নির্বাচনি সহিংসতায় নিহত ১০, জেলায় জেলায় সংঘর্ষে আহত প্রায় ২০০
প্রথম দফা ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে সংঘর্ষ ও গুলিতে পাঁচ জেলায় ১০ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে পিরোজপুরে পাঁচজন, কক্সবাজারে দুজন এবং নেত্রকোনা, সিরাজগঞ্জ ও ঝালকাঠিতে একজন করে নিহত হয়েছেন। এছাড়া, বিভিন্ন জেলায় নির্বাচনি সহিংসতায় প্রায় দুই ব্যক্তি আহত হয়েছেন।
পিরোজপুরে বিজিবি’র গুলিতে নিহত ৫
পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার ধানিচাপা ইউনিয়নের একটি কেন্দ্রে ভোট গণনাকালে সংঘর্ষ থামাতে বিজিবির গুলিতে ৫ জন নিহত হয়েছেন। নিহতরা হলেন-সোহেল (২৫), শাহাদত (৩০), কামরুল মৃধা (২৫), বেলাল (৩০) ও সোলায়মান (২০)।
মঙ্গলবার রাতে ওই ইউনিয়নের সাপা ডিগ্রি কলেজ কেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে। মঠবাড়িয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জানান, রাতে ভোট গণনার সময় আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর সমর্থকরা ওই কেন্দ্র অবরোধ করে রাখে। এসময় দায়িত্বরত প্রিজাইডিং অফিসার ভোট গণনা স্থগিত করে রাখেন। জোর করে কেন্দ্রে প্রবেশ করতে চাইলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বরত বিজিবি সদস্যরা গুলি ছোড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই তিনজন নিহত হন। আহতদের বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানে আরও দুইজনের মৃত্যু হয়।
টেকনাফে নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায় নিহত ২
কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় অন্তত দু জন নিহত হয়েছেন। নিহতরা হলেন- আবদুল গফুর ও শফিক আলম প্রকাশ দুদু মিয়া। এ সময় আরো অন্তত ৩০ জন গুলিবিদ্ধ হন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী নূর হোসেনের বিজয়ের খবর প্রকাশ পাওয়ার পর আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী সোনা আলী ও তাঁর সমর্থকরা সাবরাং বাজারে এসে বিক্ষোভ ও রাস্তায় ব্যারিকেড দেওয়ার চেষ্টা করলে বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। খবর পেয়ে পুলিশ ও বিজিবি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে প্রথমে লাঠিপেটা ও পরে ফাঁকা গুলিবর্ষণ করে। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে গুলিবিদ্ধ হয়ে আবদুল গফুর মারা যান। নিহত গফুর চেয়ারম্যান প্রার্থী নূর হোসেনের ভাই।
অপরদিকে একই সময়ে একই ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের এক মেম্বার প্রার্থীর বিজয়ের ঘটনার রেশ ধরে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় শফিক আলম প্রকাশ দুদু মিয়া নামে আরো একজন নিহত হয়।
রাত ৮টার দিকে মেম্বার পদপ্রার্থী নুরুল আমিন ও সেলিমের সমর্থকের মধ্যে এ ঘটনা ঘটে। নিহত যুবক শফিক শাহপরীরদ্বীপ মাঝরপাড়ার দুদু মিয়ার ছেলে ও সেলিমের সমর্থক।
সিরাজগঞ্জে ইউপি সদস্যের শ্বাশুড়ি নিহত
সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জে ধানগড়া ইউনিয়নের জয়েনপুর গ্রামে নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় এক নারী নিহত হয়েছেন। নিহত নওনাই বেওয়া নির্বাচনে বেসরকারিভাবে জয়ী ইউপি সদস্য নবাব আলীর শাশুড়ি। মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে নবাব আলী ও পরাজিত প্রার্থী সামিদুল হকের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে তার মৃত্যু হয়। সংঘর্ষে আহত হন আরও ১০ জন। আহতদের মধ্যে ওই গ্রামের মালেককে আশঙ্কাজনক অবস্থায় বগুড়া মেডিক্যাল কলেজে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। ডিবি পুলিশের ওসি ওয়াহেদুজ্জামান নিহতের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
স্থানীয় সূত্র জানা গেছে, ধানগড়া ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডে ইউপি সদস্য পদে জয়েনপুর গ্রামের নবাব আলী (বৈদুত্যিক পাখা) বেসরকারিভাবে জয়ী হওয়ার ঘোষণার করা হয়। এরপর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী সামিদুল হকের (ফুটবল) সমর্থকদের সঙ্গে তার সমর্থকদের সংঘর্ষ শুরু হয়। এ সময় প্রতিপক্ষের আঘাতে নবাব আলীর শাশুড়ি গুরুতর আহত হয়ে ঘটনাস্থলে নিহত হন। উভয়পক্ষের আহত হয়েছেন আরও ১০ জন।
ঝালকাঠিতে নির্বাচনি সহিংসতায় নিহত ১
ঝালকাঠিতে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দুই সাধারণ সদস্য প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে একজন নিহত ও অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছেন।
মঙ্গলবার সদর উপজেলার নবগ্রাম ইউনিয়নের কালিআন্দার গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। নিহত আবুল কাসেম সিকদার (৬৫) বিডিআরের অবসরপ্রাপ্ত সদস্য ছিলেন।
নিহতের ছেলে সোহাগ সিকদার জানান, তারা সদস্য প্রার্থী চুন্নু সিকদারের সমর্থক। প্রতিদ্বন্দ্বী সজিবের লোকজন তাদের ওপর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। এ সময় তার বাবাকে বেধড়ক মারধর করা হয়। গুরুতর অবস্থায় সদর হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ওই হামলায় আরও ৩০ জন আহত হয়। তাদের ঝালকাঠি ও বরিশাল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
নেত্রকোনায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ভাই নিহত
ভোটগ্রহণের পর ব্যালট ছিনিয়ে নিতে গিয়ে নেত্রকোনার খালিয়াজুরীতে পুলিশের গুলিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রার্থী গোলাম আবু ইছহাকের ভাই মো. কাউসার নিহত হয়েছেন। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় খালিয়াজুরী উপজেলা সদর ইউনিয়নের আধাউড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, খালিয়াজুরী ইউনিয়নের আদাউড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের ভোট গণনাকে কেন্দ্র করে মঙ্গলবার রাত ৭টার দিকে সৃষ্ট নির্বাচনী সহিংসতায় গোলাম আবু কাউছার গুলিবিদ্ধ হন। পরে তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় খালিয়াজুরী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. সুধীর চন্দ্র দাস কাউছারকে মৃত ঘোষণা করেন। কে বা কারা গুলি করেছে তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। তবে তার অপর ভাই গোলাম আবু ছালেক জানান, রাত ৭টার দিকে আদাউড়া ভোট কেন্দ্রে ভোট গণনা ও ফলাফল নিয়ে পুলিশের সাথে তর্ক-বিতর্কের সময় সে গুলিবিদ্ধ হয়।
এদিকে অপর একটি সূত্র জানায়, খালিয়াজুরী ইউনিয়নের আদাউড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের ফলাফল তাদের পক্ষে ঘোষণা নিয়ে পুলিশের সাথে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ভাই আবু কাউছার। এ সময় কেন্দ্রের ভিতরে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ এক পর্যায়ে গুলি ছুড়তে বাধ্য হয়। এ সময় আবু কাউছার (৩২) গুরুতর আহত হন।
জেলায় জেলায় সংঘর্ষ
প্রথম ধাপের ইউপি নির্বাচনে সহিংসতা, কেন্দ্র দখল, ভোট জালিয়াতি, ব্যালট পেপার ছিনতাই আর ভোট বর্জনের বেশকিছু ঘটনা ঘটেছে। ভোটের আগের রাতে ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে বাক্স ভর্তি ঠেকাতে পুলিশকে গুলিও চালাতে হয়েছে। কোনো কোনো কেন্দ্রে দুর্বৃত্তরা ত্রাস সৃষ্টি করতে হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে।
নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার চর কিং ইউনিয়নের স্থানীয় বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার শাহাদাত হোসেন ও পোলিং অফিসার আব্দুল আউয়াল গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে এ ঘটনা ঘটে।
প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকরা জানান, সকালে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মহিউদ্দিন আহমদ ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মহিউদ্দিন মুহিনের সমর্থকরা কেন্দ্র দখল-পাল্টা দখলের চেষ্টা চালায়। এ সময় দু’গ্রুপের গুলিবিনিময় ও সংঘর্ষ চলাকালে দুই নির্বাচন কর্মকর্তা গুলিবিদ্ধ হন।
সাতক্ষীরার পাটকেলঘাটা থানার কুমিরা ইউনিয়নের ভাগবাহ ভোটকেন্দ্রে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর পক্ষে ভোট জালিয়াতির সময় পুলিশের গুলিতে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস ও তার ছোট ভাই রুহুল আমিন আহত হন। একই জেলার তালা উপজেলার খলিলনগর ইউনিয়নের হরিশ্চন্দ্রকাটি কেন্দ্রে ভোট কারচুপিতে বাধা দেয়ায় চার আনসার সদস্যকে পিটিয়ে আহত করেছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
লক্ষ্মীপুরের রামগতি ও কমলনগর উপজেলায় ইউপি নির্বাচনে ভোটগ্রহণ শুরুর পর পরই কয়েকটি কেন্দ্র দখলের সময় সংঘর্ষ ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ সময় কমপক্ষে ২০ জন আহত হয়েছেন।
ঝিনাইদহের কোটচাদপুর উপজেলার ৫টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন চলাকালে এলাঙ্গী ইউনিয়নের বলাবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রের বাইরে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে প্রতিপক্ষের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আওয়ামী লীগ কর্মী হুমায়ুন খান (৩৫) গুরুতর আহত হন।
মুন্সীগঞ্জ জেলার বালুরচর ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের খাসমহাল বালুচর কেন্দ্রে দুপুর ১২টার দিকে দুই সদস্য প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষ বাঁধে। এ সময় ৩ পুলিশ সদস্যসহ উভয় পক্ষের কমপক্ষে ১০ জন আহত হন। বেলা ৩টার দিকে একই ইউনিয়নের খাসমহাল উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে দুই সদস্য প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ ও ৫টি বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এ সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কয়েক রাউন্ড টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। এ ঘটনায় আহত হন অন্তত ২৫ জন।
সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জে উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতির নেত্বত্বে কেন্দ্র দখল, জালভোট দেয়া, বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ ও ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এ সময় উভয়পক্ষের অন্তত ১০ জন আহত হয়েছে।#২২ মার্চ (রেডিও তেহরান):
No comments: