হাতে বন্দুক দেওয়া সহজ, বই দিতেই কেন এত কষ্ট শাবাশ সাহসিনী। অসলোর মঞ্চে নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী মালালা ইউসুফজাই। বিসমিল্লা হির রহমান ইর রহিম। পরম করুণাময় ও কল্যাণময় ঈশ্বরকে স্মরণ করছি। নোবেল কমিটির সম্মানিত সদস্য ও ভাইবোনেরা, আজ আমার বড় আনন্দের দিন। আপনাদের সমর্থন ও ভালবাসার জন্য অনেক ধন্যবাদ। সারা পৃথিবী থেকে প্রতিদিন আমি যে সব চিঠি ও কার্ড পাই, আপনারা যে সব বার্তা পাঠান, সেগুলো আমায় এগিয়ে চলার শক্তি জোগায়।
হাতে বন্দুক দেওয়া সহজ, বই দিতেই কেন এত কষ্ট
শাবাশ সাহসিনী। অসলোর মঞ্চে নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী মালালা ইউসুফজাই।
বিসমিল্লা হির রহমান ইর রহিম। পরম করুণাময় ও কল্যাণময় ঈশ্বরকে স্মরণ করছি।
নোবেল কমিটির সম্মানিত সদস্য ও ভাইবোনেরা, আজ আমার বড় আনন্দের দিন।
আপনাদের সমর্থন ও ভালবাসার জন্য অনেক ধন্যবাদ। সারা পৃথিবী থেকে প্রতিদিন আমি যে সব চিঠি ও কার্ড পাই, আপনারা যে সব বার্তা পাঠান, সেগুলো আমায় এগিয়ে চলার শক্তি জোগায়।
বাবা-মায়ের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তাঁরা আমায় প্রাণ খুলে ভালবেসেছেন, কখনও কোনও প্রশ্ন করেননি। বাবাকে ধন্যবাদ, তিনি আমায় উড়তে দিয়েছেন, আমার ডানা ছেঁটে দেননি। কোনও কিছুতেই ধৈর্য না হারানো এবং সব সময় সত্যি কথা বলা এ সব আমি মায়ের কাছ থেকে শিখেছি।
১৭ বছরের জীবনে একটা কথাই সাফ বুঝেছি মানুষের জীবনে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। ছোটবেলা থেকেই সেই বোধটা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তাই সোয়াটের সেই উপত্যকার স্কুলটায় যখন আমরা যেতাম, আমাদের পরনে সব সময়ে থাকত ফিটফাট ইউনিফর্ম। আর চোখে বড় বড় স্বপ্ন। কোনও অনুষ্ঠানে মেহেন্দি পরার সময়ে লতাপাতা না এঁকে আমরা নকশা করতাম অঙ্কের ফর্মুলা আর সমীকরণ দিয়ে! সব সময় চেষ্টা করতাম, যাতে মা-বাবা আমাদের নিয়ে গর্ব বোধ করেন।
তার পর হঠাৎ এক দিন সব পাল্টে গেল। কী ভাবে যেন ‘অধিকার’ থেকে ‘অপরাধ’ হয়ে গেল শিক্ষা। তখন আমার সামনে দু’টো রাস্তা। এক, চুপ করে থেকে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা। বা দুই, মুখ খুলে ততক্ষণাৎ মরে যাওয়া। আমি দ্বিতীয় পথটাই বেছে নিয়েছিলাম। মুখ খুলেছিলাম।
আর তখনই সন্ত্রাসবাদের থাবা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু সেই যুদ্ধে বুলেটের জয় হয়নি।
আমি বেঁচে গিয়েছিলাম। আমার এই গল্প বলার জন্য। কারণ এটা শুধু ‘আমার’ গল্প নয়।
এটা অনেক মেয়ের গল্প।
এটা পাকিস্তানের শাজিয়া ও কায়নাত রিয়াজের গল্প, যারা সে দিন আমার সঙ্গেই ওই বাসে গুলি খেয়েছিল। এটা সিরিয়ার মেজনের গল্প, যে এখন জর্ডানের একটা উদ্বাস্তু শিবিরে দিন কাটায় আর উদ্বাস্তু শিবিরেই বাচ্চাদের লেখাপড়া শেখায়। এই গল্প নাইজেরিয়ার আমিনার, যেখানে শুধুমাত্র স্কুলে যাওয়ার অপরাধে বোকো হারাম জঙ্গিরা মেয়েদের অপহরণ করে নিয়ে যায়।
আপনাদের হয়তো মনে হচ্ছে, এখানে একটাই মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জুতোর হিল-টিল বাদ দিলে যার উচ্চতা মাত্র পাঁচ ফুট দুই। ব্যাপারটা কিন্তু আদপেই সে রকম নয়। আমি একা নই, আমি অনেক।
আমি শাজিয়া।
আমি কায়নাত রিয়াজ।
আমি মেজন।
আমি আমিনা।
আমি সেই সাড়ে ছ’কোটি স্কুল-ছুট মেয়ে।
প্রথম পাশতুন হিসেবে, প্রথম পাকিস্তানি হিসেবে, প্রথম অপ্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে এই পুরস্কার পেয়ে আমি অত্যন্ত গর্বিত। আমার ধারণা, আমিই একমাত্র নোবেল পুরস্কার প্রাপক, যে এখনও তার ভাইদের সঙ্গে মারামারি করে। আমি চাই পৃথিবী জুড়ে শান্তি নেমে আসুক, কিন্তু বাড়িতে কী ভাবে শান্তি বজায় রাখা যায়, সেটা আমি আর আমার ভাইয়েরা এখনও ঠিক রপ্ত করে উঠতে পারিনি।
আমি গর্বিত যে, আমার সহ-পুরস্কার প্রাপকের নাম কৈলাস সত্যার্থী। শিশুদের অধিকার রক্ষায় তিনি বহুদিন ধরে দারুণ কাজ করছেন। কত দিন? আমার যা বয়স, তার দ্বিগুণ সময় ধরে। এক ভারতীয় ও এক পাকিস্তানি যে শান্তির মঞ্চে একসঙ্গে দাঁড়াতে পারে, শিশুদের অধিকার রক্ষায় একসঙ্গে কাজ করতে পারে, সেটা তুলে ধরতে পেরে খুব ভাল লাগছে।
‘মালালা’ মানে কী জানেন? পুশ্তু ভাষায় এর মানে ‘দুঃখে জর্জরিত’। এ রকম একটা নাম হওয়ার জন্য ছেলেবেলায় বেজায় বেজার থাকতাম আমি। আমার মন ভাল করার জন্য আমার দাদু আমায় ডাকতেন, ‘মালালা, পৃথিবীর সব থেকে হাসিখুশি মেয়ে’ বলে। আজ আমি সত্যিই পৃথিবীর ‘সব থেকে খুশি’ মেয়ে।
এক এক জন মানুষের কাছে আমার এক একটা পরিচয়।
কারও কাছে আমি ‘তালিবানের গুলি খাওয়া সেই মেয়েটি’।
কারও কাছে বা ‘অধিকারের জন্য লড়াই করা মেয়েটি’।
এখন আবার অনেকে বলছেন, ‘নোবেল পুরস্কার পাওয়া মেয়েটি’।
আমি যতদূর জানি, আমি একটা একগুঁয়ে মানুষ। যে চায়, পৃথিবীর প্রত্যেকটি শিশু পড়াশোনা করার সুযোগ পাক, প্রত্যেক নারী তাঁর অধিকার ফিরে পান এবং পৃথিবীর প্রতি কোণে শান্তি আসুক।
আমি একা এই পুরস্কারের প্রাপক নই। এই পুরস্কারের প্রাপক সেই সব নাম না-জানা শিশু, যারা পড়াশোনা করতে চেয়েছিল। এই পুরস্কার সেই সব শিশুর জন্য, যারা শান্তি চেয়েছিল। এই পুরস্কার সেই সব অগুনতি শিশুর জন্য, যারা দিন-বদলের স্বপ্ন দেখে।
তাদের অধিকারের দাবিতে, তাদের কণ্ঠস্বর পৌঁছে দেওয়ার জন্য, আজ আমি এখানে এসে দাঁড়িয়েছি। এই সব শিশু আপনাদের করুণা চায় না। তারা চায়, প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হোক, যাতে শিক্ষার অধিকার থেকে আর কোনও দিন কোনও শিশু বঞ্চিত না হয়।
বড়দের এই পৃথিবীর রকম-সকম আমরা ঠিক বুঝি না। খালি আমাদের মনে অনেকগুলো প্রশ্ন তৈরি হয়। যেমন, কেন শক্তিশালী দেশগুলো যুদ্ধ করতে ওস্তাদ, কিন্তু শান্তি ফেরাতে দড় নয়? কেন বন্দুক হাতে তুলে দেওয়া এত সহজ, কিন্তু বই হাতে তুলে দিতে এত কষ্ট হয়? কেন ট্যাঙ্ক বানাতে পরিশ্রম হয় না, কিন্তু ইস্কুল বানাতে কালঘাম ছুটে যায়?
আসুন, সকলে মিলে পৃথিবীতে সাম্য, সুবিচার ও শান্তি ফিরিয়ে আনি। শুধু রাষ্ট্রনেতা বা রাজনীতিবিদ নয়, আমাদের সকলকে এর জন্য খাটতে হবে। আমাকে। আপনাকে। অপেক্ষা করলে চলবে না।
বাল্যবিবাহ বন্ধ হোক।
No comments: