকায় সিরোসিসের প্রধান কারণ অ্যালকোহল আর হেপাটাইটিস সি ভাইরাস। বাংলাদেশে প্রায় আড়াই হাজার রোগীর ওপর জরিপ চালিয়ে আমরা দেখতে পেয়েছি, এ দেশে লিভার সিরোসিসের প্রধান কারণ হেপাটাইটিস বি ভাইরাস, আর এর ঠিক পরেই রয়েছে ফ্যাটি লিভার। হেপাটাইটিস সি ভাইরাস ও অ্যালকোহলের স্থান বাংলাদেশে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস ও ফ্যাটি লিভারের অনেক পরে। ফ্যাটি লিভার নানা কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ডায়াবেটিস, ডিজলিপিডেমিয়া (রক্তে চর্বি বেশি থাকা), ওবেসিটি (মেদ-ভুঁড়ি), উচ্চরক্তচাপ আর হাইপোথাইরয়েডিজম ফ্যাটি লিভারের প্রধান কারণ। পাশ্চাত্যে পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায়, ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত প্রায় ৩০ শতাংশ রোগী পরে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়। এ দেশেও আমরা ফ্যাটি লিভারজনিত লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যানসারের রোগী পেয়ে থাকি। অতএব সাবধান।
সিরোসিস হলে কী করবেন?
সিরোসিসে আক্রান্ত যেকোনো ব্যক্তির উচিত, দ্রুত লিভার বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হয়ে চিকিত্সা নেওয়া ও নিয়মিত ফলোআপে থাকা। এতে দীর্ঘদিন ভালো থাকা যায়। পাশাপাশি সিরোসিসের কারণ শনাক্ত করে তার চিকিৎসা করা গেলে লিভারের খারাপের দিকে যাওয়ার ঝুঁকিও অনেক কমে যায়। লিভার সিরোসিস ও এর কারণগুলোর আধুনিকতম চিকিৎসা আজ এ দেশেই সম্ভব। দেশে তৈরি হচ্ছে অধিকাংশ ওষুধও।
এ দেশে যা নেই, তা হলো লিভার ট্রান্সপ্লান্টেশনের ব্যবস্থা। প্রতিবেশী দু-একটি দেশে এ সুযোগ থাকলেও তা খুব ব্যয়বহুল আর সংগত কারণেই আমাদের সিংহ ভাগ রোগীর সাধ্যের অতীত। তবে আশার কথা, এ দেশে রয়েছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লিভার ট্রান্সপ্লান্ট সার্জন ও হেপাটোলজিস্ট আর উদ্যমী বেসরকারি হাসপাতাল। সেদিন হয়তো আর বেশি দূরে নয়, যেদিন ল্যাবএইড স্পেশালাইড হাসপাতালেই অনেক সাশ্রয়ী মূল্যে এ দেশের প্রথম লিভার ট্রান্সপ্লান্টেশন সম্ভব হবে।
শেষ কথা
রাজনীতির মতো লিভার সিরোসিসেও শেষ কথা বলে কিছু নেই। প্রয়োজন প্রাথমিক পর্যায়ে সিরোসিসের রোগীকে শনাক্ত করে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা। যেহেতু আর্লি সিরোসিসে তেমন কোনো লক্ষণ থাকে না বললেই চলে, তাই রোগী আর চিকিৎসক উভয়ের সচেতনতাটা এ ক্ষেত্রে খুবই জরুরি।
এই হলো হেপাটাইটিস
বিশ্ব হেপাটাইটিস অ্যালায়েন্স ২০০৮ সালে যকৃতের রোগ নিয়ে যে উদ্যোগ নিয়েছিল এরই ধারাবাহিকতায় ২০১০ সালের ১৯ মে পালিত হচ্ছে তৃতীয় বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস। রোগীদের কল্যাণে রোগীবান্ধব এই উদ্যোগ হলো বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস। এই দিবস পালনের মূল লক্ষ্য হলো হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ সম্বন্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা। এ ছাড়া এ ব্যাপারে রাজনৈতিক সমর্থন আদায় করাও এ দিবসের উদ্দেশ্য।
বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবসের দীর্ঘ মেয়াদি উদ্দেশ্য হলো নতুন সংক্রমণ রোধ করা এবং হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’তে আক্রান্ত লোকদের স্বাস্থ্যের সুপরিণতি নিশ্চিত করা।
এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য বিশ্ব হেপাটাইটিস অ্যালায়েন্স বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের বিশেষজ্ঞ যাদের হেপাটাইটিস ও জনস্বাস্থ্য বিষয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অভিজ্ঞতা রয়েছে এদের মধ্যে কয়েকজনকে নিয়ে গঠন করেছে জনস্বাস্থ্য প্যানেল।
এই জনস্বাস্থ্য প্যানেল বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস অভিযান সম্বন্ধে তথ্য বিতরণ ও পরিচালনার ক্ষেত্রে উপদেষ্টা পরিষদ ও বিশেষজ্ঞ রেফারেন্স দল হিসেবে কাজ করবে।
বাংলাদেশে বারডেম হাসপাতালের হেপাটো-বিলিয়ারি-প্যানক্রিয়েটিক সার্জারি ও লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট সার্ভিসের প্রধান অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী এই প্যানেলের সদস্য হওয়ার বিরল সম্মান অর্জন করেছেন। ১২ সদস্যের এই প্যানেলে রয়েছেন নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ব্লুমবার্গের মতো বিজ্ঞানী। যিনি সংক্রামক রোগের উৎস ও সম্প্রচারের নতুন দিক বিশেষ করে হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস আবিষ্কারের জন্য ১৯৭৬ সালে পান নোবেল পুরস্কার।
হেপাটাইটিস বলতে সোজাভাবে বোঝায় যকৃতের প্রদাহ, নানা কারণে যা ঘটে থাকে। ক্রনিক (দীর্ঘস্থায়ী) হেপাটাইটিসের অন্যতম প্রধান কারণ হলো ভাইরাস সংক্রমণ।
এমন দুটি গুরুত্বপূর্ণ ভাইরাস হলো হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ যা একত্রে প্রতি বছরে পৃথিবীতে প্রায় ১০ লাখ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বজুড়ে এখন পাঁচ কোটি মানুষ ক্রনিক হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’তে আক্রান্ত এবং তিনজনের মধ্যে একজন এদের একটি বা উভয় ভাইরাসের সংক্রমণের মুখোমুখি হয়েছেন। হেপাটাইটিস ‘বি’ কার্যকরী টিকা দিয়ে প্রতিরোধ করা সম্ভব। সন্দেহ হলে পরীক্ষা করে জেনে নেওয়া ভালো।
দুটি ভাইরাসই নীরব ভাইরাস, তেমন কোনো উপসর্গ থাকে না অনেকের, কোনো জানান না দিয়ে এই ভাইরাস থেকে যায় শরীরে দীর্ঘদিন। চিকিৎসা না হলে দুই ধবনের ভাইরাস ঘটাতে পারে সিরোসিসের মতো লিভারের বড় অসুখ।
সিরোসিস হলে রক্তক্ষরণ, পেটের ভেতর তরল জমা (অ্যাসাইটিস), সংজ্ঞালোপ, লিভারের ক্যানসার, নিষ্ক্রিয় ও মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।
ক্রনিক হেপাটাইটিস ‘বি’ থাকলে সিরোসিস হওয়ার আগেই যকৃতের ক্যানসার ঘটে যেতে পারে।
কোনো সময় রোগনির্ণয় হয় খুব দেরিতে, এ জন্য একমাত্র বিকল্প হয় যকৃতের প্রতিস্থাপন (ট্রান্সপ্ল্যান্ট)। ঝুঁকি আছে মনে হলে তাই যত দ্রুত সম্ভব পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া ভালো। রোগ নির্ণয় হলে চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা কৌশল মেনে চলতে হবে।
হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস সংক্রমণকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বর্তমান দুনিয়ার বড় বড় রোগের অন্যতম হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সবচেয়ে সচরাচর ভাইরাল সংক্রমণ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমান ২০০ কোটি মানুষ হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসে সংক্রমিত এবং আনুমানিক সাড়ে তিন লাখ মানুষ ক্রনিক হেপাটাইটিস নিয়ে বেঁচে আছে—হেপাটাইটিস ‘বি’ সংক্রমিক হয়ে প্রতিবছর মারা যায় পাঁচ থেকে সাত লাখ মানুষ।
অত্যন্ত সংক্রমণক্ষম ভাইরাস হলো হেপাটাইটিস ‘বি’ এইচআইভি থেকে ৫০-১০০ গুণ বেশি সংক্রামক। দশজন পূর্ণবয়স্কদের মধ্যে নয়জনের ক্ষেত্রে তীব্র হেপাটাইটিস বি সংক্রমণ প্রথম ছয় মাসে এমনিতেই শরীর থেকে সরে যায়, কিন্তু ভাইরাস ক্রনিক হয়ে গেলে ক্রমে ক্রমে কারও কারও ক্ষেত্রে হতে পারে সিরোসিস।
সংক্রমিত লোকের দেহতরল যেমন রক্ত, বীর্য, ঘর্ম, অশ্রু এমনকি বুকের দুধেও থাকতে পারে হেপাটাইটিস ‘বি’। বেশির ভাগ লোকের থাকে না উপসর্গ।
তবে সংক্রমণরোধের জন্য রয়েছে টিকা। ঝুঁকি থাকতে পারে মনে হলে সত্বর টিকা নেওয়া উচিত। হেপাটাইটিস ‘সি’ ‘বি’ থেকে একটু ভিন্ন। এই ভাইরাস বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শরীরে থাকে ছয় মাসের বেশি, এরপর হয়ে যায় ক্রনিক। পাঁচজনের মধ্যে চারজনের হতে পারে ক্রনিক সংক্রমণ ১৫-৩০ বছরের মধ্যে সিরোসিস, ক্যানসারের মতো বড় অসুখ। বিশ্বজুড়ে প্রায় হেপাটাইটিস ‘সি’র ক্রনিক সংক্রমণে আক্রান্ত রয়েছে ১৭০ মিলিয়ন মানুষ।
দূষিত রক্তের সঙ্গে রক্তের সংস্পর্শে এ রোগ ছড়ায় হেপাটাইটিস বির মতোই। কোনো উপসর্গ ছাড়াই নীরবে থাকতে পারে এ রোগ।
হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস দূষিত দেহতরল যেমন রক্ত, বীর্য, এসবের সরাসরি সংস্পর্শে এবং হেপাটাইটিস ‘সি’ দূষিত রক্তের সংস্পর্শে ছড়ায়। সংক্রমণের প্রধান পথগুলো হলো।
স্ক্রিননাকরা রক্ত বা রক্ত উপজাত দ্রব্য ভরণ করলে (Unscৎeened / Blood Tৎansfusion) বড় ঝুঁকি। তাই রক্তভরণের আগে রক্তে কোনো দূষিত সংক্রমণ আছে কি না তা যাচাই করে নিতে হবে।
নিবীর্জন না করে যন্ত্রপাতি দ্বারা শল্যচিকিৎসা বা দাঁতের সার্জারি করলে।
শিশু জন্মের সময় সংক্রমিত মা থেকে শিশুতে।
ওষুধ ইনজেকশনের সুচ সিরিঞ্জ শেয়ার করলে।
রেজর, টুথব্রাশ শেয়ার করলে।
নিবীর্জন না করা যন্ত্র দিয়ে ট্যাটু করলে।
সংক্রমিত লোকের সঙ্গে অনিরাপদ যৌন মিলনে হেপাটাইসি ‘বি’ সংক্রমণ ঘটার সম্ভাবনা থাকে।
হেপাটাইটিস ‘বি’ সংক্রমণের/প্রতিরোধের শ্রেষ্ঠ উপায় হলো টিকা নেওয়া। হেপাটাইটিস সির কোনো টিকা এখনো নেই।
রোগ নির্ণয়
হেপাটাইটিস ‘বি’ নির্ণয়ের জন্য রক্তকে এইচবি সারফেস এন্টিজেনের জন্য টেস্ট করতে হয় (HBsAg)। HBs এন্টিজেন হলো ভাইরাসের একটি অংশ যা সংক্রমণের ৬-১২ সপ্তাহের মধ্যে রক্তে দেখা দেয়। টেস্ট পজিটিভ হলে হেপাটাইটিস বি পজিটিভ বোঝা গেল। এমন হলে চিকিৎসক আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবেন, হেপাটাইটিস ‘বি’ সংক্রমণটি নতুন না পুরাতন, শরীরের এটি ক্ষতি করেছে কি না, চিকিৎসা প্রয়োজন কি না। স্বাভাবিকভাবে যদি ভাইরাস শরীর থেকে সরে যায় তো হলো অথবা যদি টিকা দেওয়া থাকে, তাহলে রক্তে থাকবে হেপাটাইটিস ‘বি’ এন্টিবডি (anti-HBs)। ভাইরাসকে ধ্বংস করার জন্যই এদের সৃষ্টি। এন্টি HBs থাকলে ভালো, বোঝা গেল হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের ভবিষ্যৎ সংক্রমণ হলে শরীর পাবে সুরক্ষা। হেপাটাইটিস ‘সি’র জন্য প্রথমে চেক করা হবে এইচসিভি এন্টিবডি (anti-HCV) টেস্ট পজিটিভ হলে বোঝা গেল ভাইরাস অধুনা রয়েছে অথবা ভাইরাস ছিল সরে গেছে। হেপাটাইটিস ‘সি’ এন্টিবডিগুলোর রক্তে আবির্ভূত হতে সংক্রমণের পর সাত-নয় সপ্তাখানেক সময় লাগে। রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বেশ দুর্বল থাকলে এইসিডি এন্টিবডি হাজির হতে বেশ সময় লাগে, কখনো হাজির হয়ই না। প্রথম টেস্ট পজিটিভ হলে আরও টেস্ট করতে হয় যেমন এইসিভি আরএনএ। এটিও পজিটিভ হলে হেপাটাইটিস ‘সি’ রয়েছে বুঝতে হবে।
হেপাটাইটিস ‘বি’ বা ‘সি’ নির্ণয় হলে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা প্রয়োজন হয়। অগ্রসর হতে হবে সাহসের সঙ্গে। এ রোগ যাতে অন্যদের শরীরে না ছড়ায় তা খেয়াল করতে হবে। চিকিৎসা কী কী রয়েছে এ নিয়ে ভারতে হবে, নিজের ব্যবস্থাপনা কৌশলও বেছে নিতে হবে।
২০১০ সালে বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস অভিযান যে লক্ষ্য নিয়ে এগুচ্ছে সেগুলো হলো—
বিশ্বজুড়ে ভাইরাস হেপাটাইটিস সংক্রমণের যে বিস্তৃতি এটি যেন জনগণ, গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
ভাইরাস হেপাটাইটিসের বিশ্বজুড়ে নানা রোগীর যে রোগভোগের কাহিনি, প্রকৃত জীবনে একে মোকাবিলা করার কাহিনি সম্প্রচার।
২০১০ সালে বিশ্ব হেপাটাইটিস এলায়েন্সের নতুন অভিযান শুরু করল ‘এই হলো হেপাটাইটিস’—এই রোগে যারা ভুগছেন এমন রোগীরা তুলে ধরবেন জীবনকাহিনি…।
এর মধ্য দিয়ে কিছু কথা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করা হবে—
প্রতিরোধ। সুরক্ষা নিন—নতুন সংক্রমণ প্রতিরোধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ এর ঝুঁকিগুলো জানা ও চেনা।
রোগ নির্ণয়। টেস্ট করিয়ে নিন— হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ আছে কি না তা টেস্ট করা সহজ-সরল, ঝুঁকি আছে মনে হলে সত্বর, টেস্ট করিয়ে নিন।
সুরক্ষা। টিকা নিয়ে নিন। হেপাটাইটিস ‘বি’ সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য রয়েছে টিকা।
চিকিৎসা। চিকিৎসা নিন। অনেক ক্ষেত্রে ‘বি’ ‘সি’ সংক্রমণে চিকিৎসা হয় ফলপ্রসূ।
হেপাটাইটিস বি নিয়ে কথা
লিভারের প্রদাহকে হেপাটাইসিস বলা হয়। স্থান-কাল পাত্রভেদে বিভিন্ন হেপাটাইটিস হতে পারে। যেমন—ভাইরাস, মদ্যপান বিপাকে অসংগতি ইত্যাদি। বাংলাদেশে সাধারণত ‘এ, বি, সি ও ই’ ভাইরাস দ্বারা লিভারের হেপাটাইটিস হয়ে থাকে। জন্ডিস দেখা দিলে এ রোগটি ধরা যায়, যদিও নিশ্চিত হওয়ার জন্য রোগীর রক্তে ভাইরাসের নির্দিষ্ট এন্টিজেন বা এন্টিবডি উপস্থিত থাকা প্রয়োজন। হেপাটাইটিস জন্ডিস হিসেবে বা জন্ডিস ছাড়াও ধরা পড়তে পারে।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, সারা বিশ্বে ২০০ কোটি মানুষ হেপাটাইটিস-বি দ্বারা আক্রান্ত, যার মধ্যে ৩৫ কোটি লোক হেপাটাইটিস-বি সংক্রান্ত, দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভুগছে এবং প্রতিবছর এ সম্পর্কিত জটিলতায় ছয় লাখ লোক মারা যাচ্ছে। এই ভাইরাস এইডস ভাইরাসের সংক্রমণের ক্ষমতা ৫০ থেকে ১০০ গুণ বেশি। বাংলাদেশে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কত, এর জাতীয়ভিত্তিক পরিসংখ্যান না থাকলেও ব্যক্তিগতভাবে অনেক গবেষক এ সংক্রান্ত জরিপ চালিয়েছেন। গবেষক কর্তৃক নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর ওপর পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশের শিরায় নেশাগ্রস্তদের মধ্যে আট শতাংশ, পতিতাদের মধ্যে নয় দশমিক সাত শতাংশ, পেশাদার রক্তদাতাদের মধ্যে ২০ শতাংশ ও অপেশাদার রক্তদাতাদের মধ্যে পাঁচ দশমিক ছয় শতাংশ এ ভাইরাস বহন করছে।
হেপাটাইটিস-বি দ্বারা আক্রান্ত বেশির ভাগ রোগীর দেহে ভাইরাসটি বাহক হিসেবে সুপ্ত অবস্থায় থাকে। কোনো ধরনের উপসর্গ দেখা দেয় না বলে এ সংক্রান্ত জটিলতা দেখা না দিলে রোগীরা সাধারণত চিকিৎসকদের শরণাপন্ন হন না। এ সংক্রান্ত রোগের ব্যাপকতা নির্ভর করে জীবাণুটি কখন শরীরে প্রবেশ করেছিল এবং ব্যক্তিটির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কতটুকু। দেখা যাক, বাল্যকালে যেসব ব্যক্তি এ জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়, তাদের ক্ষেত্রে ৯০ শতাংশ লোকের পরবর্তীকালে এ ভাইরাসটি শরীরে দীর্ঘস্থায়ীভাবে বাসা বাঁধে। এ ধরনের রোগীর ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশের ক্ষেত্রে এক থেকে চার বছরের দীর্ঘস্থায়ী হেপাটাইটিস-বি রোগে আক্রান্ত হয় এবং এদের ২৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার প্রাক্কালে লিভার সিরোসিস বা ক্যানসারে মারা যায়। যেসব লোক প্রাপ্ত বয়সে হেপাটাইটিস-বি দ্বারা সংক্রমিত হয়, তাদের ৯০ শতাংশ লিভারের জন্ডিস হওয়ার পর ভালো হয়ে যায়। বাংলাদেশের অল্প বয়সেই হেপাটাইটিস-বি দ্বারা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি এবং অল্প বয়সে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত বেশির ভাগ ব্যক্তিরই জন্ডিসের মতো উপসর্গ থাকে না। ফলে হেপাটাইটিস-বি ও এর দীর্ঘ মেয়াদি জটিলতা নিয়ে রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে দিন দিন।
কীভাবে এ জীবাণু ছড়ায়
রক্ত ও রক্তজাত পদার্থ হেপাটাইটিস-বি এর বাহক। কোনো ব্যক্তির যদি হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস থাকে, তবে এই ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত রোগীর সঙ্গে যৌন সঙ্গম করলে, আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত গ্রহণ করলে, সংক্রমিত রোগীর ব্যবহার করা টুথব্রাশ, ব্লেজার বা ব্লেড ব্যবহার করলে, সংক্রমিত রোগীর কাছ থেকে সুস্থ ব্যক্তির দেহে এ জীবাণু ছড়াতে পারে। ঐতিহ্যগতভাবে সেলুনে ব্যবহূত ক্ষুর বিভিন্ন জনের ব্যবহারকালে হেপাটাইটিস-বি সংক্রমিত হতে পারে। গর্ভবতী মায়ের শরীরে হেপাটাইটিস-বি থাকলে প্রসবকালে নবজাতকের হেপাটাইটিস-বি হওয়ার আশঙ্কা বেশি। তবে সংক্রমিত রোগীর সঙ্গে করমর্দন করলে, হাঁচি দিলে, রোগীর পাশাপাশি বসলে এ ভাইরাস ছড়ায় না।
উপসর্গ
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস রোগীর দেহে বাহক হিসেবে সুপ্ত অবস্থায় থাকে। কোনো ধরনের উপসর্গ দেখা দেয় না বলে এ সংক্রান্ত জটিলতা দেখা না দিলে রোগীরা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন না। কিছু কিছু রোগী সর্দি, জ্বর, দুর্বলতা, খাবারে অরুচি, পেটে ব্যথা, পাতলা পায়খানা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে আসতে পারেন।
চিকিৎসা
ক্ষণস্থায়ীভাবে আক্রান্ত (Acute) রোগীর নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা দিতে হয় না। এ রোগীকে অন্যদের মতো স্বাভাবিক খাবার দিতে হয়। আমাদের মধ্যে একটি প্রচলিত ধারণা আছে, স্বল্প মেয়াদি জন্ডিস হলে রোগীকে আখের রস, গ্লুকোজ বেশি খাওয়াতে হবে। এ ধারণা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কারণ এতে রোগীর পেট ফাঁপা, বমি বমি ভাব ও বমি বেড়ে যায়।
দীর্ঘস্থায়ী হেপাটাইটিস-বি প্রদাহের জন্য কয়েকটি খাওয়ার ওষুধ ও ইনজেকশন আছে। তবে এ ওষুধগুলো কোন রোগীকে কত দিন দেওয়া যাবে, তা অবশ্যই পরিপাকতন্ত্র ও লিভার বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী নির্ধারিত হওয়া উচিত। কারণ এ ওষুধ সব রোগীর বেলায় সমানভাবে প্রযোজ্য নয় এবং ওষুধগুলোর কার্যকারিতা, ওষুধ-সংক্রান্ত জটিলতা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে। দীর্ঘস্থায়ীভাবে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে খাওয়ার ওষুধ বা ইনজেকশন দিয়ে চিকিৎসা করা যেতে পারে পরিপাকতন্ত্র বা লিভার বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী।
হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ওষুধ গ্রহণের সঙ্গে নিম্নবর্ণিত উপদেশগুলো পালন করা অত্যন্ত জরুরি
১. খাবার ও পানীয় দ্রব্য গ্রহণে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। খাবার ও পানীয়ের মাধ্যমে অন্য হেপাটাইটিস যেমন- হেপাটাইটিস-‘এ’ এবং হেপাটাইটিস-‘ই’ শরীরে সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। হেপাটাইটিস-বি’তে আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে সাধারণত এ সংক্রান্ত জটিলতা বেশি হয়।
২. পরিবারের অন্যান্য ঘনিষ্ঠজন যাদের সংস্পর্শে আসার সম্ভাবনা বেশি যেমন-স্বামী-স্ত্রী, ভাইবোন, মা-বাবার এইচবিএসএজ পরীক্ষা করে রিপোর্ট নেগেটিভ হলে টিকা নেওয়া উচিত এবং পজেটিভ হলে যথাযথ চিকিৎসার জন্য শিগগিরই পরিপাকতন্ত্র ও লিভার বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
৩. চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ সেবন করা উচিত নয়।
৪. অবশ্যই মদ্যপান ত্যাগ করা উচিত।
৫. পরিপাকতন্ত্র ও লিভার বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ বা ইনজেকশন ব্যবহার বন্ধ করা উচিত নয়।
প্রতিরোধ
আশার কথা, এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে ১৯৮২ সালে টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে। জন্মের পর পরই অন্যান্য টিকার সঙ্গে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের টিকা দিতে হবে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশেও সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) সঙ্গে হেপাটাইটিস-বি টিকা চালু হয়েছে। ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে হেপাটাইটিস-বি রোগীর সংখ্যা বেশি, তাই এইচবিএসএজ, নেগেটিভ সবারই হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের টিকা নেওয়া উচিত। এ রোগের সংক্রমণ রোধকল্পে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর আরও এগিয়ে আসা উচিত।
হেপাটাইটিস বি চিকিৎসায় দেশি চিকিৎসকদের সাফল্য
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেপাটোলজি বিভাগের কয়েকজন চিকিৎসক হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের চিকিৎসায় উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছেন। বিশ্বে এই প্রথমবারের মতো সম্পূর্ণ নতুন ধরনের ওষুধ ব্যবহার করে তাঁরা এই সাফল্য অর্জন করেন।
বিএসএমএমইউ-এর লিভার বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মামুন-আল-মাহতাব জানান, তাঁরা তাঁদের এই নতুন ওষুধটি প্রয়োগ করে ৬০ শতাংশরও বেশি রোগীর ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করেছেন। বর্তমানে এই চিকিৎসায় খরচ পড়বে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা। আর ভবিষ্যতে ওষুধটির বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হলে তা আরও কমে আসবে। অথচ বর্তমানে হেপাটাইটিস বি-র বিরুদ্ধে অন্য যে ইমিউন মডুলেটিং ওষুধটি আছে, সেই পেগাইলেটেড ইন্টারফেরন দিয়ে চিকিৎসা করতে খরচ পড়ে পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকা। ডা. স্বপ্নীল জানান, তাঁরা দেশি-বিদেশি কোনো ধরনের অনুদান ছাড়াই এ পর্যন্ত এসেছেন।
এ জন্য তিনি দুজন ব্যক্তির কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। যাঁরা এই ট্রায়ালে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছেন এবং সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন। তাঁদের একজন জাপান-প্রবাসী বাংলাদেশি লিভার বিশেষজ্ঞ শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর। যাঁর তত্ত্বাবধানে এই ট্রায়ালের সমস্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা জাপানে সম্পন্ন করা হয়। আর অন্যজন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভার বিভাগের অধ্যাপক সেলিমুর রহমান।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্তও এই ট্রায়ালের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তাঁর ইচ্ছাতেই আগামী দুই মাসের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ওষুধটির ফেজ-২/৩ ট্রায়াল আরম্ভ হতে যাচ্ছে। গবেষকেরা আশাবাদী যে আগামী দেড় বছরের মধ্যে ফেজ-২/৩ ট্রায়ার শেষে তাঁরা এই ওষুধটির পেটেন্ট ও এ দেশে রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করতে পারবেন। আর সেক্ষেত্রে এটিই হবে এ দেশে সর্বপ্রথম রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত প্রথম ওষুধ। এর ফলে এ দেশের হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত গরিব রোগীরা নামমাত্র মূল্যে চিকিৎসা-সুবিধা পাবেন।
লিভারের ক্যানসার
ক্যানসার মানেই আঁতকে ওঠা, আর লিভার হলে তো কথাই নেই। সত্যি বলতে কি, অন্যান্য ক্যানসারের তুলনায় বিশেষ করে, পুরুষদের মধ্যে লিভার ক্যানসারের প্রকোপ একটু বেশিই। শরীরে যতসব ক্যানসার হয়, তার মধ্যে লিভার ক্যানসারের স্থান পাঁচ নম্বরে। আর এ রোগের চিকিৎসা করা না হলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সময় পাওয়া যায় হাতেগোনা কয়েক মাস। এর মূল কারণ লিভার ক্যানসারে রেডিওথেরাপির কোনো ভূমিকা নেই, আর কেমোথেরাপির রেসপন্সও খুব একটা আশাপ্রদ নয়। তবে এতসব হতাশার গান গাওয়ার জন্য এই লেখা নয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় লিভার ক্যানসারের চিকিৎসায়ও অগ্রগতি হয়েছে। আর এ বিষয়ে আলোকপাতই এ লেখার প্রতিপাদ্য।
কেন হয়?
আমাদের দেশে লিভার ক্যানসারের প্রধান কারণ হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস। গবেষণায় আমরা দেখতে পেয়েছি, এ দেশে লিভার ক্যানসারে আক্রান্ত শতকরা প্রায় ৭০ জন রোগীই হেপাটাইটিসজনিত লিভার রোগে ভুগছে। এর পরই বীরদর্পে অবস্থান করছে যথাক্রমে হেপাটাইটিস-সি ভাইরাস ও ফ্যাটি লিভার। পাশাপাশি অ্যালকোহল, আর মাঝেমধ্যে অটোইমিউন হেপাটাইটিসের মতো অখ্যাত রোগগুলো তো রয়েছেই। হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসে ভুগছেন এমন শতকরা প্রায় পাঁচজন লোক লিভার ক্যানসারে আক্রান্ত। আর হেপাটাইটিস-সি ভাইরাস ও ফ্যাটি লিভারের ক্ষেত্রে এ সংখ্যাটি যথাক্রমে শতকরা ২০ ও ৩০ জন। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি, তবে আমরা শিশুদের মধ্যেও বিশেষ করে, হেপাটাইটিস-বিজনিত লিভার ক্যানসার খুঁজে পাই।
কেমোথেরাপির নতুন কী?
ফাইভ ফ্লুরোইউরাসিল, ডক্সোরুবিসিন আর টেমোক্সিফেনের মতো কেমোথেরাপির ওষুধগুলো দীর্ঘদিন ধরেই মন্দের ভালো হিসেবে লিভার ক্যানসারের চিকিৎসায় ব্যবহূত হয়ে আসছে। তবে আগেই যেমনটি বলেছি, এদের কার্যকরতা তেমন সুখপ্রদ নয়। বেশ কয়েক বছর ধরে বাজারে পাওয়া যাচ্ছে কেপসিটাবিন, আর সম্প্রতি এ তালিকায় যোগ হয়েছে সুরাফিনেব। এই নতুন ওষুধ দুটির সুবিধা হলো, এগুলো মুখে খেতে হয়, হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন হয় না বললেই চলে এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া খুবই কম আর কার্যকরতাও আগের ওষুধগুলোর তুলনায় বেশি।
তবে সমস্যাও আছে। আর তা হলো, এই প্রতিটি ওষুধের দাম খুব বেশি। পাশাপাশি সুরাফিনেব বাংলাদেশে সহজলভ্যও নয়।
আছে আরও ভালো কিছু
লিভার ক্যানসারের আশাব্যঞ্জক দুটো চিকিৎসাপদ্ধতি হচ্ছে রেডিওফ্রিকোয়েন্সি অ্যাবলেশন ও পারকিউটেনিয়াস অ্যালকোহল ইনজেকশন। এ দুটি পদ্ধতিতে বেসিকটা একই। উভয় ক্ষেত্রেই ক্যানসারকে দেহের বাইরে থেকে গাইডেড প্রবের মাধ্যমে পুড়িয়ে ছোট করে আনা হয়। এর মধ্যে রেডিওফ্রিকোয়েন্সি অ্যাবলেশনে আউটকাম পারকিউটেনিয়াস অ্যালকোহল ইনজেকশনের তুলনায় সামান্য ভালো হলেও এর সীমাবদ্ধতা অনেক গুণ বেশি।
প্রথমত, এটি সাত থেকে আট গুণ বেশি দামি, অর্থাৎ একবার রেডিওফ্রিকোয়েন্সি অ্যাবলেশনের খরচ দিয়ে সাত থেকে আটবার পারকিউটেনিয়াস অ্যালকোহল ইনজেকশন দেওয়া যেতে পারে। রেডিওফ্রিকোয়েন্সি অ্যাবলেশনের জন্য সিটিস্ক্যান গাইডেন্সের দরকার পড়ে, আর পারকিউটেনিয়াস অ্যালকোহল ইনজেকশনের জন্য সাধারণ আলট্রাসনোগ্রামই যথেষ্ট। পাশাপাশি রেডিওফ্রিকোয়েন্সি অ্যাবলেশনের জন্য যেসব বিশেষায়িত যন্ত্রপাতির প্রয়োজন পড়ে, তা খুবই দামি। আর এ দেশে তার চেয়েও বেশি দুর্লভ। এ সবকিছু বিবেচনায় সারা বিশ্বেই পারকিউটেনিয়াস অ্যালকোহল ইনজেকশন লিভার ক্যানসারের চিকিৎসায় একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় চিকিৎসাপদ্ধতি।
লিভার প্রতিস্থাপন: স্বপ্ন নয় সত্যি
টিউমারের সাইজ খুব বড় না হলে, আর রোগীর শারীরিক অবস্থা সব মিলিয়ে ভালো থাকলে অপারেশন করে টিউমার ফেলে দেওয়া লিভার ক্যানসারে খুবই কার্যকর। তবে যে চিকিৎসায় এ রোগ একেবারেই নির্মূল করে, বলা চলে, রোগীকে নতুন জীবন দেওয়া সম্ভব, তার নাম লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন। আমাদের প্রতিবেশী সিঙ্গাপুর ও ভারতে বহুদিন ধরেই সফলভাবে লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন হয়ে আসছে, অথচ এত দিন আমাদের কাছে তা ছিল অমাবস্যার চাঁদ। আর খরচের কারণে এ দেশের বেশির ভাগ রোগীর জন্যই এ চিকিৎসাটি ছিল তার চেয়েও দুষ্প্রাপ্য কিছু। তবে আশার কথা, অবস্থা আর বেশি দিন সে রকম থাকবে না। গ্রাউন্ড ওয়ার্ক আর কোলাবরেশন এখন অনেকটাই শেষ। আমরা এখন আশা করতেই পারি, এ বছরের মধ্যেই এ দেশে সুলভে সফল লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন সম্ভব হতে যাচ্ছে।
ইচবিএস এজি পজিটিভ যকৃতের সমস্যা
কেস হিস্ট্রি-১
শাহজাহান শিক্ষিত বেকার যুবক। চাচাতো ভাই মহীউদ্দিন সৌদি আরবে ১০ বছর ধরে চাকরি করছেন। মহীউদ্দিনের সহযোগিতায় সৌদি আরবে চাকরির জন্য ৭০ হাজার টাকা জমা দিয়েছেন তিনি। ভিসার জন্য স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে গিয়ে রক্তের পরীক্ষায় এইচবিএসএজি (HBs Ag) ধরা পড়ে। এ কি নতুন কোনো রোগ? শাহজাহান এইচবিএস নেগেটিভ করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। আবার রক্ত পরীক্ষা, কবিরাজের ওষুধ, পানি পড়া, তাবিজ-কবজ, আমের রস, যে যা বলছেন, তাই করছেন তিনি। কিন্তু না, এইচবিএস এজি কমছে না। হতাশ হয়ে ওঠেন এই ২৬ বছরের যুবক। ৭০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে মহাবিপদে পড়েন তিনি। কী করবেন বুঝতে পারেন না।
কেস হিস্ট্রি-২
তমাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। সহপাঠীদের সঙ্গে সন্ধানীতে রক্ত দিতে গিয়ে শনাক্ত হলো এইচবিএস পজিটিভ। তাই তাঁর রক্ত অন্য কারও জন্য সংগ্রহ করা হলো না। তমাল দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। হেপাটাইটিস-বি সম্পর্কে অল্প কিছু জানেন তিনি। কীভাবে তাঁর শরীরে এ জীবাণু প্রবেশ করল? কী করবেন, কোথায় যাবেন, কার সঙ্গে পরামর্শ করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না।
কেস হিস্ট্রি-৩
এহবুব সাহেবের ছোট মেয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। স্কুলের হেপাটাইটিস-বি টিকা গ্রহণ কর্মসূচির আওতায় মেয়েটির রক্ত পরীক্ষায় শনাক্ত হয় এইচবিএস এজি পজিটিভ।
যে কেস হিস্ট্রিগুলো বলা হলো, তার সম্মুখীন আমরা প্রতিনিয়তই হচ্ছি। এইচবিএস পজিটিভ বলতে কী বোঝায়, কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ, কী তার চিকিৎসা ইত্যাদি নিয়ে আজকের উপস্থাপন।
এইচবিএস এজি বলতে কী বুঝায়?
এইচবিএস এজি-এর অর্থ হলো হেপাটাইটিস-বি সারফেস এন্টিজেন যা হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের দেহ থেকে নিঃসৃত হয়। শুধু হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের মাধ্যমে সংক্রমিত হলেই রক্তের এইচবিএস এজি পরীক্ষা পজিটিভ হয়।
হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস কী?
যেভাবে শরীরে প্রবেশ করে
হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস প্রধানত রক্ত এবং বিভিন্ন দেহাংশের মাধ্যমে ছড়ায়। যেমন :
হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত রক্ত এবং রক্তের অন্যান্য উপাদান কোনো রোগী গ্রহণ করলে।
হেপাটাইটিস-বি আক্রান্ত রোগীর ব্যবহূত সুচ, সিরিঞ্জ, রেজার, ক্ষুর, ব্রাশ ইত্যাদি কোনো সুস্থ ব্যক্তি ব্যবহার করলে হেপাটাইটিস-বি সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে।
বিভিন্ন হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, দাঁতের চিকিৎসালয়, বিউটি পার্লার, সেলুনে ব্যবহূত যন্ত্রপাতি যথাযথভাবে জীবাণুমুক্ত করে ব্যবহার না করলে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা থাকে।
গর্ভবতী মা যদি হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে থাকে, তাহলে জন্মের সময় নবজাতকের হেপাটাইটিস-বি সংক্রমণের আশঙ্কা অনেক বেশি থাকে।
হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক থাকলে।
রোগের লক্ষণ ও গতি-প্রকৃতি
অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো লক্ষণ ছাড়াই রক্তের এইচবিএস এজি পজিটিভ পাওয়া যায়। সাধারণত বিদেশে চাকরির উদ্দেশ্যে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে গিয়ে, রক্তদানের উদ্দেশ্য স্ক্রিনের পরীক্ষা করতে গিয়ে বা হেপাটাইটিস-বি টিকা নেওয়ার আগে রক্ত পরীক্ষা করতে গিয়ে এইচবিএস এজি শনাক্ত হয়। কোনো উপসর্গ না থাকলেও হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস লিভারে মৃদু ইনফেকশন চালিয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে লিভারের ক্ষতি করতে থাকে। তখন বলা হয় ক্রনিক হেপাটাইটিস বা দীর্ঘস্থায়ী ইনফেকশন।
পরবর্তী সময়ে লিভার সিরোসিস এমনকি লিভার ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
চিকিৎসা
এইচবিএস পজিটিভ রোগীদের প্রধান জিজ্ঞাসা এটা কীভাবে নেগেটিভ করা যায়? কত দিন লাগবে নেগেটিভ হতে? এইচবিএস এজি নেগেটিভ হয় দুভাবে—চিকিৎসার মাধ্যমে এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার মাধ্যমে। সাধারণত শতকরা ৯০ ভাগ রোগী হেপাটাইটিস-বি দ্বারা সংক্রমিত হওয়ার পর (একিউট হেপাটাইটিস) সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করে, বাকি শতকরা ১০ ভাগ রোগী সময়ের সঙ্গে হেপাটাইটিস-বি নেগেটিভ হয়। ক্ষেত্রবিশেষে শতকরা পাঁচ ভাগ রোগী এইচবিএস পজিটিভ মুক্ত হতে পারে না নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার দ্বারা।
তাদের ক্ষেত্রে হেপাটাইটিস-বির চিকিৎসা দরকার। প্রচলিত চিকিৎসা দুই ধরনের, মুখে খাওয়ার ট্যাবলেট অথবা ইন্টারফেরন ইনজেকশন। শতকরা ৩০-৬০ জন রোগীর ক্ষেত্রে চিকিৎসার সফলতা দেখা যায়। চিকিৎসার প্রধান উদ্দেশ্য হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসটিকে নিষ্ক্রিয় রাখে যাতে লিভারের ক্ষয়ক্ষতি কম হয় এবং ভবিষ্যতে লিভার ক্যানসার বা সিরোসিসের ঝুঁকি হ্রাস করে।
সব হেপাটাইটিস-বি রোগীর ক্ষেত্রে চিকিৎসা এক রকম নয় এবং রোগীভেদে এর চিকিৎসার ধরন ও সময়কাল নিরূপণ করা হয়। চিকিৎসা শুরুর আগে রোগীর লিভারের কার্যকারিতা, হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের প্রকার ও সক্রিয়তা, রোগীর শরীরের অন্যান্য ভাইরাস (যেমন হেপাটাইটিস-সি) বা অন্য রোগ আছে কি না ইত্যাদি বিবেচনায় আনতে হয়। প্রথমত রোগীর আর্থিক অবস্থাও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ চিকিৎসা ব্যয়বহুল, যদিও কিছু কিছু ওষুধ আমাদের দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। এইচবিএস পজিটিভ রোগী যাদের চিকিৎসা শুরু করা যায় না, তাদের নিয়মিতভাবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
এ ছাড়া এইচবিএস এজি পজিটিভ রোগীর পরিবারের অন্য সদস্যদের রক্ত পরীক্ষা করে এইচবিএস এজি নেগেটিভ হলে হেপাটাইটিস-বি টিকা নিয়ে নেওয়া নিরাপদ। প্রসঙ্গত বলে রাখা দরকার, এইচবিএস এজি পজিটিভ হলে হেপাটাইটিস-বির টিকা কোনো উপকারে আসবে না।
প্রতিরোধের উপায়
আপনার সামাজিক সচেতনতাই হেপাটাইটিস-বির সংক্রমণ থেকে রক্ষা করবে। সাবধান হতে হবে—
সব সময় ডিসপোজেবল সুচ ও সিরিঞ্জ ব্যবহার করবেন
অন্য কোনো ব্যক্তির রক্ত শরীরে চিকিৎসার জন্য গ্রহণ করতে হলে সঠিকভাবে পরীক্ষা করে নেবেন। পেশাদার রক্ত দাতাদের রক্ত পরিহার করে চলবেন।
সেলুন বা বিউটি পার্লারে নাক-কান ফুটানোর ক্ষেত্রে, দাড়ি বা চুল কাটার সময় ব্যবহূত জিনিসপত্র সঠিকভাবে জীবাণুমুক্ত করা হচ্ছে কি না খেয়াল করবেন।
পরিবারে হেপাটাইটিস-বির রোগী থাকলে অন্যান্য সদস্যদের হেপাটাইটিস-বি ভ্যাকসিন নিতে হবে।
দাঁতের চিকিৎসায় বা দাঁত তোলার ক্ষেত্রে যন্ত্রপাতি যথাযথ জীবাণুমুক্ত করে ব্যবহার করছে কি না জেনে নেবেন।
ব্যক্তিগত টুথব্রাশ, রেজার, নেইল কাটার ইত্যাদি অন্যকে ব্যবহার করতে মানা করবেন।
অনিরাপদ যৌন সম্পর্ক এড়িয়ে চলতে হবে।
হেপাটাইটিস-বি পজিটিভ মায়ের শিশুদের ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী টিকা দিয়ে নিতে হবে।
জন্ডিস
ইমেইল প্রিন্ট পিডিএফ
সত্যিকার অর্থে জন্ডিস কোনো রোগ নয়, এটা রোগের একটা উপসর্গ। জন্ডিস সম্বন্ধে কম বেশী সবাই কিছু না কিছু জানে। এ রোগে চোখের সাদা অংশ, হাত-পা এর তালু, মুখমন্ডল থেকে শুরু করে সমস্ত শরীরই হলুদ বর্ণের হয়ে যেতে পারে। সেই সাথে দুর্বলতা, গা ম্যাজ ম্যাজ করা, বমি বমি ভাব, রুচিহীনতা, পায়খানার রঙ ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া, শরীর চুলকানো সহ নানা উপসর্গ থাকাটা জন্ডিস এর নিত্য সঙ্গী।
রক্তে বিলিরুবিন এর মাত্রা বেড়ে গেলে জন্ডিস হয়। রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার অনেকগুলো কারন আছে তাই জন্ডিস হবার কারনও অনেকগুলো। রক্তকণিকা অতিরিক্ত পরিমান ভেঙ্গে যাওয়া, পিত্তনালীতে পাথর/টিউমার/ক্রিমি বা অন্য কারনে বাধার সৃষ্টি হওয়া, যকৃত বা লিভারের জন্মগত কিছু ত্রুটি, লিভার প্রদাহ বা হেপাটাইটিস হওয়া সহ নানাবিধ কারনে রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে।
যেহেতু জন্ডিস রোগের কারণ অনেকগুলো তাই কারণ নির্ণয় ও রোগের অবস্থা জানার জন্য রোগীকে অনেকগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হয়। এর মধ্যে রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা ও ধরণ, লিভার এনজাইম, ভাইরাল মার্কার, প্রথমবিন টাইম থেকে শুরু করে আলট্রাসনোগ্রাম, সিটি স্ক্যান এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে বায়োপসি বা কোলাঞ্জিওগ্রাম ও করা লাগতে পারে।
এতোক্ষনে নিশ্চয়ই পাঠকের বোঝা হয়ে গেছে যে সব ধরনের জন্ডিস এর চিকিৎসা এক হবেনা, ঠিক তাই। ঠিক যে কারনে জন্ডিস হয়েছে তা নির্ণয় করে সেই কারনটির চিকিৎসা করাই হলো জন্ডিস চিকিৎসার মূল লক্ষ্য। যেমন কিছু কিছু প্রকৃতির জন্ডিস হলে তার কোনো চিকিৎসারই প্রয়োজন নেই (যেমন গিলবার্ট ডিজিজ), তেমনি কিছু জন্ডিস শুধু বিশ্রাম নিলেই ভালো হয়ে যায়, কিছু আবার কোনো চিকিৎসাতেই ভালো হয়না, তেমনি কিছু আছে অপারেশন করলে একদম পুরোপুরি ভালো হয়ে যায়। তাই নিজে নিজে বেশী করে পানি খাওয়া, আখের রস খাওয়া বা রোদে না গিয়ে বিশ্রাম নেয়া ইত্যাদি জাতীয় চিকিৎসা না নিয়ে সকলের উচিত চিকিৎসকের কাছ থেকে এ রোগের সঠিক কারণ ও প্রতিকার জেনে নেয়া। জন্ডিস এর অন্যতম কারন হেপাটাইটিস ‘এ’ এবং ‘বি’ এর টিকা নিয়ে এ রোগের হাত থেকে অতি সহজেই বাঁচা যায়, তাই চিকিৎসকের কাছ থেকে জেনে নেয়া উচিত আপনি এই টিকা নিতে পারবেন কিনা।
পিত্তনালিতে ক্রিমি
আমাদের দেশের প্রায় সব মানুষই কোনো না কোনো সময় কৃমি (Worm, helminthiasis) রোগে ভুগে থাকেন। এসব ক্রিমির মধ্যে গোল কৃমি (Round worm, Ascaris lumbricoides) অন্যতম। এই গোল কৃমি একসময় চলতে চলতে ক্ষুদ্রান্ত হয়ে পিত্তনালিতে প্রবেশ করতে পারে। এর ফলে আক্রান্ত মানুষের পেটের উপড়ের অংশে তীব্র ব্যথা হয় এবং মানুষটি সাথে সাথে অসুস্থ হয়ে পড়ে। এর ফলে একসময় পিত্তনালির সরু হয়ে যাওয়া, ঘা হয়ে পুঁজ হয়ে যাওয়া, যকৃত এবং পিত্তথলিতে পুঁজ জমে যাওয়া সহ নানা জটিল পরিস্থিতির আবির্ভাব ঘটতে পারে। তবে কৃমিটি যদি জীবিত অবস্থায় শুধু পিত্তনালির মুখে প্রবেশ করা অবস্থায় চিকিৎসকের স্মরনাপন্ন হওয়া যায় তাহলে তা কেবল অসুধ সেবনের মাধ্যমে পিত্তনালি থেকে বের করে দেয়া যায়।
এর পর যথারীতি রোগীকে কৃমিনাশক অসুধ খাইয়ে এই রোগের প্রকোপ থেকে বাঁচানো সম্ভব। তবে অসুধে কাজ না হলে ERCP করেও ক্রিমিটি বের করে নিয়ে আসা যায়। কৃমিটি যদি পিত্তনালিতে মারা গিয়ে থাকে বা আটকে যায় বা অন্য জটিল কোনো সমস্যার সৃষ্টি করে তাহলে রোগীর অপারেশন (Choledochotomy) লাগতে পারে। অপারেশন করে ক্রিমি বা এর সৃষ্ট জটিলতা সরিয়ে দিলে রোগী পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যায়। নিয়মিত ৬ মাস পরপর ক্রিমিনাশক খেলে এই রোগের হাত থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব।
পিত্তথলির মিউকোসিল
ইমেইল প্রিন্ট পিডিএফ
পিত্তথলিতে কোনো কারনে মিউকাস জমে যদি তা বিশাল বড় হয়ে যায় তাকে মিউকোসিল বলা হয়। সাধারনত পিত্তথলিতে পাথর হলে তার সরু অংশে যদি পাথরটি আটকে যায় তার ফলে এমন রোগ হতে পারে। এছাড়া পিত্তথলিতে টিউমার হলেও এমনটি হতে পারে। এর ফলে পিত্তথলিটি ফুলে এত বড় হয়ে যায় যে তা পেটের উপড়ের অংশে একটা চাকার মত দলা হয়ে দেখা দিতে পারে। এর ফলে রোগীর পেটে ব্যথা হতে পারে। মিউকোসিল এ ইনফেকশন হলে তা এমপায়েমায় পরিণত হতে পারে এবং তারে রোগীর তীব্র জ্বর সহ পেটে ব্যথা এবং দুর্বলতা, বমি বমি ভাব সহ অন্য উপসর্গ গুলোও দেখা যেতে পারে। এমন রোগ হলে রোগীকে অপারেশন করে পিত্তথলি ফেলে দিতে (Cholecystectomy) হয়। এই অপারেশনের পর রোগী পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যায়।
পিত্তথলির ক্যান্সার
পিত্তথলি বা গল ব্লাডার এ পাথর হলে তা অপারেশন করে ফেলে দেয়া হয় এবং অপারেশনের পরপর সাধারনত ঐ পিত্তথলিটির বায়োপসি পরীক্ষা করানো হয়। এ ক্ষেত্রে অনেক সময়ই দেখা যায় যে পাথর ভর্তি গলব্লাডার এ ক্যান্সার হয়ে গেছে। এমনিতে গলব্লাডারে ক্যান্সার হয়ে খুব বেশী রোগী যে ডাক্তার এর কাছে আসেন তা কিন্ত নয় বরং অন্যান্য ক্যান্সারের তুলনায় এই অঙ্গটির ক্যান্সার হবার হার তুলনামুলকভাবে অনেক কম। সাধারনত দীর্ঘ দিন ধরে যারা পিত্তথলির পাথরে ভুগেন বা যাদের পিত্তথলি ক্যালসিয়াম জমে শক্ত হয়ে যায় তাদের মাঝেই এই ক্যান্সার হবার প্রকোপ বেশী।
কারো যদি আগে থেকে পিত্তথলিতে পাথর থেকে থাকে এবং নতুন করে পেটের উপড়ের ডান দিকে তীব্র ব্যথা হয় এবং চাকার মতো একটা ফুলে উঠে বা সেই সাথে জন্ডিস শুরু হয় অনুমান করা হয় তাদের হয়তো পিত্তথলিতে ক্যান্সার এর প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। তবে সত্যিই যদি ক্যান্সার এর সাথে জন্ডিস থাকে তাহলে বোঝা যায় যে ক্যন্সারটি অনেক দূর এগিয়েছে।
রক্তে CA 19-9 নামক মারকার পাওয়া গেলে অনেক সময় অনুমান করা যায় যে গলব্লাডার এ ক্যান্সার হয়েছে। এমন অনুমান হলে গল ব্লাডার এর বায়োপসি তো করাতে হয়ই তার সাথে কোলাঞ্জিওগ্রাম, পেট ও বুক এর সিটি স্ক্যান, লিভার এর এনজিওগ্রাম সহ ল্যাপারোস্কপি করে দেখতে হয় রোগটা কতদুর ছড়িয়েছে। ক্যান্সার যদি শুধু পিত্তথলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে তাহলে রোগীর সেই ক্যান্সার নিয়ে বাড়তি ঝুকির সম্ভাবনা খুব কম, তবে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়লে রোগীর মৃত্যুর ঝুকি বেড়ে যেতে পারে। অনেক সময় লিভার এর ডান পাশের অর্ধেকটা ফেলে দিয়ে রোগীর ক্যান্সার নিরাময়ের চেষ্টা করা হয়ে থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই ক্যান্সার এ কেমোথেরাপিও ব্যবহার করা হয়। তবে পিত্তথলির ক্যান্সার এর সাথে যদি এর কারনে জন্ডিস এর প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায় সে ক্ষেত্রে এর পরিনতি ভয়াবহ বলেই ধরে নেয়া হয়।
পিত্তথলির পাথর
পিত্তথলিতে পাথর হওয়া আমাদের চারপাশের অতিপরিচিত রোগ গুলোর মধ্যে একটি, আত্মীয়স্বজনের কারো পিত্তথলিতে পাথর হয়নি বা এজন্য গলব্লাডার ফেলে দিতে হয়নি এমন লোক মনে হয় খুঁজে পাওয়া দুস্কর হবে। সত্যিই কি পাথর হয় না এগুলো অন্য কিছু। এসব কি সত্যিকারের পাথরের মতো, কিভাবে ওখানে গেলো ওসব এ জাতীয় নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খায় আমাদের মনে।
হ্যাঁ সত্যি সত্যিই পিত্তথলিতে পাথর হয়। কোলেস্টেরল, ক্যালসিয়াম, বিলিরুবিন ইত্যাদির সংমিশ্রনে যে পাথর গুলো পিত্তথলিতে হয় তা দেখতে অনেকটাই রাস্তার পাথরের মতো। এদের কোনোটি ময়লা সাদা, কোনোটি হাল্কা বাদামী আবার কোনোটি একদম কুচকুচে কালো বর্ণের হয়।
সাধারনত স্থুলাকায় মানুষের এই রোগ বেশী হতে দেখা যায়, মহিলাদের মাঝেও এই রোগ হবার প্রবনতা বেশী। যারা চর্বি জাতীয় খাবার বেশী খান ৪০ এর কাছাকাছি বয়সে তাদের এই রোগ হবার সম্ভাবনা বেশী এমন একটা শক্ত ধারনা খুব প্রচলিত। পিত্তথলিতে পাথর হলে এতে প্রদাহ বা কলিসিস্টাইটিস হয়। তখন পেটের উপরের দিকে ডান পাশে তীব্র ব্যথা হয় যাকে অনেকে দম বন্ধ হয়ে যাওয়া ব্যথা বলে থাকেন। এটা সাধারনত মিনিট খানেক স্থায়ী হয় তবে তা ঘণ্টা খানেক ও থাকতে পারে। ব্যথাটি পেটের পিছনের দিকে, কাধে, পেটের মাঝ বরাবর এবং বুকের ভেতরেও ছড়িয়ে পরতে পারে। সেই সাথে বমি বমি লাগা বা বমি করে ফেলা, হাল্কা জ্বর এই সব উপসর্গও থাকতে পারে।
কলিসিস্টাইটিস এর ব্যথা অত্যন্ত তীব্র এবং এমন ব্যথা হলে সাথে সাথে রোগীর হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যাওয়া উচিত। হেপাটোবিলিয়ারি সার্জন বা জেনারেল সার্জন উভয়েই এই রোগের বিশেষজ্ঞ সার্জন। তাদের তত্ত্বাবধানেই চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া উচিত। রোগটি নিশ্চিত করার জন্য প্রথমেই পেটের আল্ট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষাটি করে নিতে হয়, সেই সাথে কিছু রক্তের পরীক্ষা, ইসিজি, এক্সরে এই সব পরীক্ষা করে দেখতে হয় ব্যথার অন্য কোনো কারন আছে কিনা। এছাড়া ধরনের রোগীর খুব গ্যাসের সমস্যা থাকে দেখে অনেক সময় পাকস্থলীর এন্ডোসকোপি পরীক্ষা করে দেখতে হয় তাতে আলসার হয়েছে কিনা। পশ্চিমা দেশগুলোতে অনেক সময় এই রোগে কোলাঞ্জিওগ্রাম অথবা ই,আর,সি,পি পরীক্ষাটিও করিয়ে নেয়া হয়।
চিকিৎসার শুরুতে রোগীকে মুখের সবধরনের খাবার বন্ধ করে স্যালাইন দেয়া হয়, সেই সাথে ব্যথার অসুধ, গ্যাসের অসুধ এবং এন্টিবায়োটিকও দেয়া হয়। শতকরা ৯০ ভাগ রোগীই এই চিকিৎসায় সুস্থ বোধ করেন। এরপর চিকিৎসক সময় বুঝে রোগীকে অপারশন করে পিত্তথলি ফেলে দেবার (Cholecystectomy) পরামর্শ দেন। প্রায় সময়
নীরব ঘাতক হেপাটাইটিস বি ভাইরাস
হেপাটাইটিস বি এমন একটি ভইরাস যা বিশ্বব্যাপী মারাত্মক সংক্রামক রোগের জীবাণু হিসেবে পরিচিত। শিশুদের ব্যাপক হারে এ রোগে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে পৃথিবীতে প্রতি বছর ২ থেকে ৫ লাখ নবজাতক হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে জন্মগ্রহণ করে যারা ভবিষ্যতে এই রোগের বাহক হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মতে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৫ শতাংশ হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের দীর্ঘমেয়াদি বাহক এবং এদের ২০ শতাংশ লিভার ক্যান্সার ও সিরোসিসের কারণে মারা যেতে পারে। বাস্তবে হেপাটাইটিস-বি এইডসের চেয়ে ১০০ গুণ বেশি সংক্রামক এবং প্রতিবছর এইডসের কারণে পৃথিবীতে যত লোক মৃত্যুবরণ করে তার চেয়ে বেশি মৃত্যুবরণ করে হেপাটাইটিস-বি’র কারণে।
হেপাটাইটিস বি :
বিশ্বব্যাপী হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস একটি ভয়াবহ স্বাস্থ্য সমস্যা । হেপাটাইটিস বি এক ধরনের ভাইরাস যা মুলত লিভারকে আক্রমণ করে। এর সংক্রমণের ফলে পৃথিবীর অন্যতম ঘাতক ব্যাধি লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যান্সার হতে পারে। রক্ত ও রক্তজাত পদার্থ মূলত এই ভাইরাসের বাহক। প্রাথমিক পর্যায়ে এই ভাইরাসে আক্রান- রোগী সাধারণত কোনো লক্ষণ বহন করে না, অথচ এদের মাধ্যমে অন্যরা সংক্রমিত হতে পারে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে রক্তরস, লালা, বীর্য ও বুকের দুধ এক দেহ থেকে অন্য দেহে ভাইরাস বিস্তারে সহায়তা করে। সাধারণত আক্রান্ত মায়ের শিশু সন্তান, আক্রান্ত পরিবারের অন্যান্য সদস্য, বহুবার রক্ত গ্রহণকারী রোগী, মাদকাসক্ত ব্যক্তি, মানসিক অবসাদগ্রস্ত ব্যক্তি, স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান তথা হাসপাতালে কর্মরত ব্যক্তিবর্গ-যেমন চিকিৎসক, সেবিকা, ল্যাবরেটরিতে কর্মরত ব্যক্তি, দন্তরোগের চিকিৎসকেরা এই ভাইরাসে আক্রান- হতে পারে ।
হেপাটাইটিস বি এর ইতিহাস:
ইতিহাসে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে হিপোক্রেটিসের আমলে মহামারী হিসেবে জন্ডিসের কথা পাওয়া যায়। তবে ড. সাউল ক্রুগম্যান ১৯৫০ সালে একদল মানসিক রোগীর উপর গবেষণা চালিয়ে প্রথম এ ভাইরাসটি শনাক্ত করেন । তার দেয়া তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে পরবর্তীতে ড. ব্লুমবার্গ হেপাটাইটিস বি ভ্যাক্সিন তৈরি করেন। বর্তমানে ড. ব্লুমবার্গ এর তৈরিকৃত ভ্যাক্সিন এর পরিবর্তে রিকমবিন্যান্ট ভ্যাক্সিন ব্যবহার করা হয়।
হেপাটাইটিস বি’তে আক্রান- হওয়ার ঝুকি:
অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের অধিবাসী যেমন সাব সাহারা আফ্রিকা, এশিয়ার অধিকাংশ, প্রশান- মহাসাগরীয় অঞ্চলের অধিবাসী ও আলাস্কার আদি অধিবাসীদের মধ্যে হেপাটাইটিস বি রোগের প্রকোপ অন্যদের তুলনায় অধিক।হেপাটাইটিস বি’তে আক্রান্ত হওয়ার ঝুকি তাদের বেশী
যারা রক্তক্ষরন ও অন্যান্য কারণে সৃষ্ট রক্তশূন্যতার চিকিৎসায় বারবার ব্লাড ট্রান্সফিউশন করেন ।।
সমকামী পুরুষদের মধ্যে যৌন মিলনের ফলে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে সংক্রমিত নারী-পুরুষের মধ্যে একাধিক নারী-পুরুষের সঙ্গে যৌন মিলন।
ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক দ্রব্য সেবন।
একই নিডল ও সিরিঞ্জের মাধ্যমে একাধিক ব্যক্তির মাদক দ্রব্য গ্রহণ।
রোগীর দেহ থেকে রক্ত সংগ্রহ, স্যালাইন বা ইনজেকশনের মাধ্যমে ওষুধ প্রয়োগ করার সময় কিংবা ল্যাবরেটরিতে রক্ত ও রোগীর দেহ থেকে সংগৃহীত তরল পদার্থ নিয়ে পরীক্ষা করার সময় অসাবধানতাবশত
হেপাটাইটিস বি সংক্রমিত রক্ত কিংবা অন্য তরল জাতীয় পদার্থ স্বাস্থ্য কর্মীদের রক্তের সংস্পর্শে এলে।
হেপাটাইটিস বি রোগের প্রাদুর্ভাব অধিক- এ ধরনের এলাকায় ছয় মাসের অধিক সময় অবস্থান করা।
নার্সিং হোমে দীর্ঘ সময়ের জন্য অবস্থান বা কর্মরত থাকা।
এছাড়াও হেপাটাইটিস বি’তে আক্রান- মায়ের গর্ভজাত সন্তানদের অনাক্রান্ত মায়ের গর্ভে জন্ম নেয়া সন্তানদের তুলনায় হেপাটাইটিস বি’তে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অধিক।
শিশুদের মধ্যে সংক্রমণ:
হেপাটাইটিস বি’তে নবজাতকরা পিতামাতার মাধ্যমে আক্রান্ত হতে পারে। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার হেপাটাইটিস বি ভাইরাস জন্মের সময় বাহক মা থেকে শিশুর মধ্যে সংক্রমিত হয়। এ ধরনের সংক্রমনকে ভার্টিক্যাল ট্রান্সমিশন বলা হয় । এছাড়া শৈশবে ও কৈশোরে খেলাধুলার সময় আঁচড়ের মাধ্যমে বাহক শিশু থেকে সুস্থ শিশুতে এ রোগ ছড়াতে পারে । একইভাবে সুচের মাধ্যমে নাক কান ফুটো করার মাধ্যমে সংক্রমিত হতে পারে । আবার অশোধিত সিরিঞ্জ ও সুচ দ্বারা এবং চুল কাটার সময়ও সংক্রমন ঘটতে পারে ।
উপসর্গ :
এক-তৃতীয়াংশ লোক কিছুই বুঝতে পারেন না।
এক-তৃতীয়াংশ লোকের ফ্লুর মতো মাথাব্যথা, গা শিরশির এবং জ্বর হয়।
এক-তৃতীয়াংশ লোকের জন্ডিস, ক্ষুধামন্দা, ডায়রিয়া, বমি ও জ্বর দেখা দেয়।
হেপাটাইটিস বি’র দীর্ঘ মেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব:
হেপাটাইটিস বি’তে আক্রান- রোগীদের অধিকাংশই কোনো প্রকার চিকিৎসা ব্যতিরেকেই আরোগ্য লাভ করে থাকে। পাঁচ বছর বয়সের আগে আক্রান্ত শিশুদের শতকরা ৯০ জনই লিভারের ক্রনিক বা দীর্ঘ মেয়াদি প্রদাহে ভুগতে থাকে। বয়স্কদের মধ্যে এ সংখ্যা হচ্ছে পাচ থেকে দশ ভাগ। ক্রনিক প্রদাহে আক্রান্ত রোগীদের শতকরা একজন প্রতি বছর চিকিৎসা ছাড়াই জীবাণু বিমুক্ত হয় আর শতকরা ৩০ জন লিভার সিরোসিসের মতো মারাত্মক জটিলতায় ভুগতে থাকে। ক্রনিক হেপাটাইটিস বি’তে আক্রান্ত রোগীদের শতকরা পাঁচ থেকে দশজন লিভার ক্যান্সার বা হেপাটোসেলুলার কারসিনোমায় আক্রান্ত হয়।
হেপাটাইটিস বি নিরূপণের উপায়:
রোগের প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিলে রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের অস্তিত্ব শনাক্ত করতে হবে। সাধারণত রক্তে হেপাটাইটিস বি সারফেস অ্যান্টিজেন, হেপাটাইটিস বি আইজিএম কোর অ্যান্টিজেন , হেপাটাইটিস বি ই এন্টিজেন ও সেই সঙ্গে লিভার এনজাইমের অধিক মাত্রা নিশ্চিতভাবে হেপাটাইটিস বি-এর একিউট সংক্রমণের কথা বলে দেয়। ক্রনিক বা দীর্ঘ মেয়াদি হেপাটাইটিস বি নিশ্চিত হওয়ার জন্য রক্তে হেপাটাইটিস বি সারফেস অ্যান্টিজেনের দীর্ঘ মেয়াদি উপসি'তি, হেপাটাইটিস বি কোর আইজিজি (ওমএ) অ্যান্টিজেন, হেপাটাইটিস ই এন্টিজেন ও লিভার এনজাইম পরীক্ষা অত্যন- জরুরি। আর সময়ের ব্যবধানে বি ভাইরাস দেহ থেকে নিঃসৃত হয়ে গেলে রক্তে হেপাটাইটিস বি সারফেস অ্যান্টিজেনের মাত্রা হ্রাস পেয়ে এক সময় অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে এবং ভবিষ্যতের জন্য হেপাটাইটিস বি প্রতিরোধক হেপাটাইটিস বি কোর এন্টিবডি ও বি সারফেস অ্যান্টিবডি তৈরি করে। কতগুলো বিষয়ে সতর্ক থাকলে এ রোগ থেকে দুরে থাকা সম্ভব ।
ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা।
ইনজেকশন ব্যবহারের সময় ডিসপোসিবল সিরিজ ব্যবহার করা।
দাঁতের চিকিৎসার সময় জীবাণুমুক্ত যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া।
রোগের বিরুদ্ধে নিজের শরীরে প্রতিরোধ ব্যবস্হা গড়ে তোলা । হেপাটাইটিস বি-র টিকা ৪টি ডোজ নেওয়া। প্রথম তিনটি ১ মাস পর পর এবং চতুর্থ ডোজটি প্রথম ডোজের ১ বছর পর নিতে হয়।
চিকিৎসা:
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সব নবজাতককে হেপাটাইটিস বি’র টিকা নেয়া অত্যন্ত জরুরি বলে ঘোষণা করেছে এবং ইতোমধ্যে ৮০টির বেশি দেশ এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে টিকা দেয়ার সম্প্রসারিত কর্মসুচি গ্রহণ করেছে।বাংলাদেশ সরকার সকল শিশুকে হেপাটাইটিস বি ভ্যাক্সিন দেয়ার জন্য একে ইপিআই ভ্যাক্সিন কার্যক্রমের অর্ন্তভুক্ত করেছে। এ টিকা যে কোনো বয়সে যে কোনো দিন নেয়া যায়। শতকরা নব্বই ভাগ মানুষের শরীরে এই ভ্যাক্সিন প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলে ।
নীরব ঘাতক এ সংক্রামক ব্যাধিটি প্রতি মিনিটে কেড়ে নেয় দুজন নারী-পুরুষের প্রাণ। প্রতি বছর ১০-৩০ মিলিয়ন মানুষ নতুন করে হেপাটাইটিস বি-তে আক্রান- হচ্ছে । এ রোগ থেকে মুক্ত থাকতে সবার প্রতিষেধকমুলক ব্যবস্থা নেয়া উচিত। সর্বোপরি এ মহামারী থেকে বাচাঁর জন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে।
No comments: